গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় হামলায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত, এমন ১৭ জনকে এখন পর্যন্ত চিহ্নিত করেছে মামলার তদন্তকারী সংস্থা ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি)। এঁদের মধ্যে ১৩ জন গত ছয় মাসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন অভিযানে নিহত হয়েছেন। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে নিহত হন নুরুল ইসলাম ওরফে মারজান। একজন গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন। বাকি তিনজন হলেন রাজীব ওরফে রাজীব গান্ধী ওরফে জাহাঙ্গীর, বাশারুজ্জামান ওরফে চকলেট ও সাগর। রাজীব ও বাশারুজ্জামানকে দ্রুত আইনের আওতায় আনা সম্ভব হবে বলে আশাবাদী পুলিশ। কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের কর্মকর্তারা বলেন, এঁদের মধ্যে রাজীব গুলশান হামলার জন্য বগুড়ার দুজন জঙ্গিকে নিয়োগ করেন। হামলার আগ দিয়ে ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ভাড়া বাসায় থেকে হামলায় যুক্ত জঙ্গিদের উদ্বুদ্ধ করেন। সাগর সীমান্তের ওপার থেকে আসা অস্ত্র ঢাকায় মারজানের কাছে পৌঁছান, যা পরে হামলাকারীরা ব্যবহার করেন। আর সফটওয়্যার প্রকৌশলী বাশারুজ্জামান মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশ থেকে দুই দফায় হুন্ডির মাধ্যমে আসা ২০ লাখ টাকা গ্রহণ করেন। সেই টাকা গুলশান হামলার কাজে ব্যবহৃত হয়। বাশারুজ্জামানের স্ত্রী শায়লা আফরিন, মারজানের স্ত্রী প্রিয়তি ও তানভীর কাদেরীর স্ত্রী আবেদাতুন ফাতেমা আজিমপুরের জঙ্গি আস্তানা থেকে গ্রেপ্তার হন। স্ত্রীদের জিজ্ঞাসাবাদ করেও অনেক তথ্য পাওয়া গেছে বলে জানান তদন্ত-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। কাউন্টার টেররিজম বিভাগের (সিটি) একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চিহ্নিত এই ১৭ জনের মধ্যে পাঁচজন গুলশান হামলায় সরাসরি অংশ নেন। বাকিরা হামলার পরিকল্পনা, সমন্বয়, প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্র-বোমা সংগ্রহসহ বিভিন্ন পর্যায়ে জড়িত ছিলেন। পুলিশ বলছে, এঁরা সবাই ‘নব্য জেএমবি’র সঙ্গে যুক্ত। জানতে চাইলে মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের উপকমিশনার মোহাম্মদ মহিবুল ইসলাম খান বলেন, গুলশান হামলায় জড়িত ব্যক্তিদের শনাক্ত করা হয়েছে। মূল পরিকল্পনাকারীসহ বিভিন্ন পর্যায়ের জড়িত অনেকেই ইতিমধ্যে পুলিশের বিভিন্ন অভিযানে নিহত হয়েছেন। পলাতক আসামিদের মধ্যে রাজীব গান্ধী ও বাশারুজ্জামানকে দ্রুত গ্রেপ্তার করা যাবে বলে তিনি আশাবাদী। তদন্ত-সংশ্লিষ্ট কাউন্টার টেররিজমের কর্মকর্তারা বলছেন, গুলশানে হামলার মূল সমন্বয়ক ও পরিকল্পনাকারী ছিলেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডার নাগরিক তামিম চৌধুরী। তাঁর সঙ্গে পরিকল্পনা ও সমন্বয়ে যুক্ত ছিলেন নুরুল ইসলাম ওরফে মারজান। যোগাযোগ সমন্বয়ক ছিলেন তাওসিফ হোসেন। হলি আর্টিজানে দেশি-বিদেশি নাগরিকদের নৃশংসভাবে হত্যার পর ভেতর থেকে তাঁদের ছবি তুলে মারজানের কাছে পাঠান জঙ্গিরা। মারজান সেসব ছবি পাঠান তামিম চৌধুরীর কাছে। তামিম ওই সব ছবি আইএসের কথিত বার্তা সংস্থা আমাক নিউজে পাঠান, যা ওই রাতে ইন্টারনেটে প্রচার পায়। তামিম ও তাওসিফ গত বছরের ২৭ আগস্ট নারায়ণগঞ্জে পুলিশের অভিযানে