‘নিশি অবসানপ্রায়, ওই পুরাতন বর্ষ হয় গত!’—মহাকালের পরিক্রমায় আজকের সূর্যোদয়ে আরও একটি নতুন বছরের দিন গোনা শুরু হলো। পুরোনো গ্রেগরিয়ান দিনপঞ্জিকাটি এখন অপ্রয়োজনীয় হিসেবে অপসারিত হয়ে চলে এসেছে ২০১৭ লেখা ঝকঝকে নতুন একখানা। নতুনের প্রতি মানুষের আগ্রহ চিরায়ত। সেই আগ্রহ উৎসাহ নিয়েই আজ নতুন বছর শুরু হলো বিশ্বজোড়া, এ দেশের জনজীবনেও।
এদিকে বঙ্গোপসাগরের তীরে সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়েছে বিচ কার্নিভ্যালের সুরের মূর্ছনা। যদিও নাগরিক জীবনের জঙ্গমতা ও যান্ত্রিকতা থেকে মুক্তি পেতে ছুটে এসেছেন এই সমুদ্রসৈকতে। কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের ডায়াবেটিক হাসপাতাল পয়েন্ট থেকে কলাতলী পয়েন্ট পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটার পর্যন্ত পাঁচটি পয়েন্টেই লোকজনের সমাগম বেশি।
গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় সমুদ্রসৈকতে পর্যটকের উপস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে কক্সবাজার কটেজ মালিক সমিতির সভাপতি কাজী রাসেল আহম্মেদ জানান, ২০১৫ সালে থার্টি ফার্স্ট নাইটের উৎসব দেখতে সৈকতে সমবেত হয়েছিলেন তিন লাখের মতো পর্যটক। এবারও তাই আশা করা হচ্ছে। কয়েক বছর ধরেই বছরের শেষ দিনগুলোতে এই সংখ্যায় পর্যটক আসছেন। সমুদ্রসৈকতকেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক বিনোদন বাড়ানোর পাশাপাশি বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করা গেলে পর্যটকের এই সংখ্যা অনেক বাড়বে। এখন যাঁরা আসছেন, তাঁদের বেশির ভাগই তরুণ।
নিরাপত্তা নিয়ে সন্তুষ্টি, নাগরিক কোলাহল থেকে মুক্তি পেতে লোকজন বিপুল সংখ্যায় কক্সবাজারে এলেও সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে বিচ কার্নিভ্যালের যতি টানায় লোকজনের মাঝে অতৃপ্তি তৈরি করেছে। কারণ বিপুল সংখ্যায় দেশি-বিদেশি পর্যটক আকৃষ্ট করতেই গত বছর থেকে শুরু হয়েছে তিন দিনের বিচ কার্নিভ্যাল। এবারও বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন তিন দিনের এই উৎসবের আয়োজন করেছে।
জানতে চাইলে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন গতকাল দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, ২২ থেকে ৩১ ডিসেম্বর ১০ দিনে অন্তত ৯ লাখ পর্যটক কক্সবাজারে এসেছেন। বিপুলসংখ্যক পর্যটকের নিরাপত্তা দিতে পুলিশ ও জেলা প্রশাসনের জন্য দুরূহ কাজ। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও দূরের লোকজনের নিরাপদে বাড়ি পৌঁছার সুবিধার্থে সমুদ্রসৈকতের সব ধরনের অনুষ্ঠান সন্ধ্যার আগে শেষ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
