ইউরোপে কুটির শিল্পের জন্ম শিল্পায়নের গোড়ার দিকে৷ তারপর শিল্পায়ন আর পর্যটন শিল্পের দ্বিবিধ চাপে কুটির শিল্প হয়ে দাঁড়ায় হস্তশিল্প৷ হাল আমলে হস্তশিল্পের আধুনিকীকরণের দায়িত্ব নিয়েছে কারিগরী শিক্ষাকেন্দ্রগুলি৷
অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইউরোপের গ্রামাঞ্চলে জনসংখ্যা যেভাবে বাড়তে থাকে, তা থেকেই গ্রামীণ শিল্পের প্রবৃদ্ধি হয়৷ অন্যভাবে বলতে গেলে, চাষির ঘরে যে পরিমাণ সন্তান জন্মগ্রহণ করছিল, তাদের সকলের জন্য পর্যাপ্ত চাষের কাজ ছিল না৷ গ্রামের মানুষও বাড়তি রোজগারের সুযোগ পেলে ছাড়বেন কেন? কৃষিকাজ প্রধানত মৌসুমি হওয়ার ফলে, যাদের ক্ষেতখামারে বাঁধা কাজ ছিল, তাদের হাতেও প্রচুর সময় উদ্বৃত্ত থাকত৷ শহরের পুঁজিবাদিরা এই বাড়তি শ্রমিকদের আঁচ পেয়ে দেখেন যে, শহুরে শ্রমিকদের চেয়ে কম পারিশ্রমিকে এই গ্রামীণ শ্রমিকদের কাজে লাগানো যায়৷ তা থেকে যে গ্রামীণ শিল্পের সৃষ্টি তারই নাম কুটির শিল্প৷
শহুরে ব্যবসায়ী হয়ত কোনো খামারচাষির কাছে পশম কিনে, কয়েকটি চাষি পরিবারকে দিয়ে সুতো কাটিয়ে, সেই সুতো রং করিয়ে ইত্যাদি একাধিক পদক্ষেপে গ্রামের কাঁচামালকে শহরের কাঁচামালে পরিণত করতেন এই ‘পুটিং-আউট’ পদ্ধতিতে৷ তুলোর ক্ষেত্রে সুতো কাটার পরে আসত তাঁত বোনা৷ ব্যবসায়ী কাঁচামাল আর দাদন দিয়ে খালাস; পরে তৈরি পণ্য শহরে বিক্রির দায়িত্বও হতো ব্যবসায়ীর৷
গ্রামীণ বস্ত্রশিল্প
এভাবেই কুটিরশিল্প থেকে গড়ে ওঠে এক গ্রামীণ বস্ত্রশিল্প, যার মূল সমস্যা ছিল সংগঠনের অভাব৷ বিভিন্ন কারিগরি বা হাতের কাজের পেশার শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ, অনুমোদন ও তাদের কাজের মান নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণের জন্য ইউরোপে বহুকাল ধরে তথাকথিত ‘গিল্ড’ বা সমবায় সংঘগুলি ছিল৷ গ্রামীণ শ্রমিকদের উপর এই পেশাদারি সমবায় সংঘগুলির কোনো নিয়ন্ত্রণই ছিল না৷ অন্যদিকে যে ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা গাঁয়ের শ্রমিকদের দাদন দিচ্ছেন, তাদের উপরেও ‘গিল্ড’-গুলির কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না৷ কাজেই গ্রামীণ বস্ত্রশিল্পে বাঁধা ওজন, কিংবা গাঁটরির সাইজ ইত্যাদি নির্দ্দিষ্ট করার মতো কেউ ছিল না৷ কাজেই ঝগড়াঝাঁটি লেগেই থাকত৷ পণ্যের মানও খুব ভালো হতো না৷ মাইনে হাতে পেয়ে শ্রমিকরা দিন দু’য়েক ‘জিরিয়ে’ নিতেন৷ অর্থাৎ তথাকথিত কুটিরশিল্পের অনেক সুবিধা ও অসুবিধা এই গ্রামীণ বস্ত্রশিল্পেও ছিল৷
আজকের কুটিরশিল্প
আজ জার্মানিতে বা অস্ট্রিয়াতে কুটিরশিল্প বলতে যা বোঝায়, তা হলো হাতের কাজ – ঘড়ি তৈরি থেকে শুরু করে ঝুড়ি বোনা কিংবা কাঠ খোদাইয়ের কাজ যার মধ্যে পড়বে৷ জার্মানির সব পর্যটকপ্রিয় অঞ্চলেরই কিছু কিছু নিজস্ব হাতের কাজ আছে, যা টুরিস্টদের কাছে বিভিন্ন ‘সুভেনির’-এর দোকানে বিক্রি করা হয়ে থাকে৷
মনে রাখতে হবে, সুভেনির বলতেই যে কিছু হাতের কাজ হবে, এমন নয়৷ কোনো পরিচিত জায়গার সুভেনির বা স্মৃতিচিহ্ন এখন ফুটবল ক্লাবগুলির মার্চেন্ডাইজিং-র মতো হয়ে গেছে: কোলোনের সুবিখ্যাত ক্যাথিড্রাল থেকে শুরু করে বার্লিনের মতো রাজধানী শহর, সকলেই এভাবে টুরিস্টদের কাছে সুভেনির বেচে থাকে৷ এই সুভেনিরের ব্যবসা আজ কুটিরশিল্পের আওতা ছাড়িয়ে বাণিজ্যিকতার অন্য একটা পর্যায়ে চলে গেছে৷
বলতে কি,কুটিরশিল্পই কুটির ছাড়িয়ে কবে ছোটবড় কারখানা ও উদ্যোক্তাদের হাতে চলে গেছে – অথবা যাচ্ছিল, যদি না জার্মান সরকার কিংবা অস্ট্রিয়ান সরকারের মতো সরকারবর্গ ‘ট্রেড স্কুল’, অর্থাৎ কারিগরি শিক্ষাকেন্দ্র তৈরি করে সেই প্রবণতাকে কিছুটা বাঁধ দেবার চেষ্টা করতেন৷ এভাবে কুটিরশিল্প ‘সংস্কারের’ যে প্রচেষ্টা করা হয়েছে, তা হল এই যে, তরুণ বা উঠতি কারিগররা তাদের প্রথাগত পণ্যগুলিকে আরো আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য আধুনিক ডিজাইন শৈলীতে প্রশিক্ষণ পাবেন৷ পটারি বা মৃৎশিল্পে জার্মানির কার্লসরুহে শহরের সরকারি চারুকলা বিদ্যালয়, অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনার ‘গেভ্যার্বে’ বা ট্রেড মিউজিয়াম, অথবা ইটালির রিভায় কাঠ খোদাই-এর স্কুল এই প্রবণতার উৎকৃষ্ট নিদর্শন৷
দেশ থেকে দেশে ছড়াচ্ছে এই প্রবণতা৷ সুইজারল্যান্ডের দক্ষিণ টিরোল এলাকার মানুষেরা অলিভ কাঠ দিয়ে রান্না করতেন৷ পরে প্রতিবেশী ইটালির দেখাদেখি তারা অলিভ কাঠ কুঁদে নানা ধরনের জিনিসপত্র বানাতে শিখলেন – যার আজ বিশ্বজোড়া চাহিদা৷
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.