নিহত হন। মারজান নিহত হন গত বৃহস্পতিবার গভীর রাতে ঢাকায় এক ‘বন্দুকযুদ্ধে’। কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের কর্মকর্তারা জানান, গুলশান ও শোলাকিয়ায় হামলায় জড়িত জঙ্গিদের গাইবান্ধার চরে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন অবসরপ্রাপ্ত মেজর জাহিদুল ইসলাম ওরফে মুরাদ, রায়হান ইবনে কবির ও রাকিবুল হাসান ওরফে রিগ্যান। এঁদের মধ্যে মেজর জাহিদ গত বছরের ২ সেপ্টেম্বর রূপনগরে ও রায়হান ২৬ জুলাই ঢাকার কল্যাণপুরে অভিযানে নিহত হন। রিগ্যান কল্যাণপুরের অভিযানে আহত অবস্থায় গ্রেপ্তার হন। পরে গুলশান হামলার ঘটনায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। কল্যাণপুরে নিহত আরেক জঙ্গি আবু নাঈম হাকিম গুলশান হামলার অস্ত্র সংগ্রহে যুক্ত ছিলেন বলে পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন। ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের কর্মকর্তা তানভীর কাদেরী (১০ সেপ্টেম্বর আজিমপুরে অভিযানে নিহত) ও ফরিদুল ইসলাম ওরফে আকাশ (গত ৮ অক্টোবর গাজীপুরে নিহত) গুলশান হামলায় জড়িত জঙ্গিদের থাকার জন্য ঢাকার বিভিন্ন স্থানে বাসা ভাড়া করেছিলেন। হামলায় জড়িত পাঁচ জঙ্গি সর্বশেষ ছিলেন বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় তানভীর কাদেরীর বাসায়। ওই বাসা থেকেই ওঁরা হলি আর্টিজানে গিয়ে আক্রমণ করেন। তানভীর কাদেরীর এক কিশোর ছেলে আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতেও একই তথ্য দিয়েছে। গুলশান হামলায় সরাসরি অংশ নেওয়া পাঁচ জঙ্গি হলেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, স্কলাসটিকার ছাত্র মীর সামেহ মোবাশ্বের, মোনাশ ইউনিভার্সিটির মালয়েশিয়া ক্যাম্পাসের ছাত্র নিবরাস ইসলাম এবং বগুড়ার শফিকুল ইসলাম ওরফে উজ্জ্বল ও খায়রুল ইসলাম ওরফে পায়েল। এঁরা সবাই পরদিন সকালে সেনা কমান্ডোদের অভিযানে নিহত হন। গত বছরের ১ জুলাই রাতে জঙ্গিরা গুলশানে হলি আর্টিজানে হামলা চালিয়ে ২০ জন দেশি-বিদেশি নাগরিককে নৃশংসভাবে হত্যা করেন। তাৎক্ষণিক অভিযান চালাতে গিয়ে জঙ্গিদের বোমায় নিহত হন পুলিশের দুজন কর্মকর্তা। পরদিন সকালে জিম্মি উদ্ধার অভিযানে পাঁচ জঙ্গির সঙ্গে ওই রেস্তোরাঁর পাচক সাইফুল ইসলাম চৌকিদার নিহত হন। রেস্তোরাঁর ভেতর থেকে আটক আরেক কর্মী জাকির হোসেন পরে হাসপাতালে মারা যান। হামলা বা জঙ্গিদের সঙ্গে হলি আর্টিজানের এই দুই কর্মীর সম্পৃক্ততার কোনো তথ্য এখন পর্যন্ত তদন্তকারীরা পাননি বলে জানা গেছে। ইরাক ও সিরিয়াভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস (ইসলামিক স্টেট) এই হামলার দায় স্বীকার করলেও পুলিশ তা নাকচ করে দিয়েছে। তদন্ত-সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেন, আসামিরা প্রায় সবাই শনাক্ত হলেও খুব শিগগির গুলশান হামলা মামলার অভিযোগপত্র দেওয়ার সম্ভাবনা নেই। বিপুলসংখ্যক সাক্ষীর ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬১ ধারায় সাক্ষ্য গ্রহণ, জব্দকৃত বিপুল পরিমাণ আলামতের ফরেনসিক পরীক্ষা ও নিহত ব্যক্তিদের ডিএনএ প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে অভিযোগপত্র প্রস্তুত করতে আরও সময় প্রয়োজন আছে। এরই মধ্যে উদ্ধার হওয়া ১৪ জন জিম্মি এই মামলার সাক্ষী হিসেবে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.