জেলা পরিষদ নির্বাচন উপলক্ষে শেষ মুহূর্তে বিভিন্ন জেলায় টাকা ওড়া ও আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ জোরদার হয়েছে। সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলায় আড়াই লাখ টাকা ও নির্বাচনী পোস্টারসহ মোমিন মিয়া (৩০) নামের এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করার পর ভ্রাম্যমাণ আদালত তাঁকে সাত দিনের জেল ও তিন হাজার টাকা জরিমানা করেছেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গতকাল মঙ্গলবার সাংবাদিকদের বলেন, ‘মানি হ্যাজ আ রোল টু প্লে—অস্বীকার করার উপায় নেই। সব রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ব্যয়সীমা মেনে চলা উচিত।’ গতকাল সচিবালয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে এক প্রশ্নের জবাবে সেতুমন্ত্রী সাংবাদিকদের এ কথা বলেন। নির্বাচন কমিশনের নির্ধারিত নির্বাচনী ব্যয় অনেক জায়গায় লঙ্ঘিত হচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, বিকেল চারটার দিকে দোয়ারাবাজার উপজেলার সুরমা নদীর খেয়াঘাটে তল্লাশি চালিয়ে মোমিন মিয়ার কাছ থেকে ‘তালা’ প্রতীকের চার হাজার পোস্টার, আড়াই লাখ টাকা ও এজেন্টের কিছু ফরম উদ্ধার করা হয়। মোমিন মিয়ার বাড়ি সুনামগঞ্জ শহরের উকিলপাড়ায়। তাঁর ঠিকাদারি ব্যবসা রয়েছে। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য পদপ্রার্থী সেলিম মিয়ার নির্বাচনী প্রতীক তালা। মোমিন মিয়া তাঁর আত্মীয়। এ সম্পর্কে সেলিম মিয়া বলেন, ‘আমি তাঁকে (মোমিন) দোয়ারাবাজারে পোস্টার ও এজেন্ট ফরম নিয়ে যেতে বলেছিলাম। ওই বাজারে ঠিকাদারির কাজে তিনি টাকা নিয়ে যাচ্ছিলেন। ওই টাকা নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়।’ জামালপুরে পুলিশ সুপারকে প্রত্যাহার: জামালপুর প্রতিনিধি জানান, জেলা পুলিশ সুপারকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। মঙ্গলবার রাত সাড়ে আটটার দিকে এ তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে। গত শনিবার জামালপুর জেলা পরিষদ নির্বাচনে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের উদ্দেশে পুলিশ সুপার মো. নিজাম উদ্দিন অশালীন বক্তব্য দেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসক মো. শাহাবুদ্দিন খানে কাছে লিখিত অভিযোগ করেন। তাঁরা নির্বাচনী সব কার্যক্রম থেকে তাঁকে প্রত্যাহারের দাবি জানান। এ নিয়ে গত রোববার ‘প্রশিক্ষণ সভায় এসপির অশালীন বক্তব্য’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রথম আলোয় প্রকাশিত হয়। ময়মনসিংহ পুলিশের উপ মহাপরিদর্শক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের সুপারিশক্রমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক জরুরি বার্তায় তাকে প্রত্যাহার করে ঢাকায় পুলিশ সদর দপ্তরে সংযুক্তির আদেশ পেয়েছি।’ আজ নির্বাচন, মোট কেন্দ্র ৯১৫: আজ বুধবার জেলা পরিষদ নির্বাচনে সাধারণ মানুষের ভোট দেওয়ার সুযোগ নেই। স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন স্তরের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা ভোট দিয়ে পরিষদ গঠন করবেন। সকাল নয়টা থেকে বেলা দুইটা পর্যন্ত তিন পার্বত্য জেলা ছাড়া বাকি ৬১টি জেলায় ভোট অনুষ্ঠিত হবে। ভোট দেওয়ার জন্য প্রতিটি সংশ্লিষ্ট জেলা ও তার উপজেলায় ভোটকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। দেশে মোট কেন্দ্রের সংখ্যা ৯১৫টি। ভোটাররা প্রতিটি জেলা পরিষদের জন্য একজন চেয়ারম্যান, ১৫ জন সাধারণ কাউন্সিলর ও ৫ জন সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর নির্বাচিত করবেন। নির্বাচনে নেই বিরোধী দল: স্থানীয় সরকারের অন্যান্য স্তরে দলীয় ভিত্তিতে নির্বাচন হলেও জেলা পরিষদ নির্বাচন হচ্ছে নির্দলীয়ভাবে। এই নির্বাচনে বিএনপি ও জাতীয় পার্টি কোনো প্রার্থীকে সমর্থন দিচ্ছে