মিরা ঘুম থেকে উঠেই ঘোষণা দিল, ‘আজ কিছু রাঁধতে পারব না। রোজ রোজ চুলার কাছে যেতে ভালো লাগে না। যাও, হোটেল থেকে পায়া-পরোটা নিয়ে এসো।’ এ কথায় আমার পেটে গুড়গুড় শুরু হলো। মাসের শেষ দিকে ওর কী যে হয়, খালি ঝামেলায় ফেলার চেষ্টা! মনে যাই থাক, ছুটির দিন সকালে বউয়ের সঙ্গে বাগ্যুদ্ধে যেতে চায় কে? গায়ে হাওয়াই শার্ট চাপিয়ে ঠিকই মোড়ের রেস্তোরাঁ থেকে পায়া-পরোটা নিয়ে এলাম। নাশতা খেতে খেতে বললাম, ‘আমাদের অফিসের সেন্টুকে চেনো তো?’ ‘ওই যে পিকনিকে পরিচয় হলো, হ্যাংলামতো ছেলেটা?’ ‘হুঁ।’ ‘তা কী করেছে সে?’ ‘দেখো, মাত্র সেদিন বিয়ে করল, অথচ এর মধ্যে গাড়ি কিনে ফেলেছে!’ ‘কীভাবে?’ ‘ওই কাটছাঁট করে!’ ‘মানে?’ ‘মাসের ১৫ তারিখের পর থেকে খালি সবজি খায়। মাছ-মাংস ছোঁয়ই না। এভাবে টাকা জমিয়ে জমিয়ে…।’ মিরা বাঁকা হেসে বলল, ‘চুলার কাছে যাব না বলেছি, আর অমনি শুরু করে দিলে, না? আচ্ছা, বিয়ের এই দুই বছরের মধ্যে আমাকে কয়টা দিন বাইরে খাইয়েছ, বলো তো?’ আমি পটাপট দুটো ঢোক গিলে ফেলি। মিরা বেশ আহ্লাদি ভঙ্গিতে বলে, ‘চলো না, আজ বাইরে কোথাও খেয়ে আসি?’ একেই বলে গর্ত খুঁড়ে ওতে নিজেই সড়াৎ করে পিছলে পড়া। এ সময় বাইরে খাওয়া মানে একটুখানি মরিচ-ডলা! ভেতরে-ভেতরে জ্বলবে, অন্য কেউ টের পাবে না। আর খাওয়ার পর যদি কোনো শপিং মলে একটু চক্কর দেওয়ার শখ হয়, তাহলে তো ছিল্লা কাইট্টা লবণ!
জুলহাসউদ্দিন ওরফে জুলুর নাম মাথায় এল। হ্যাঁ, ওদের ওখানে যাওয়া যেতে পারে। ওর বউ পাকা রাঁধুনি। পুরস্কার পাওয়া রন্ধনশিল্পী। অনেক দিন জুলুর ওখানে যাই না। ওর বউয়ের হাতের খাই না। দেখি ওকে রাজি করাতে পারি কি না। তাহলে খরচাটা হালকার ওপর দিয়ে যাবে।
জুলুকে কল দিই। গলায় একটু জোর দিয়ে বলি, ‘দুপুরে আসছি রে। একেবারে সস্ত্রীক!’
জুলু যেন খানিকটা হকচকিয়ে যায়। দ্বিধা জড়ানো গলায় বলে, ‘অ্যাঁ, আসবি? আচ্ছা, আয়!’
জুলুর সায় পেয়ে মিরাকে বলি, ‘চলো, আজ রন্ধনশিল্পীর হাতের স্পেশাল কারি খেয়ে আসি।’
মিরাও খুশি হয়। জুলু কলব্যাক করে জানতে চায়, ‘তা আজ তোরা কী খাবি? মানে স্পেশাল কোনো ডিশ?’
দাওয়াত নিয়েছি তো সেধে, তাই বেচারাকে খরচের চাপে ফাঁসাতে চাইলাম না। বললাম, ‘লইট্যা শুঁটকির ভুনা হলেই চলবে।’
‘যথা আজ্ঞা।’
লাইন কেটে দিল জুলু। মিরা বলল, ‘লইট্যা শুঁটকি তো তুমি বলতে গেলে প্রায় রোজই খাও। এটা করতে করতে আমার হাত পর্যন্ত শুঁটকি হয়ে গেছে। এখন আবার সেই লইট্যা! অন্য কোনো কিছুর কথা বলতে?’