গতকাল দুপুরে সমুদ্রসৈকতে কথা হচ্ছিল ঢাকা থেকে আসা স্বাধীন ও তাঁর স্ত্রী অলিভিয়ার সঙ্গে। তাঁদের মত হচ্ছে, কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে যাঁরা আসেননি তাঁদের পক্ষে এর সৌন্দর্য বোঝাটা অসম্ভব। হালকা ঠান্ডা থাকলেও আবহাওয়াটা যথেষ্ট মনোরম। নিরাপত্তা মোটামুটি ভালো।
দেশের বাইরে থাকা মো. আল আমিন স্ত্রীকে নিয়ে প্রথমবারের মতো ছুটিতে কক্সবাজারে এলেন। সার্বিক অবস্থা আগের চেয়ে অনেক উন্নত হয়েছে দেখে তাঁর ভালো লাগছে।
পর্যটকদের সার্বিক নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ট্যুরিস্ট পুলিশের জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার রায়হান কাজেমী গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, জোয়ার-ভাটার তথ্য জানাতে ট্যুরিস্ট পুলিশ বিভিন্ন ধরনের প্রচার চালাচ্ছে। সমুদ্রসৈকতে আগে রাত ১০টা পর্যন্ত পর্যটকেরা ঘুরতে পারতেন। এখন রাত-দিন ২৪ ঘণ্টা ঘুরতে পারছেন। তা ছাড়া দরিয়ানগর, হিমছড়ি, ইনানী সৈকত, টেকনাফ সৈকতেও সারা দিন নিরাপত্তা দিচ্ছে ট্যুরিস্ট পুলিশ। এ কারণে পর্যটকেরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন না। সমুদ্রে নেমে নিখোঁজ ও হতাহতের ঘটনাও কমে আসছে।
কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি (ভারপ্রাপ্ত) আবু মোর্শেদ চৌধুরী জানান, গত ১০ দিনে প্রায় ৯ লাখ লোক কক্সবাজার এসেছেন। চার শতাধিক হোটেল-মোটেল, গেস্টহাউস, কটেজ, চার শতাধিক রেস্তোরাঁ, শুঁটকি, মাছ, কুটিরশিল্পসহ পর্যটনশিল্পের সঙ্গে জড়িত নানা প্রতিষ্ঠান অন্তত ২০০ কোটি টাকার ব্যবসা করেছে। কিন্তু পর্যটন বিকাশে এখানে বিনোদনের জন্য তেমন কিছু গড়ে ওঠেনি।
কক্সবাজার হোটেল মোটেল গেস্টহাউস মালিক সমিতির সভাপতি ওমর সুলতান বলেন, শহরের ৪৫৩টি হোটেল, মোটেল, গেস্টহাউসে দৈনিক থাকতে পারেন ৯৭ হাজার পর্যটক। পর্যটকের সংখ্যা এর বেশি হলে ওই কক্ষগুলোতে গাদাগাদি করে রাখতে হয়। পর্যটকেরা সমুদ্রসৈকত উপভোগের পর শহরের বৌদ্ধপল্লি, মহেশখালীর আদিনাথ মন্দির, টেকনাফের মাথিনকুপ, সেন্ট মার্টিন দ্বীপ, রামুর বৌদ্ধপল্লি, চকরিয়ার ডুলাহাজারা সাফারি পার্ক ঘুরে দেখেন। কিন্তু সন্ধ্যার পর বিনোদনের তেমন কিছু থাকে না। পর্যটকদের হোটেলের কামরায় বসেই রাত কাটাতে হয়। অনেকেই ভ্রমণ কাটছাঁট করেই বাড়ি ফিরে যান।
অভিজাত হোটেল দ্য কক্সটুডের পরিচালক মো. শাখাওয়াত হোসেন বলেন, বর্ষবরণ ও বিদায়কে ঘিরে প্রতিবছর এই সৈকতে কয়েক লাখ পর্যটক হাজির হন। কিন্তু বছরের মাঝামাঝিতে তেমন পর্যটক হয় না। ওই সময় পর্যটক টানতে বিচ কার্নিভ্যালসহ নানা উৎসব হওয়া প্রয়োজন।
সব মিলিয়ে একটি বছর পেরিয়ে গেলে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসাব মেলানোর স্বাভাবিক তাগিদ আসে সবার মনেই। সম্ভাবনার বীজ থাকে তার অভ্যন্তরে। সম্ভাবনাসমূহ বাস্তবায়ন করার প্রত্যয় প্রত্যাশা নিয়েই তবে নতুন বছরের শুরু হোক।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.