সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের শূন্য পদ পূরণ হচ্ছে না। ফলে প্রতিবছরই এসব পদের তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে।
গত এক বছরে সরকারের শূন্য পদ বেড়েছে ২৫ শতাংশ। বছরের পর বছর এসব পদ খালি থাকায় দেশে বেকার সমস্যা বাড়ছে। একই সঙ্গে সাধারণ মানুষ সরকারের সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।সরকারি পদ শূন্য থাকার কারণ এবং দ্রুত পদ পূরণের উপায় খুঁজে বের করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে গঠিত সচিব কমিটির রিপোর্ট ফাইলবন্দি হয়ে আছে। ফলে শূন্য পদ পূরণের কোনো তোড়জোড় সরকারের তরফ থেকে নেই। আর যেসব পদে লোক নিয়োগের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে সেগুলোও আটকে যাচ্ছে সংশ্লিষ্টদের অদক্ষতায়।
গত ৩১ অক্টোবর মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত হিসাব অনুযায়ী, ২০১৬ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত সরকারের শূন্য পদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে তিন লাখ ৯ হাজার ৫৯১টি, যা আগের বছরের তুলনায় ২৫ শতাংশ বেশি। গত বছর সরকারের বিভিন্ন দপ্তর-অধিদপ্তরের শূন্য পদ ছিল দুই লাখ ৪৭ হাজার ৬৪৮টি। ২০১৩-১৪ সালে সরকারের শূন্য পদ ছিল দুই লাখ ৪২ হাজার ৪১২টি।
১০ হাজারের বেশি করে শূন্য পদ রয়েছে ৯টি মন্ত্রণালয় বা বিভাগে। এই তালিকার শীর্ষে রয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ মন্ত্রণালয়ের অধীন বিভিন্ন দপ্তরের ৬৪ হাজার ১১০টি পদ শূন্য রয়েছে। এর পরই স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ৩৭ হাজার ৮৫৫টি পদ শূন্য রয়েছে। এ ছাড়া স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ২৬ হাজার ১১টি, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ১৬ হাজার একটি, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগে ১৩ হাজার ৪০২টি, রেলপথ মন্ত্রণালয়ে ১২ হাজার ৫৩৪টি, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ১২ হাজার ৫২৪টি এবং অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে ১০ হাজার ৮৪৮টি পদ শূন্য রয়েছে।
কয়েক বছর ধরে শূন্য পদের শীর্ষে ছিল কৃষি মন্ত্রণালয়। কিন্তু কৃষি মন্ত্রণালয় এসব পদ পূরণের উদ্যোগ নিয়েছে। নিয়োগ কোলেঙ্কারি এড়াতে এই মন্ত্রণালয়ের অধীন দপ্তরগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নিয়োগ পরীক্ষা নিয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গত বছর প্রায় ১০ হাজার নার্স নিয়োগ দিয়েও পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতি ঘটাতে পারেনি। আগামী বছর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় বেশি শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে শূন্য পদ পূরণের পরিকল্পনা করছে। একই পরিকল্পনা স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের। এরই মধ্যে এসব মন্ত্রণালয় জনপ্রশাসন ও অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে শূন্য পদ পূরণের ছাড়পত্র নিয়েছে।
২০১৪ সালে নির্বাচনের আগে সরকার প্রতিটি বাড়ি থেকে একজনকে চাকরি দেওয়ার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছিল। এ জন্য বিভিন্ন প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। সেসব প্রকল্প থেকে সংশ্লিষ্টদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে এবং এর ভিত্তিতে অস্থায়ী চাকরিও দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু সরকারের রাজস্ব আদায়কারী বিভাগের বিভিন্ন পদ খালি পড়ে আছে। এ ছাড়া অন্যান্য দপ্তর-অধিদপ্তর তো রয়েছেই। এসব পদ শূন্য থাকার কারণ জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নানা কারণে পদ শূন্য থাকে। সময়মতো জনবল নিয়োগ দিতে না পারার অন্যতম কারণ হচ্ছে অদক্ষতা। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কর্মকর্তারা জানেনই না কিভাবে ত্বরিত জনবল নিয়োগ দিতে হয়। তাঁদের এ সম্পর্কে কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ নেই। বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকলেও সরকারের জনবল নিয়োগের বিষয়ে আলাদা কোনো প্রশিক্ষণ নেই। জনবল নিয়োগ দিতে না পারার আর একটি বড় কারণ হচ্ছে মামলা-মোকদ্দমা। সরকারের মন্ত্রী, সচিবরা এবং সরকারি দলের এমপিরা তাঁদের পছন্দের ব্যক্তিকে চাকরি দিতে চান। চাকরির বিনিময়ে তাঁরা নিজেরা বা তাঁদের নামে পাতি নেতারা কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। শূন্য পদের চেয়ে অতিরিক্ত প্রার্থীর কাছ থেকে টাকা নিয়ে তাঁরা আর চাকরি দিতে পারেন না। একসময় বাধ্য হয়ে নিয়োগপ্রক্রিয়া বন্ধ করে দিতে হয়। এ ছাড়া প্রভাবশালীদের তদবির রক্ষা করতে গিয়ে মেধাবীদের বঞ্চিত করা হয়। এসব বঞ্চিত প্রার্থী আদালতে মামলা করেন। মামলার কারণে অনেক নিয়োগ বন্ধ হয়ে আছে।
ভূমি মন্ত্রণালয় উপজেলা ভূমি অফিসের জন্য ৪০০ কানুনগো নিয়োগের বিজ্ঞাপন দেয় ২০০৪ সালে। লিখিত পরীক্ষা শেষে প্রার্থীরা অপেক্ষা করছিলেন মৌখিক পরীক্ষার জন্য। এই পর্যায়ে ভূমি মন্ত্রণালয়ের একটি চক্র ৪০০ কানুনগো নিয়োগ করতে গিয়ে প্রায় এক হাজার জনের কাছ থেকে বড় অঙ্কের টাকা হতিয়ে নেয়। অতিরিক্ত প্রার্থীর কাছ থেকে টাকা নেওয়ায় একসময় নিয়োগ থেকে পিছিয়ে আসে ভূমি মন্ত্রণালয়। কয়েকজন প্রার্থী আদালতে মামলা করেন। সেই মামলা এখন শেষ পর্যায়ে রয়েছে বলে ভূমি মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন। আদালত নির্দেশ দিলে তাঁরা এসব পদে লোক নিয়োগ দেবেন। এ জন্য নানা ধরনের প্রস্তুতি তাঁরা নিচ্ছেন। বিজ্ঞাপন প্রকাশের ১২ বছর পর চাকরি দেওয়া হলে চাকরিপ্রার্থীদের একটা বড় অংশই সরকার নির্ধারিত মেয়াদ চাকরি করতে পারবে না।
গত বছর সরকারি চাকরি থেকে শ্রেণিবিন্যাস তুলে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ দীর্ঘদিন ধরে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির যে বিন্যাস ছিল তা এখন বিলুপ্ত। এখন সরকারি চাকরির ধাপ নির্ধারণ হয় গ্রেড অনুযায়ী। প্রথম শ্রেণির চাকরি নবম গ্রেড থেকে শুরু হয়। দ্বিতীয় গ্রেডের চাকরি শুরু হয় ১১ গ্রেড থেকে। নবম গ্রেড বা প্রথম শ্রেণি এবং ১১ গ্রেড বা দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরির সবচেয়ে বড় উৎস হচ্ছে পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি)। এসব চাকরিতে নিয়োগ দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে সাংবিধানিক সংস্থাটি। দুর্বোধ্য কোটা পদ্ধতি অনুসরণ করতে গিয়ে সংস্থাটি সময়মতো উপযুক্ত জনবল বাছাই করতে পারছে না। এক বছরের মধ্যে বিসিএস নিয়োগ সম্পন্ন করার লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও তাদের বছরের পর বছর লেগে যাচ্ছে। সম্প্রতি ৩৪তম বিসিএসের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বিজ্ঞাপন প্রকাশের ৪৮ মাস পর। শুধু বিসিএস নয়, দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরির যোগ্য প্রার্থী বাছাই করতে গিয়েও এই দীর্ঘ সময় ব্যয় করতে হচ্ছে পিএসসিকে। এসব চাকরিতে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা, ১০ শতাংশ জেলা কোটা, ১০ শতাংশ মহিলা কোটা এবং ৫ শতাংশ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটা অনুসরণ করতে হয়। এসব কোটার মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় উপযুক্ত প্রার্থী না পাওয়া গেলে তা সংরক্ষণ করতে হয়। অর্থাৎ মুক্তিযোদ্ধা কোটায় প্রার্থী না পাওয়া গেলে মেধাবীদের মধ্য থেকে তা পূরণ করা যায় না।
