জঙ্গি-সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যখন পুরো বিশ্ব সরব, বিশ্বনেতারা একাট্টা, তখনও এর ভয়াবহ রূপ পৃথিবীর কোনো না কোনো প্রান্তের মানুষকে কাঁদিয়েছে। ২০১৬ সালে জঙ্গিবাদের বিষাক্ত বীজ কেবল অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে নয় বরং অঙ্কুরোদগম ঘটায় উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশেও।
লিপ ইয়ারের এই সালে বিশ্বব্যাপী ১৮শ’র বেশি ছোট বড় সন্ত্রাসী ও জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় মর্মান্তিকভাবে প্রাণ হারান ১৬ হাজার মানুষ। জনবহুল মার্কেট থেকে পার্ক-বিমানবন্দর কিংবা বাসা-বাড়ি বা হাসপাতাল, কোনো স্থানই বাদ যায়নি হামলা থেকে। এমনকি ভয়াবহতার বিস্তৃত তালিকা থেকে বাদ পড়েনি মসজিদ, মন্দির, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের মতো জায়গাও। যেসব ঘটনা বেশি আলোচিত-সমালোচিত, বিশ্ব নাড়ানো ও যার রেশ দীর্ঘ- তেমনই কিছু দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে বিশ্বে ২০১৬ সালের ১৬ আলোচিত জঙ্গি হামলার কথন।
বছরের প্রথম সপ্তাহেই (০৭ জানুয়ারি) লিবিয়ার পশ্চিমাঞ্চলীয় জিনতান শহরে পুলিশ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে আত্মঘাতী ট্রাকবোমা হামলায় কমপক্ষে ৬০ জন নিহত হন। আহত হন প্রায় ১০০। ঘটনার পর পরই দেশটিতে নিযুক্ত জাতিসংঘ দূত মার্টিন কোবলার নিন্দা জানান এবং সন্ত্রাস দমনে সবাইকে এক হওয়ার আহ্বান জানান।
আইএস জঙ্গিদের কব্জায় ইরাকের মসুল। ৮ ফেব্রুয়ারি নৃশংস নিধনযজ্ঞের সাক্ষী থাকলো বিশ্ব। পুলিশ, সমাজকর্মী, সেনা- সবমিলিয়ে প্রায় ৩০০ জনকে হত্যা করে জঙ্গিরা। এর কয়েকদিন পর শিয়া মুসলিম অধ্যুষিত সিরিয়ার দুটি শহরে আইএস জঙ্গিদের গাড়ি বোমা বিস্ফোরণে নিহত হন ২৭০ জনের বেশি মানুষ। বছরের বিভিন্ন সময়ে হামলায় সব থেকে বেশি মানুষ মারা গেছেন এখানে।
মার্চের ২২ তারিখ বেলজিয়ামে কয়েক দফা গুলি আর আত্মঘাতী বোমায় কেঁপে ওঠে ব্রাসেলসের জাভেন্তেম বিমানবন্দর আর মালবিক মেট্রো স্টেশন। এতে প্রাণ যায় ৩০ জনের; আহত হন দেড়শতাধিক। দায় স্বীকার করে আইএস।
ওই মাসেই (২৭ মার্চ) সন্ত্রাসী হামলার তীর্থভূমি পাকিস্তানের লাহোরের গুলশান-ই-ইকবাল পার্কে ইস্টার সানডে উৎসবে আত্মঘাতী হামলা চালায় জঙ্গি সংগঠন জামাত-উল আহরার। প্রাণ যায় ৭০ জনের বেশি মানুষের।
আবু সায়াফ ফিলিপাইনের গেরিলা গ্রুপ। এপ্রিলের ৯ তারিখ তাদের গুলিতে দেশটিতে ১৮ জন নিহত হন; আহত হন অর্ধশত।
উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্য মনিপুরের চান্দাল জেলায় ২২ মে সন্ত্রাসীদের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে আসাম রাইফেলসের এক কর্মকর্তাসহ ছয় জওয়ানের মৃত্যু হয়। সৈন্যদের কাছ থেকে ছয়টি একে-৪৭ রাইফেল ও গোলাবারুদও লুটে নেয় সন্ত্রাসীরা। যা বেশ আলোচনায় আসে।
সোমালিয়ার ইসলামপন্থী উগ্র জঙ্গি সংগঠন আল-শাবাব। তারা সেখানকার কেন্দ্রীয় অঞ্চলে আফ্রিকান ইউনিয়নের (এইউ) একটি ঘাঁটিতে হামলা চালিয়ে ইথিওপিয়ার ৪৩ সেনাকে হত্যা করে। জুন মাসের শুরুর দিকের এই ভয়াবহতা আলোড়ন ছড়ায় বিশ্বজুড়ে। এ মাসে আরও পৃথক কিছু হামলা হয়েছে। জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি, নভেম্বরসহ প্রতিটি মাসেই কম বেশি জঙ্গি হামলা তাদের ছিলোই।
