প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে এই ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত নতুন নয়। ১৯৭২ থেকে ৭৪ সাল পর্যন্ত সাতজন এমপিকে মারা হয়েছে। জোট সরকারের আমলেও সংসদ সদস্য শাহ এ এম এস কিবরিয়া ও আহসান উল্লাহ মাস্টারকে হত্যা করা হয়েছে। এভাবে বিভিন্ন সময়ে ষড়যন্ত্রকারীরা পরিকল্পিতভাবে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীকে হত্যা করেছে। এদিকে সংসদ সদস্যদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে দাবি জানিয়েছেন ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়া। জাতীয় সংসদ ভবনে সোমবার গাইবান্ধা-১ আসনের সংসদ সদস্য মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনের জানাজা শেষে একই জেলার আরেক আসনের এই সাংসদ সাংবাদিকদের এ কথা জানান। ফজলে রাব্বী বলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে সব সংসদ সদস্যের ব্যক্তিগত নিরাপত্তার কথা জানিয়েছি। প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয় আমাদের সঙ্গে একমত পোষণ করে এমপিদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তায় গানম্যানের ব্যবস্থা করবেন।’ খ্রিস্টীয় বছরের শেষ দিন সন্ধ্যা রাতে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে ক্ষমতাসীন দলের এমপি লিটনকে তার বাড়ির বৈঠকখানায় ঢুকে গুলি করে পালিয়ে যায় আততায়ীরা। রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পর তার মৃত্যু হয়। এর আগে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে বিরোধী দলে থাকার সময় গুলি করে ও গ্রেনেড হামলা চালিয়ে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যকে হত্যা করা হয়। ২০০৪ সালের ৭ মে গাজীপুরের টঙ্গীর নোয়াগাঁও এম এ মজিদ মিয়া উচ্চবিদ্যালয় মাঠে এক জনসভায় এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে শ্রমিক নেতা ও গাজীপুরের সাংসদ আহসান উল্লাহ মাস্টারকে হত্যা করা হয়। পরের বছরই ২৭ জানুয়ারি হবিগঞ্জ সদরের বৈদ্যের বাজারে ঈদপরবর্তী এক জনসভা শেষে বের হওয়ার পথে গ্রেনেড হামলায় নিহত হন আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া। দুটি হত্যাকা-ের মামলায় প্রধানত বিএনপি নেতাদের আসামি করা হয়। এর মধ্যে আহসান উল্লাহ মাস্টারকে হত্যা মামলায় নিম্ন আদালত পেরিয়ে হাই কোর্টের রায়ে বিএনপি নেতা নুরুল ইসলাম সরকারসহ ছয়জনের মৃত্যুদ- বহাল রয়েছে। অন্যদিকে কিবরিয়া হত্যার ঘটনায় অভিযোগপত্রভুক্ত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, সিলেট সিটি করপোরেশনের সাময়িক বরখাস্ত হওয়া মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী, হবিগঞ্জ পৌরসভার সাময়িক বরখাস্ত হওয়া মেয়র ও জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক জি কে গউছ ও হুজি নেতা মুফতি আব্দুল হান্নানসহ মোট ৩২ জনের বিচার চলছে। লিটনকে কারা মেরেছে, সেই বিষয়ে এখনো স্পষ্ট তথ?্য জানাতে পারেনি পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদের জন?্য সন্দেহভাজন ১৮ জনকে আটক করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। লিটনের বোন রোববার রাতে অজ্ঞাতনামা পাঁচজনকে আসামি করে সুন্দরগঞ্জ থানায় একটি মামলা করেছেন। আওয়ামী লীগের নেতারা এই হত?্যাকা-ের পেছনে জামায়াতে ইসলামীর হাত রয়েছে বলে সন্দেহ করলেও দলটি তা অস্বীকার করে পাল্টা অভিযোগ করেছে, প্রকৃত খুনিদের আড়াল করতেই তাদের ওপর দোষ চাপানো হচ্ছে। সোমবার সংসদ ভবনের জানাজার আগে গাইবান্ধা-৫ আসনের সংসদ সদস্য ফজলে রাব্বী মিয়া বলেন, ‘অপরিণত বয়সে লিটনের মৃত্যু হয়েছে। এটা জামায়াত-শিবিরের চক্রান্ত। গোলাম আযমকে সুন্দরগঞ্জের মাটিতে নামতে দেয়নি লিটন। এই দোষের শিকার হলো লিটন।’ সংসদ সদস্যদের নিরাপত্তায় গানম্যানের ব্যবস্থা করা হবে কিনা এই প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুব-উল-আলম হানিফ সাংবাদিকদের বলেন, ‘জনপ্রতিনিধিদের তাদের নির্বাচনী এলাকায় যেতে হয়। বিভিন্নভাবে জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে হয়। এজন্য জনপ্রতিনিধিদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।’