না। ফলে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও তাদের বিদ্রোহীদের মধ্যেই মূলত লড়াই হবে। তবে গাইবান্ধা, জামালপুর ও কুষ্টিয়ায় তিনজন চেয়ারম্যান প্রার্থীসহ কয়েকজন কাউন্সিলর প্রার্থী দিয়েছে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)। দলটির সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার প্রথম আলোকে এ কথা জানিয়েছেন। ৬১টি জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান পদের মধ্যে ২১ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। আরও একটিতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার পথে রয়েছেন। আদালতের আদেশে এ জয় আটকে আছে। এ ছাড়া সাধারণ কাউন্সিলর পদে ১৬৪ জন এবং সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে ৬৮ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। বিগত উপজেলা, ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভা নির্বাচনে কারচুপি ও অনিয়মের ব্যাপক অভিযোগ ওঠে। এই নির্বাচনে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ দলীয় ও সমর্থিত প্রার্থীরা জয়লাভ করেছেন। ফলে অন্য দলের প্রার্থীদের এই নির্বাচনে জয়ের সম্ভাবনা তেমন ছিল না। বিএনপি এই নির্বাচনকে তামাশার বলে আগেই উল্লেখ করেছে। গতকাল দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান জেলা পরিষদ নির্বাচনকে ‘রসিকতার’ নির্বাচন বলে উল্লেখ করেছেন। স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য মওদুদ আহমদ বলেছেন, এই নির্বাচন গণতন্ত্রকে আরও ধ্বংস করবে। সংসদ, সিটি করপোরেশন, উপজেলা, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচন হলেও কেবল জেলা পরিষদ আইনে প্রত্যক্ষ ভোটের বিধান নেই। অবশ্য এই বিধান নিয়ে উচ্চ আদালতে একটি রিট আবেদন বিচারাধীন আছে। নির্বাচনে টাকার ছড়াছড়ি নিয়ে বিভিন্ন জেলা পরিষদের প্রার্থীরা রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছ অভিযোগ করেছেন। এ প্রসঙ্গে নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ বলেছেন, ভোট সুষ্ঠু করতে সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। টাকা লেনদেনের অভিযোগের প্রমাণ পেলে কমিশন ব্যবস্থা নেবে। মোট প্রতিদ্বন্দ্বী ৩ হাজার ৯৩৮ জন: নির্বাচন কমিশন কার্যালয় থেকে জানানো হয়েছে, এই নির্বাচনে মোট প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ৩ হাজার ৯৩৮ জন। এর মধ্যে চেয়ারম্যান পদে ১২৪ জন, সাধারণ কাউন্সিলর পদে ২ হাজার ৯৮৬ আর সংরক্ষিত নারী কাউন্সিল পদে ৮০৬ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। নির্বাচনে মোট ভোটার সংখ্যা ৬৩ হাজার ১৪৩ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ৪৮ হাজার ৩৪৩ জন এবং নারী ভোটার ১৪ হাজার ৮০০ জন। ভোটের নিরাপত্তায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রায় ২৩ হাজার সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। এ ছাড়া ১৮২ জন নির্বাহী ও বিচারিক হাকিম ভোটের দিন দায়িত্ব পালন করবেন। এ নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করবেন আটটি সংস্থার ৩ হাজার ২২৫ জন। ১৯৮৯ সালে তিন পার্বত্য জেলায় সরাসরি নির্বাচন হয়েছিল। এরপর আর কোনো জেলা পরিষদ নির্বাচন হয়নি। ১৯৮৮ সালে এইচ এম এরশাদ সরকারের সময় করা স্থানীয় সরকার (জেলা পরিষদ) আইনে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানকে সরকার কর্তৃক নিয়োগ দেওয়ার বিধান ছিল। অবশ্য আইনটি পরে অকার্যকর হয়ে যায়। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে ২০০০ সালে আওয়ামী লীগ নির্বাচিত জেলা পরিষদ গঠনের জন্য নতুন আইন করে। এরপর ২০১১ সালের ১৫ ডিসেম্বর সরকার তিন পার্বত্য জেলা বাদে ৬১ জেলায় আওয়ামী লীগের জেলা পর্যায়ের নেতাদের প্রশাসক নিয়োগ দেয়।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.