এবার গন্তব্য সমকামী ক্লাব। ১২ জুন বন্দুকধারী ঢুকে যায় যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার ওরল্যান্ডোর সমকামীদের জন্য বিখ্যাত একটি নাইট ক্লাবে। হামলাকারী আফগান বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক ওমর মতিন। ক্লাবের বাইরে এক পুলিশ কর্মকর্তাকে হত্যার পর ভেতরে প্রবেশ করে এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে সে মেরে দেয় অর্ধশতাধিক মানুষকে। পরে অবশ্য নিজেই মারা পড়ে পুলিশের গুলিতে। এই ঘটনাকে যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে বড় হত্যাকাণ্ড বলে ঘোষণা করে মার্কিন পুলিশ।
নির্বাচনের আগে আগে মার্কিন মুলুকে এমন হত্যাকাণ্ডে অবাক যখন বিশ্ব, ঠিক তখনই প্রগতির দেশ তুরস্কে হামলা। লক্ষ্য, রাজধানী ইস্তাম্বুলের কামাল আতাতুর্ক বিমানবন্দর। ২৮ জুন তিন হামলাকারী বিস্ফোরক ও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে হামলা চালায়। অন্তত ৪৫ জনের প্রাণহানি ঘটে। আহত হন আড়াইশরও বেশি।
প্রায়ই প্রকম্পিত হয়ে ওঠা ইরাকে সেদিনও ছিল সাধারণ দিন। সিয়ামর মাস। রাজধানী বাগদাদে ৩ জুলাইয়ের বিস্ফোরণে ৩৪১ জনের মৃত্যু হয়, আহত হন ১০০ জনেরও বেশি। শিয়া অধ্যুষিত এলাকায় রমজানের কেনাকাটার মধ্যেই আইএস জঙ্গিরা গাড়িবোমা বিস্ফোরণ ঘটায়।
ফ্রান্সের নিস শহরে ১৪ জুলাই বাস্তিল দিবসের উৎসবে জড়ো হওয়া জনতার ওপর ট্রাক উঠিয়ে দেয় মোহাম্মদ লাউয়াজি বুলেল নামে এক ব্যক্তি। এতে প্রাণ যায় ৮৪ জনের। ঘটনাস্থলেই গুলি করে মারা হয় বুলেলকে। এই হামলারও দায় স্বীকার করে আইএস।
ফ্রান্সের উত্তরাঞ্চলের রুয়েন শহরের কাছে অবস্থিত একটি চার্চে ২৬ জুলাই হামলা চালায় আইএস জঙ্গিরা। এতে একজন পাদ্রি নিহত হন। ঘটনাস্থলে পুলিশের গুলিতে ২ হামলাকারীও মারা যান। চার্চে জিম্মিদের মধ্যে নিহত পাদ্রিকে গলাকেটে হত্যা করে অস্ত্রধারী হামলাকারীরা।
রোজকার অনেক ছোটখাটো জঙ্গি হামলাকে ছাপিয়ে সন্ত্রাসের তীর্থ পাকিস্তান ফের বিশ্ব নজরে। ৮ আগস্ট বেলুচিস্তানের কোয়েটায় একটি হাসপাতালে আত্মঘাতী বোমা হামলায় অন্তত ৭০ জন প্রাণ হারান। হতাহতের বেশিরভাগই ছিলেন আইনজীবী ও সাংবাদিক। দায় স্বীকার করে আইএস, তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান এবং জামাত-উল-আহরার।
সময়টা অন্ধকার ভোর। ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৬। ভারতের জম্মু ও কাশ্মীরের উরিতে সেনাবাহিনীর সাব-কোয়ার্টারে হামলা চালায় ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত জৈশ-এ-মোহাম্মদ জঙ্গিরা। গত দুই দশকে ভারতে এর চেয়ে ভয়ঙ্কর হামলা আর হয়নি বলে স্থানীয় পত্রিকাতে আসে। জঙ্গিদের তীব্র গুলিবর্ষণে ১৯ জন সেনা নিহত হন। মারা পড়েন হামলাকারী চারজনও।
অক্টোবরের ২৪ তারিখ পাকিস্তানের কোয়েটা শহরের পুলিশ একাডেমিতে সশস্ত্র বন্দুকধারীরা হামলা চালায়। এতে ৬১ জন ক্যাডেট নিহত হন। ইসলামিক স্টেট যার দায় স্বীকার করে।
তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারায় ১৯ ডিসেম্বর। সেখানে নিযুক্ত রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আন্দ্রেই কার্লভ বন্দুকধারীর গুলিতে নিহত হন। একজন কূটনৈতিকের এমন প্রকাশ্য মৃত্যুতে বিশ্বব্যাপী আলোচনার ঝড় ওঠে। দূতাবাসগুলোতে খোলা হয় শোক বই।
একই দিন জার্মানির বার্লিন শহরে জনাকীর্ণ একটি বাজারে জনতার ওপর ট্রাক-লরি চাপিয়ে দেয় এক ব্যক্তি। সন্দেহভাজন হিসেবে ইতালি যাওয়ার পথে আনিস আমরি নামে তিউনিসিয়ার এক নাগরিককে গুলি করে মেরে ফেলা হয়। তার ট্রাক-লরি কাণ্ডে ১২ জন নিহত হয়। আহত হন প্রায় অর্ধশত মানুষ।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.