লিটনের জানাজা ও প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা দুর্বৃত্তের গুলিতে নিহত গাইবান্ধার সংসদ সদস?্য মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনের জানাজা হয়েছে সংসদ ভবন প্রাঙ্গণে। সোমবার সকালে জানাজার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের নেতারা দলের এই সংসদ সদসে?্যর কফিনে ফুল দিয়ে শেষ শ্রদ্ধা জানান। রংপুর থেকে হেলিকপ্টারে করে রোববার লিটনের লাশ আনা হয় ঢাকায়। হাসপাতালের হিমঘর থেকে সোমবার সকালে কফিন নেয়া হয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায়। সেখানে জানাজায় অংশ নেন ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়া, জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক, নৌ-পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, বস্ত্র প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজমসহ মন্ত্রিসভার সদস্যরা। সংসদের প্রধান হুইপ আ স ম ফিরোজ, সংসদ সদস?্য মাহাবুব-উল আলম হানিফ, জাহাঙ্গীর কবির নানক, ইকবালুর রহিম, বি এম মোজাম্মেল হক ও শামীম ওসমানসহ আওয়ামী লীগ নেতারাও জানাজায় উপস্থিত ছিলেন। জানাজার আগে লিটনের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বক্তব্য রাখেন চিফ হুইপ আ স ম ফিরোজ, লিটনের ভগি্নপতি আবদুল্লাহ হিল বারী, মাহাবুব-উল আলম হানিফ এবং ফজলে রাব্বী মিয়া। জানাজা শেষে রাষ্ট্রপতির পক্ষে তার সামরিক সচিব মেজর জেনারেল সারোয়ার হোসেন প্রয়াত এই সাংসদের কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গাইবান্ধা-১ আসনে দলীয় এই সংসদ সদস্যের কফিনে ফুল দিয়ে কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন। প্রধানমন্ত্রীর পর স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী প্রয়াত এই সংসদ সদস্যের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। স্পিকারের পর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে নিয়ে লিটনের কফিনে ফুল দেন শেখ হাসিনা। কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি এ সময় উপস্থিত ছিলেন। এরপর ফুল দেন ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়া এবং প্রধান হুইপ আ স ম ফিরোজ। শ্রদ্ধা নিবেদনের পর প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত এই সংসদ সদস্যের পরিবারের সদস্যদের সান্ত্বনা দেন।
বাবা-মায়ের পাশে শায়িত এমপি লিটন গাইবান্ধা প্রতিনিধি জানান, অজ্ঞাত হামলাকারীর গুলিতে নিহত গাইবান্ধা-১ (সুন্দরগঞ্জ) আসনের এমপি মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনের মরদেহ নিজ বাড়িতে দাফন করা হয়েছে। জানাজা শেষে সোমবার বেলা পৌনে ৫টার দিকে সুন্দরগঞ্জের সর্বানন্দ ইউনিয়নের শাহাবাজ গ্রামে পারিবারিক কবরস্থানে বাবা মায়ের কবরের পাশে তাকে শেষ শয্যায় শায়িত করা হয়। ঢাকা থেকে মরদেহ বাড়িতে পৌঁছার পর নিজ বাড়ির প্রাঙ্গণে বিকাল ৩টা ৫৫ মিনিটে তৃতীয় দফা নামাজে জানাজা হয়। রোববার রংপুর পুলিশ লাইনে এ সাংসদের প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর সোমবার জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় হয় দ্বিতীয় জানাজা।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.