দেশের চিকিৎসাসেবা দিন দিন চেম্বারনির্ভর হয়ে পড়ছে। ঢাকাসহ দেশের নামকরা সরকারি হাসপাতালগুলোতে রোগীদের উপচেপড়া ভিড় থাকলেও চিকিৎসাসেবায় এই চিত্র লক্ষ্য করা গেছে। সরকারি হাসপাতালে যেসব চিকিৎসক চাকরি করেন তাদের প্রায় ৯৮ ভাগই চেম্বার খুলে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করেন। রোগীদের ‘পকেট’ কাটেন। শুধু অর্থের লোভে চিকিৎসকরা হাসপাতাল থেকে কৌশলে ভাগিয়ে নিয়ে চেম্বারে রোগীদের চিকিৎসা দিতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এতে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা গরিব রোগীদের বাধ্য হয়েই জমি বিক্রি ও ধার-দেনা করে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে। এই প্রাইভেট প্র্যাকটিস ‘মধুর’ লোভেই ঢাকায় কর্মরত ডাক্তাররা মফস্বলে যেতে চান না। ঢাকায় থাকতে তারা মোটা অঙ্কের টাকা খরচ করেন। জানা গেছে, রাজধানী ঢাকার সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকদের আয়ের প্রধান উৎসই হলো প্রাইভেট প্র্যাকটিস। শতকরা ৯৮ ভাগ চিকিৎসকই কোনো না কোনো ক্লিনিক কিংবা প্রাইভেট চেম্বারে নিয়মিত রোগী দেখেন। রোগীপ্রতি ফিও নেন ৫শ’ থেকে এক হাজার টাকা। সরকারি হাসপাতালে তড়িঘড়ি রোগী দেখেই দৌড়ান প্রাইভেট চেম্বারে। সরকারি হাসপাতাল থেকে বেরিয়েই দু’হাতে টাকা কামাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন চিকিৎসকরা। শুধু রোগী দেখার ফি নয়, নির্ধারিত ল্যাবে পাঠানোয় টেস্টের কমিশন, নির্ধারিত কোম্পানির ওষুধ লেখায় ওষুধ কোম্পানির কমিশন এবং নানা ধরনের গিফট পান। ফলে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা কার্যত চেম্বারনির্ভর হয়ে পড়েছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, শুধু ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গাইনি বিভাগের ৭০ জন চিকিৎসকের মধ্যে ৫৬ জনই প্রাইভেট প্র্যাকটিস করেন। এসব চিকিৎসক প্রাইভেট চেম্বার ছাড়াও নগরীর ল্যাবএইড, পপুলার, মেডিনোভা, ইবনে সিনা, কমফোর্ট, মডার্ন, স্কয়ারসহ বড় বড় ক্লিনিকে প্র্যাকটিস করেন। একই চিত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখানকার চিকিৎসকদের শতকরা ৯০ ভাগই হাসপাতালের বাইরে বেসরকারি ক্লিনিকে প্র্যাকটিসে ব্যস্ত সময় পার করেন। রাজধানীসহ সারা দেশে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চিকিৎসকরা সরকারি হাসপাতালে ঠিকমতো রোগী দেখেন না। রোগী এলেই বিরক্তি প্রকাশ করেন বলে অহরহ অভিযোগ পাওয়া গেছে। হাসপাতালে চিকিৎসা করানো সম্ভব নয় বলে চেম্বারে চিকিৎসার জন্য আসতে বলেন। হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসকরা রোগী না দেখায় প্রাইভেট চেম্বারের সামনে বিকালে রোগীর ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। সেখানে রোগীদের ফি দিতে হয়। তারপরও প্রচণ্ড ভিড় থাকায় এখানেও রোগীদের বিপাকে পড়তে হয়। চিকিৎসকরা মনোযোগ দিয়ে রোগী না দেখে সহকারী দিয়ে দেখান। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে গাদা গাদা টেস্ট ধরিয়ে দেন। একই সঙ্গে প্রয়োজনীয় বিশেষজ্ঞের কাছে না পাঠিয়ে দিনের পর দিন আটকে রাখেন। এমন শত অভিযোগ চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে। টেস্ট দিলে তারা কমিশন পান, নির্দিষ্ট ওষুধ কোম্পানির কমিশনের টাকা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে চলে যায়, গিফট পৌঁছে যায় বাসায়। একজন চিকিৎসক সরকারি চাকরির পাশাপাশি নিজস্ব চেম্বারে বসেন। এমনকি একাধিক চেম্বারেও বসেন। চেম্বারে বসা অন্যায় না হলেও সরকারি চাকরিকে ব্যবহার করে চেম্বারে রোগী ভেড়াচ্ছেন। অধিকাংশ চিকিৎসকের ভিজিটিং কার্ডে চেম্বারের ঠিকানা উল্লেখ থাকে। চাকরির চেয়ে তাদের কাছে চেম্বারই হয়ে উঠে মুখ্য। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকার কোনো কোনো চিকিৎসক একদিনে প্রায় শ’খানেক রোগী দেখেন। রোগী দেখতে দেখতে রাত ভোর হয়ে যায়। অভিযোগ রয়েছে, চিকিৎসকরা সরকারি হাসপাতালে রোগী না দেখে নিজ চেম্বারে রেফার্ড করেন। এসব চিকিৎসক নিজ চেম্বারে রোগী দেখার লোভে ঢাকা ছাড়তে চান না। এমনকি ঢাকার বাইরে বদলি হলে আবার ফিরে আসতে না পারলে সরকারি চাকরি ছেড়ে দিতে দ্বিধা করেন না অনেকে। বিধি অনুযায়ী, যত থাকা উচিত তার চেয়ে চারগুণ বেশি চিকিৎসক ঢাকা জেলায় থাকে। বেসরকারি সংস্থা উবিনীগের এক গবেষণা থেকে জানা গেছে, উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে মাত্র ১৭ শতাংশ চিকিৎসক উপস্থিত থাকেন। স্বাস্থ্য আন্দোলন ও সুইডিশ ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এজেন্সি (সিড)-এর এক তথ্য থেকে জানা যায়, দেশে ব্যক্তিমালিকানাধীন বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও রোগ নির্ণয় কেন্দ্রের ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর সেবার মানও পড়ে গেছে। সেই সঙ্গে এসব প্রতিষ্ঠানে রোগী আসার হারও কমে গেছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা থেকে জানা যায়, বিশ্বের প্রায় একশ’ কোটি মানুষ যে কোনো ধরনের স্বাস্থ্যসেবা ব্যয় বহনে অপারগ। পাশাপাশি চিকিৎসা ব্যয় বহন করতে গিয়ে প্রতি বছর প্রায় ১০ কোটি লোক দরিদ্র হয়ে পড়ছে। সমপ্রতি এক আলোচনায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক আঞ্চলিক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক বলেন, চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে দেশে প্রতি বছর ৬৫ লাখ মানুষ দরিদ্র হয়ে যাচ্ছে। একই সঙ্গে রোগীরা তাদের চিকিৎসার ৬৫ শতাংশ ব্যয়ই নিজেদের পকেট থেকে করেন, যা ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনকে বাধাগ্রস্ত করবে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন। আর তাই স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার বিকল্প নেই বলে উল্লেখ করেছেন তিনি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেছেন, আজকাল চিকিৎসায় ওষুধের খরচ বেশি হয়ে যাচ্ছে। ওষুধ কোম্পানি ও ডাক্তারদের মধ্যে কিছু দুষ্টুচক্র তৈরি হয়ে গেছে যারা অনৈতিক অভ্যাসে জড়িয়ে পড়েছে। প্রেসক্রিপশনে বেশি ওষুধ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা বন্ধ করতে হবে। এদিকে দেশের নামিদামি হাসপাতালগুলোতেও চিকিৎসা ফি ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা খরচ অতিরিক্ত হওয়ায় সবার পক্ষে চিকিৎসা নেয়া সম্ভব নয়। এই টেস্ট ও ফি’র ঝামেলায় অনেকে আবার বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা করাচ্ছেন। অবশ্য চিকিৎসকদের টেস্ট ব্যবসার পেছনের কারণ সম্পর্কে অনুসন্ধানে জানা যায়, একাধিক বেসরকারি হাসপাতাল থেকে চেম্বার বসানোর সুযোগ করে দিয়ে চিকিৎসককে অগ্রিম ফ্ল্যাটও দিয়ে দেন। আর ওই ফ্ল্যাটের দাম কমিশন থেকে কেটে রাখা হয়। সরজমিন বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, অভ্যর্থনা কক্ষে প্রবেশ করলেই বিভিন্ন বিশেষজ্ঞের ভিজিটিং কার্ড রাখা আছে। রোগীরা এলেই ধরিয়ে দেয়া হয়। এসব চিকিৎসকের ভিজিটিং কার্ডে সিরিয়াল দেয়ার জন্য একাধিক নম্বর রয়েছে। কিন্তু কোনো চিকিৎসকেরই নিজস্ব মোবাইল নম্বর দেয়া থাকে না ভিজিটিং কার্ডে। এখানেও রোগীদের পড়তে হয় বিড়ম্বনায়। অনেক সময় আবার সিরিয়ালের জন্য ফোন দিলে বলা হয়, এই নম্বরে নয়, ওই নম্বরে যোগাযোগ করুন। অপেক্ষায় থাকুন-একটি নম্বর জানিয়ে বলা হয় ওই নম্বরে ফোন দিয়ে সিরিয়াল দিন। এদিকে চেম্বারে রোগী ভেড়ানো ও টেস্ট কমিশন বাণিজ্যেই শুধু সীমাবদ্ধ নন চিকিৎসকরা, চিকিৎসকদের হাতে বন্দি দেশের ওষুধ কোম্পানিগুলোও। প্রেসক্রিপশনে নির্দিষ্ট ওষুধ লিখবেন বলে কোম্পানির কাছ থেকে মাসে মাসে মাসোহারা নিয়ে থাকেন এসব চিকিৎসক। পাশাপাশি ওষুধের স্যাম্পল তো রয়েছেই। এতে করে অখ্যাত চিকিৎসকরাও মাসোহারা পাচ্ছেন লাখ টাকার উপরে। আর নামি চিকিৎসকদের মাসোহারার পরিমাণ দাঁড়ায় ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত। এ প্রসঙ্গে দেশের একটি নামি ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি জানান, তিনি সর্বনিম্ন যে ডাক্তারকে মাসোহারা দেন তার পরিমাণও ৩ হাজার টাকা। তার কোম্পানি থেকে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত মাসোহারার ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়া, চিকিৎসকদের বিদেশ সফর, বাড়ির কোনো অনুষ্ঠান থাকলে চাহিদা মোতাবেক উপঢৌকন বা অনুষ্ঠান খরচ বহন করতে হয় কোম্পানিকে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.