আমি বলি, ‘আরে, এমনি বলেছি। একজন রন্ধনশিল্পী রাঁধবে। নিশ্চয়ই ১০-১২ পদ থাকবে।’
জুলুদের মহল্লায় কেবল ঢুকেছি, ঠিক এ সময় ওর ফোন। বলে, ‘তুই এখন কোথায়?’
‘তোদের মহল্লায় কেবল ঢুকলাম।’
‘একটা সমস্যা হয়েছে রে!’
ধুকধুকি নিয়ে বলি, ‘কী?’
‘বাসায় লইট্যা শুঁটকি নেই। আমাদের চান মিয়া মার্কেট তো তুই চিনিস। ওখান থেকে ৫০০ গ্রাম লইট্যা নিয়ে আয়। বাসায় এলে টাকা দিয়ে দেব।’
গলায় যেন বরইয়ের বিচি আটকে গেল। এই টাকা গেলে কি আর আসে? চাওয়া যায়, না নেওয়া যায়?
এমন পরিস্থিতিতে আমার মুখ থেকে অনায়াসে ইংরেজি বেরোয়। বললাম, ‘ইটস অলরাইট। নিয়ে আসছি।’
মিরার দিকে না তাকিয়েও বুঝলাম, সে কোন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে।
লইট্যা শুঁটকির প্যাকেটটা সবে হাতে নিয়েছি, এ সময় আবার জুলুর ফোন। না ধরলেই ভালো হতো, কিন্তু এ পর্যায়ে এড়ানো যায় না।
দূরালাপন-যন্ত্রটা কানে ঠেকাতেই জুলু বলল, ‘ওহ্ রে, আরেকটা জিনিস। আধা কেজি রসুনও আনিস। এক কোয়াও নেই বাসায়। রসুন ছাড়া তো আর শুঁটকি ভুনা হয় না।’
‘আচ্ছা।’
জুলুকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে লাইন কেটে দিলাম। মিরা আমার হাতে একটা চিমটি কাটল। কোন চিমটির কী অর্থ, এত দিনে আমি ভালো করেই জানি। ওর মুখের দিকে আর তাকালাম না। রসুন যখন কিনছি, এই সময় আবার ফোন। দেখি, অজানা নম্বর। আমার কোনো ক্লায়েন্ট হবে। ছুটির দিনে ওরাই সাধারণত বেশি ফোন করে।
কানে ঠেকাতেই জুলুর গলা, ‘আমার ওই নম্বরের টাকা শেষ। তাই এটায় ফোন দিলাম।’
‘হুঁ, বল।’
জিরা, গোলমরিচ, শুকনা মরিচ, তেজপাতা—এভাবে একগাদা মসলার নাম বলে গেল জুলু। এগুলো না হলে শুঁটকি ভুনা মোটেও জমবে না। শেষে বলল, ‘এত কিছু যখন আনছিসই, সঙ্গে কেজি দুয়েক নতুন আলু আর কেজি খানেক নতুন টমেটো নিয়ে আসবি। নো চিন্তা, বাসায় এলে টাকাটা দিয়ে দেব!’
রিকশায় মিরা খিটিমিটি করতে চাইলে ওকে বোঝালাম, ভালো কিছু খেতে গেলে একটু-আধটু ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। আর এই বাজার-সওদায় খুব বেশি তো যায়নি।
জুলু ব্যতিব্যস্ত হয়ে আমাদের সাদর অভ্যর্থনা জানাল। মিরা বলল, ‘ভাবি কই, তাঁকে তো দেখছি না!’
জুলু দাঁত বের করে বলল, ‘আর বলবেন না, ভাবি! ওকে আজ এক জায়গায় হায়ারে নিয়েছে। রন্ধনশিল্পী না! তবে চিন্তা নেই। আপনি তো আছেন। রান্নায় আপনিই বা কম কিসে? ইশ্, কত দিন আপনার হাতের রান্না খাই না!’
সূএ: ইন্টারনেট
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.