সম্প্রতি পিএসসির সচিব নুুরুন্নবী তালুকদার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছেন, এই কোটা পদ্ধতি অনুসরণ করতে গিয়ে ২৮তম বিসিএসে ৯১টি, ২৯তম বিসিএসে ৪৫টি, ৩০তম বিসিএসে ৮৫টি, ৩১তম বিসিএসে ৩৬টি, ৩২তম বিসিএসে ১৩টি, ৩৩তম বিসিএসে প্রথম শ্রেণির ৯১টি, দ্বিতীয় শ্রেণির ৮৫টি এবং ৩৪তম বিসিএসে প্রথম শ্রেণির ৬২টি ও দ্বিতীয় শ্রেণির এক হাজার ২৪৬টি পদ শূন্য রয়েছে। এসব পদের উপযুক্ত প্রার্থী মেধা কোটায় থাকার পরও তাতে নিয়োগের সুপারিশ করতে পারেনি পিএসসি। এ কারণে পিএসসি ৩৫তম বিসিএসে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় উপযুক্ত প্রার্থী না পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট পদ সংরক্ষণ না করে মেধা কোটায় নিয়োগ দেওয়ার সুপারিশের সুযোগ চেয়েছে। শুধু বিসিএসেই নয়, সম্প্রতি সরকার প্রায় ১০ হাজার নার্স নিয়োগ দিয়ে বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে পদায়ন করেছে। মাত্র ১১ মাসের মধ্যে এ নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় প্রার্থী না পাওয়ার পর তা সংরক্ষণ না করার কারণে। নার্স নিয়োগের সময় সরকার মুক্তিযোদ্ধা কোটার পদ সংরক্ষণের বিধান শিথিল করেছিল। পিএসসি গত বছরের ১১ অক্টোবর সার্কেল অ্যাডজুট্যান্ট এবং উপজেলা আনসার ও ভিডিপি কর্মকর্তার ২০৮টি শূন্য পদে লোক নিয়োগের জন্য বিজ্ঞাপন প্রকাশ করে। এই চাকরির জন্য ৫১ হাজার ৬২১টি আবেদন জমা পড়ে। তাদের প্রিলিমিনারি, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা শেষে এরই মধ্যে ৭৭০ জনকে বাছাই করা হয়েছে। এই চাকরির ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা কোটা অনুসরণ করতে গেলে অনেকগুলো পদ শূন্য থেকে যাবে। এ অবস্থায় পিএসসি মুক্তিযোদ্ধা কোটা শিথিলের অনুরোধ করেছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের (আগের নাম সংস্থাপন মন্ত্রণালয়) সাবেক সচিব ড. মাহবুবুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পিএসসির সঙ্গে আমি একমত। কারণ স্বাধীনতার ৪৬ বছর পর সময় হয়েছে মেধাবীদের জায়গা করে দেওয়ার। আমি মুক্তিযোদ্ধা, নারী, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষদের অসম্মান করছি না। তাদের প্রতি সম্মান রেখেই বলছি, এখনো কোটা পদ্ধতি বহাল রাখা হলে প্রতিযোগিতায় আমাদের প্রশাসনের কর্মকর্তারা পিছিয়ে থাকবেন। শুধু মুক্তিযোদ্ধা কোটা নয়, সব কেটায়ই সংস্কার দরকার। নারীরা বহুদূর এগিয়েছেন। শিক্ষাদীক্ষায় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সদস্যরাও এগিয়েছেন। কাজেই এখন সব কিছুই প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে হওয়া দরকার। আর শুধু কোটা সংস্কার করলেই যে দ্রুত নিয়োগ হবে তা ভাবার কোনো কারণ নেই। শূন্য পদে নিয়োগ দ্রুত দিতে হলে কর্মকর্তাদের দক্ষতা বাড়াতে হবে। সংশ্লিষ্টদের অদক্ষতার জন্য অনেক নিয়োগ আটকে যায়। ’
২০১২ সালে সরকারি দপ্তরে পদ সৃজন থেকে শুরু করে চূড়ান্ত নিয়োগ পর্যন্ত দীর্ঘ সময় লাগার কারণ অনুসন্ধান করে তা নিরসনের নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদসচিব মোশাররাফ হোসাইন ভূঁইঞাকে প্রধান করে সচিব কমিটি গঠন করেছিলেন। সেই সচিব কমিটির অনুসন্ধানে বের হয়ে এসেছিল, পদ সৃজন থেকে শুরু করে পদ পূরণ করতে সর্বোচ্চ দুই হাজার ৬০০ দিন সময় লাগে। অবিশ্বাস্য এই সময় কমিয়ে আনার জন্য সচিব কমিটি ১১ দফা সুপারিশ করেছিল, যা মোশাররাফ হোসাইন ভূঁইঞা বিশ্বব্যাংকে যোগদানের আগে প্রধানমন্ত্রীর কাছে জমা দিয়েছিলেন। এ সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য প্রধানমন্ত্রী জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেই নির্দেশ বাস্তবায়িত হয়নি। সেটা ফাইলবন্দি হয়ে আছে।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.