দুদক সচিব আবু মো. মোস্তফা কামাল সমকালকে বলেন, বিদায়ী বছরে প্রধান সাফল্য হলো_ এই প্রতিষ্ঠানের প্রতি মানুষের যে হতাশা, আস্থাহীনতা ছিল, তা দূর হয়েছে। হারিয়ে যাওয়া আস্থা ফিরে এসেছে। বর্তমান কমিশন দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে যে কাজটিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে, তা হলো দুর্নীতির খবর বা তথ্য পাওয়ার পর তাৎক্ষণিকভাবে অপরাধীকে গ্রেফতার ও মামলা করা। দুর্নীতিবাজদের আইনের কাছে সোপর্দ করার ক্ষেত্রে কমিশনের বলিষ্ঠ ভূমিকার কারণে দুর্নীতি দমনে ইতিবাচক ফল এসেছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে কমিশনের নজরদারি জোরদার হওয়ায় দুর্নীতিবাজরা চুপসে গেছে, পালিয়ে বেড়াচ্ছে_ বিদায়ী বছরে এটাই দুদকের বড় অর্জন।
দুদক সূত্র জানায়, বিদায় নিতে যাওয়া ২০১৬ সালে দুর্নীতি মামলায় গ্রেফতার করা হয় অন্তত চারশ’ আসামিকে। এর মধ্যে বর্তমান কমিশন দায়িত্ব গ্রহণের পর সাড়ে নয় মাসে গ্রেফতার করে ৩৮৮ জনকে। বিগত কমিশনগুলোর চার বছরের মেয়াদেও এত সংখ্যক আসামি গ্রেফতারের রেকর্ড নেই। এ বছর মামলা করা হয় ৩৩১টি। একই সময়ে ৫১৪টি মামলায় চার্জশিট দেওয়া হয়। বর্তমান কমিশন দায়িত্ব গ্রহণের পর উচ্চ ও নিম্ন আদালতে দুদকের আইনজীবী প্যানেল ঢেলে সাজানো হয়। দুর্নীতি মামলায় সাজার হার বৃদ্ধির লক্ষ্যে আইনজীবীদের তৎপরতা বাড়ানো হয়। এ কারণেই বিদায়ী বছরে মামলার সাজার হার বেড়ে ৬১ শতাংশ হয়েছে। ২০১৫ সালে এই হার ছিল ৩৭ শতাংশ। দুদক সচিব আরও বলেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কমিশনের যুদ্ধ অব্যাহত থাকবে। যার বিরুদ্ধে দুর্নীতির তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যাবে, সে যে-ই হোক না কেন আইনের আওতায় আনা হবে। এ ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই।
বর্তমান কমিশন দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথমেই দুদকের ভেতরে শুদ্ধি অভিযান শুরু করা হয়। এ ক্ষেত্রে কমিশনের বক্তব্য হলো, যারা কমিশনের কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকবেন তাদের অবশ্যই সৎ, নিষ্ঠাবান ও কর্মঠ হতে হবে। কোনো ক্ষেত্রে এর ব্যত্যয় ঘটলে বা কারও বিরুদ্ধে অসাধুতার প্রমাণ মিললে চাকরিতে বহাল থাকা নয়, তাকে বাড়ি পাঠানো হবে। এই শুদ্ধি অভিযানে এরই মধ্যে একাধিক কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্তও করা হয়েছে।
দুদককে আরও কার্যকর করতে আটটি বিষয়কে অগ্রাধিকার দিয়ে গ্রহণ করা হয়েছে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা। এই বিষয়গুলো হলো, দুদকের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা তৈরি, কার্যকর অনুসন্ধান ও তদন্ত, মামলা পরিচালনা, দুর্নীতি প্রতিরোধ কৌশল, শিক্ষা কৌশল, উদ্ভাবনী গবেষণা ও উন্নয়ন, নিরপেক্ষতা-স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ, আইনি কাঠামো শক্তিশালীকরণ ও প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো সুদৃঢ়করণ। এ ছাড়া সরকারি কাজে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও সহজে সেবাদান নিশ্চিতের লক্ষ্যে বিশেষ সুপারিশমালা পেশ করা হয়েছে রাষ্ট্রপতির কাছে। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতির ফাঁকফোকর বন্ধে একাধিক পরিচালকের নেতৃত্বে গঠন করা হয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক টিম। দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযান পরিচালনায় গঠন করা হয়েছে বিশেষ টাস্কফোর্স।
দুর্নীতি প্রতিরোধে বিদায়ী বছরে জোর দেওয়া হয় গণশুনানির ওপর। সেবামূলক সরকারি বিভিন্ন খাতের ওপর গণশুনানিতে ভুক্তভোগীরা প্রকাশ্যে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অনিয়ম, দুর্নীতির কথা তুলে ধরেন। জনগণের সামনে তাদের ওইসব অভিযোগের জবাব দিতে হয়। দুদক এ পর্যন্ত রাজউক, বিআরটিএ, পাসপোর্ট অফিস, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, ভূমি, বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ৩৫টি গণশুনানি করেছে। এর মধ্যে এ বছর শুনানি হয়েছে ২৫টির মতো। এ ছাড়া, দুর্নীতি প্রতিরোধে এ পর্যন্ত চার জেলার চারটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘সততা স্টোর’ চালু করেছে দুদক। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মধ্যে সততা চর্চার লক্ষ্যে চলতি বছর ব্যতিক্রমী এ উদ্যোগ নেওয়া হয়। বিক্রেতাবিহীন এসব দোকানে শিক্ষার্থীরা নিজ দায়িত্বে তালিকা দেখে পণ্যের মূল্য পরিশোধ করে।
একসময় একের পর এক প্রভাবশালী অভিযুক্ত ব্যক্তিদের দায়মুক্তির সনদ দেওয়া এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ ও আইনি ব্যবস্থা না নেওয়ায় রাষ্ট্রের অতি গুরুত্বপূর্ণ এই প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি ব্যাপকভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছিল। তবে সরকারের সাবেক সিনিয়র সচিব ইকবাল মাহমুদের নেতৃত্বাধীন কমিশন গত ১৪ মার্চ দায়িত্ব গ্রহণের দিন থেকেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নেয় দুদক। দুর্নীতি দমনে শক্ত অভিযানের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়। আসামি গ্রেফতারসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সশস্ত্র ইউনিট গঠনের প্রস্তাবও পাঠানো হয়েছে সরকারের কাছে। আসামিদের নিজেদের হেফাজতে রাখতে নিজস্ব কারাগার নির্মাণের প্রস্তুতিও নেওয়া হচ্ছে। প্রকল্পের কাজে প্রথম থেকেই দুর্নীতি বন্ধে সরকারের বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজের সঙ্গে দুদকের প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে সরকারকে।