মৃত্যুই জীবনের অনিবার্য পরিণতি। মরণের এই অনিবার্যতাকে অস্বীকার করতে পারেন না কেউ। কীর্তিমানের মৃত্যু জাতীয় জীবনে তৈরি করে গভীর শূন্যতা। যা কখনো পূরণ হওয়ার নয়। সুন্দর ভুবনে তাদের বেঁচে থাকা প্রয়োজনীয় হলেও অমোঘ সত্যকে মেনে আমাদের উচ্চারণ করতে হয়- ‘যেতে নাহি দিব/ হায়, তবু যেতে দিতে হয়, তবু চলে যায়।’ প্রকৃতির নিয়ম মেনে ২০১৬ সালেও না ফেরার দেশে চলে গেছেন বেশ কয়েকজন কীর্তিমান। যাদের মধ্যে রয়েছেন বরেণ্য সব রাজনীতিক, কবি, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, সংগীতজ্ঞ ও চলচ্চিত্রকার। স্বীয় কর্মক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য যারা রেখেছেন দিগন্তবিস্তৃত অবদান। বাংলাদেশে শিশুচিকিৎসার পথিকৃৎ ‘ফাদার অব পেডিয়াট্রিশিয়ান অ্যান্ড ইন্সটিটিউশন’খ্যাত জাতীয় অধ্যাপক ডা. এম আর খান। ১৯২৮ সালের ১লা আগস্ট সাতক্ষীরায় জন্ম নেয়া এম আর খান কলকাতা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাসের পর এডিনবরা, লন্ডন, ঢাকার বিএসএমএমইউ থেকে একাধিক উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন। বাংলাদেশে শিশু বিভাগের প্রথম অধ্যাপক ড. খান পেনশনের টাকা দিয়ে গড়ে তোলা ডা. এম আর খান-আনোয়ারা ট্রাস্টের মাধ্যমে নিরন্তর কাজ করেছেন দুস্থ মা ও শিশুর স্বাস্থ্যসেবা, তাদের আর্থিক-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে। তার উদ্যোগে গড়ে উঠে জাতীয় পর্যায়ের শিশুস্বাস্থ্য ফাউন্ডেশন, শিশুস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালসহ বহু প্রতিষ্ঠান। তিনি মৃত্যুবরণ করেন ৫ই নভেম্বর। দেশের প্রত্নতত্ত্বচর্চার পথিকৃৎ আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া ৯৭ বছর বয়সে ২৪ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন। এ প্রত্নতত্ত্ব ও পুঁথিসাহিত্য বিশারদ পেশাগত জীবনে ছিলেন শিক্ষা ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব। ২০০৬ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার ও প্রত্নতত্ত্ব গবেষণার জন্য ২০১৫ সালে একুশে পদক পান তিনি। ‘ভাত দে হারামজাদা, তা না হলে মানচিত্র খাবো’র মতো দ্রোহী পঙক্তির কবি রফিক আজাদ চলে গেছেন ১২ মার্চ। রণাঙ্গনের এ মুক্তিযোদ্ধা কবি হিসেবে স্বতন্ত্র অবস্থান গড়েছেন বাংলা কবিতায় এবং অর্জন করেছেন একুশে পদক ও বাংলা একাডেমি পুরস্কার। ‘না, না, তার কথা আর নয়, সেই/বেরিয়েছে সকাল বেলায়/শহীদ কাদরী বাড়ি নেই’। চরণগুলো কিংবদন্তি কবি শহীদ কাদরীরই। বাংলা কবিতার অন্যতম মাইলফলক ‘সোনালী কাবিন’-এর উৎসর্গপত্রে কবি আল মাহমুদ যে তিনজনের কাব্যহিংসা অমর হোক- প্রত্যাশা করেছিলেন তার একজন তিনি। ১৯৪২ সালে কলকাতার পার্ক সার্কাসে জন্ম নেয়া শহীদ কাদরী ২৯শে আগস্ট নিউ ইয়র্কে মৃত্যুবরণ করেন। ১১ বছর বয়সে লেখা প্রথম কবিতা ‘পরিক্রমা’ ও ২৫ বছর বয়সে প্রকাশ পায় প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘উত্তরাধিকার’। কখনো বিপ্লবী, কখনো মানবিক আবার কখনো স্বপ্নচারী এ কবি বার্লিন, বোস্টন হয়ে আমৃত্যু অবস্থান করেছিলেন নিউ ইয়র্কে। কবিতার জন্য তিনি পেয়েছেন একুশে পদক ও বাংলা একাডেমি পুরস্কার। ‘এ বড় দারুণ বাজি, তারে কই বড় বাজিকর/ যে তার রুমাল নাড়ে পরানের গহীন ভিতর’- মতো হৃদয়গ্রাহী পঙ্্ক্তি রচনা করেছিলেন সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক। ১৯৩৫ সালের ২৭শে ডিসেম্বর কুড়িগ্রামে জন্ম নেয়া এ সব্যসাচীর লেখনী সৌরভ ছড়িয়েছে সাহিত্যের সব শাখায়। ‘পরানের গহীন ভেতর’, ‘নিষিদ্ধ লোবান’, ‘খেলা রাম খেলে যা’, ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’, ‘নুরলদীনের সারাজীবন’সহ দুইশতাধিক গ্রন্থের রচয়িতা সৈয়দ হক অর্জন করেছেন স্বাধীনতা পুরস্কার, একুশে পদক ও বাংলা একাডেমি পুরস্কার। নিজের লেখা ‘হায় রে মানুষ রঙিন ফানুস দম ফুরালেই ঠুশ’- গানের মতো চলতি বছরের ২রা সেপ্টেম্বর না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন তিনি। ‘মনের বাগানে ফুটিল ফুল রে’, ‘সোনাবন্ধু তুই আমারে’, ‘পাঞ্জাবি-ওয়ালা’সহ দুই হাজারের বেশি গানের গীতিকার ও সংগীতজ্ঞ আবদুল গফুর হালি মৃত্যুবরণ করেন ২১শে ডিসেম্বর। জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হান্স হার্ডর তাঁকে নিয়ে লিখেছেন দীর্ঘ গবেষণা প্রবন্ধ ‘ডার ফেরুখট গফুর স্পিরখ’। বরণ্য শিক্ষাবিদ প্রফেসর মনিরুজ্জামান মিঞা। ১৯৩৫ সালে ভারতের মুর্শিদাবাদে জন্ম নেয়া মনিরুজ্জামান মিঞা প্যারিস থেকে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের পর ১৯৬৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন এবং ১৯৯০ সালে ভিসি হন। বিএনপি সরকারের সময় তিনি সেনেগালের রাষ্ট্রদূত, জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০১ প্রণয়ন কমিটির চেয়ারম্যান ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কমিশনার ছিলেন। চিরকুমার এ শিক্ষাবিদ ৮৩ বছর বয়সে ১৩ই জুন মৃত্যুবরণ করেন। উপমহাদেশের বিখ্যাত বিপ্লবী ফকির মজনু শাহর উত্তরাধিকারী সাহসী রাজনীতিক আ স ম হান্নান শাহ। ওয়ান ইলেভেনের রাজনৈতিক সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও দলের সংস্কারপন্থি অংশের বিরুদ্ধে ছিলেন উচ্চকণ্ঠ। দুঃসময়ে যিনি অসীম সাহসে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন জিয়া পরিবারের। ১৯৪১ সালের ১১ই অক্টোবর গাজীপুরে জন্ম নেয়া হান্নান শাহ সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন ১৬ই সেপ্টেম্বর। সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামের ব্রিগেড কমান্ডার, চট্টগ্রামের মিলিটারি একাডেমির কমান্ড্যান্টসহ দায়িত্ব পালন করেছেন বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে। সেনাবাহিনী থেকে অবসরের পর বিএনপির রাজনীতিতে যোগ দিয়ে তিনি নানা পদ পেরিয়ে স্থায়ী কমিটির সদস্য ছিলেন আমৃত্যু। দুইবারের সাবেক এ এমপি ছিলেন বিএনপি সরকারের পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী। বাংলাদেশে নারী সাংবাদিকতার অগ্রদূত নূরজাহান বেগম। উপমহাদেশের প্রথম নারী সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘বেগম’-এর সম্পাদক। ৯২ বছর বয়সে চলতি বছরের ২৩শে মে মৃত্যুবরণ করেছেন তিনি। ১৯২৫ সালের ৪ঠা জুন চাঁদপুরে জন্ম নেয়া নূরজাহান বেগম নূরী ছিলেন পিতামাতার একমাত্র সন্তান। মহীয়সী এ নারী সাংবাদিককে ১৯৯৭ সালে রোকেয়া পদকে ভূষিত করে বাংলাদেশ সরকার। বেগম ছিল বাংলায় প্রথম সচিত্র নারী সাপ্তাহিক। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত অভিনেত্রী পারভিন সুলতানা দিতি মস্তিষ্কের ক্যানসারে ভুগে মৃত্যুবরণ করেন ২০ মার্চ। বাংলাদেশের রাজনীতিতে গারো সম্প্রদায়ের কিংবদন্তি প্রতিনিধি প্রমোদ মানকিন। ১৯৩৯ সালের ১৮ই এপ্রিল নেত্রকোনায় জন্ম নেয়া মানকিন স্কুলশিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করলেও পরে আইনের ডিগ্রি নিয়ে আইনজীবী হন। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক মানকিন ১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে ময়মনিসংহ-১ আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হন চারবার। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও পরে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকারী মানকিন ৭৭ বছর বয়সে ১১ই মে চলে গেছেন না ফেরার দেশে। মুক্তিযুদ্ধে জালালপুর সাব-সেক্টরের অধিনায়ক ও সাবেক এমপি মাহবুবুর রব সাদী বীরপ্রতীক। ১৯৪৫ সালের ১০ই মে নবীগঞ্জে জন্ম নেয়া সাদী ষাটের দশকে ছাত্রাবস্থায় সিলেট ও মৌলভী-বাজারে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের একজন সাহসী নেতা ও পরে জাসদের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। নবীগঞ্জ-বাহুবল এলাকার সাবেক এই এমপি ৭৪ বছর বয়সে ১৭ই অক্টোবর মৃত্যুবরণ করেন। একই দিন ৮৯ বছর বয়সে না ফেরার দেশে চলে গেছেন সামপ্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদবিরোধী মঞ্চের সমন্বয়ক এবং দেশের প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা বর্ষীয়ান রাজনীতিক অজয় রায়। ১২ই আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী ফজলুর রহমান পটল। নাটোরের লালপুর-গুরুদাসপুর থেকে নির্বাচিত তিনবারের এ এমপি সমাজকল্যাণ ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সাংবাদিক, অভিনেতা ও রাজনীতিক সাদেক খান মৃত্যুবরণ করেন ১৬ই মে। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের স্পিকার আবদুল জব্বার খানের বড় ছেলে সাদেক খানের ভাইবোনেরা বিভিন্ন সরকারের আমলে মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। পঞ্চাশের দশকে সাংবাদিকতা দিয়ে কর্মজীবন শুরু করলেও সাদেক পরে অভিনয় করেন ‘নদী ও নারী’ চলচ্চিত্রে। ২০১২ সালে ‘বাংলাদেশ গণশক্তি দল’ নামে নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠনের ঘোষণা দেন তিনি। ১লা জুন না ফেরার দেশে চলে যান প্রখ্যাত সাংবাদিক ফাহিম সৈয়দ মুনএম। দৈনিক সংবাদ, ডেইলি স্টার, বার্তা সংস্থা ইউএনবি’র সাবেক এ ব্যবস্থাপনা সম্পাদক মৃত্যুকালে মাছরাঙা টেলিভিশনের প্রধান ছিলেন। রাজনীতিকদের মধ্যে ১৫ই জানুয়ারি বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী বিজ্ঞানী ড. আর এ গনি, খুলনার সাবেক মেয়র শেখ তৈয়বুর রহমান, ২৩শে জানুয়ারি ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ নেতা এমএ আজিজ, ৩০শে জানুয়ারি জাতীয় পার্টির সাবেক এমপি মজিবর রহমান, ২রা মে আওয়ামী লীগে সরকারের সাবেক স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী মজিবুর রহমান ফকির ও একই দিন রাজশাহীর বিএনপি দলীয় সাবেক এমপি আজিজুর রহমান, ২৫শে আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বাদী এএফএম মুহিতুল ইসলাম, ৫ই সেপ্টেম্বর মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক আবদুর রহিম এমপি, ৬ই নভেম্বর সাবেক প্রতিমন্ত্রী জিয়াউল হক জিয়া, ১৭ই নভেম্বর মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা এসএম ইউসুফ মৃত্যুবরণ করেন। কবি-সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, শিল্পী ও সাংবাদিকদের মধ্যে ২২শে জানুয়ারি সংগীত পরিচালক খন্দকার নুরুল আলম, ২৪শে জানুয়ারি বিএফইউজে সভাপতি আলতাফ মাহমুদ ও চলচ্চিত্র প্রযোজক কেএমআর মঞ্জুর, ১৩ই ফেব্রুয়ারি অসংখ্য কালজয়ী গানের সুরকার রবীন বোস, ২৬শে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের দ্বিতীয় গভর্নর একে নাজিরউদ্দিন আহমেদ, ৪ঠা মার্চ চলচ্চিত্র সাংবাদিক হারুনুর রশীদ খান, চিত্রশিল্পী ও জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত নির্মাতা খালিদ মাহমুদ মিঠু, ৪ঠা এপ্রিল চলচ্চিত্রকার শহীদুল ইসলাম খোকন, ৬ই আগস্ট লালনশিল্পী রব ফকির, ২২শে আগস্ট মুক্তিযোদ্ধা অভিনেতা ফরিদ আলী, ২রা অক্টোবর রূপসজ্জা শিল্পী মোহাম্মদ ফারুক, ১৬ই নভেম্বর কথাসাহিত্যিক ড. ফজলুল আলম, ২৪শে নভেম্বর অভিনেতা গোলাম হাবিবুর রহমান মধু ও ৭ই ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব মাহবুবুল হক শাকিল মৃত্যুবরণ করেন। এছাড়া ১২ই ডিসেম্বর মানবজমিনের স্টাফ রিপোর্টার হবিগঞ্জের আমির হোসেন, ২৬শে আগস্ট মানবজমিন মংলা প্রতিনিধি আবুল কালাম আজাদ, ৪ঠা নভেম্বর মানবজমিন পাকুন্দিয়া প্রতিনিধি মানিক আহমেদ ও ২৯শে ডিসেম্বর মানবজমিন বানিয়াচং প্রতিনিধি আখলাক হোসেন খেলু মৃত্যুবরণ করেছেন।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.