একদিনে কোনো কিছু হয়ে ওঠে না। তারপর যদি ভালো কিছু করার লক্ষ্য থাকে। এদের ক্ষেত্রেও তাই হলো। সারাটি মাস মহড়া চলল। একবেলা নয়। কোনো কোনো দিন দুবার। প্রস্তুতির প্রতিটি খণ্ডাংশই যেন এক একটি আসর। এমনি করে তারা মঞ্চে এলেন মাসের শেষে।
গত ২৯ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার রাজধানী আবুধাবির কেন্দ্রে কনফারেন্স হলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন পরিষদ, আবুধাবির কর্মীরা এক মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। পরিষদ এ ক্ষেত্রে একটি ঐতিহ্য নির্মাণ করেছে। এবারও সংগঠনটি এর দীর্ঘদিনের সুনামটি অক্ষুণ্ন রাখতে পেরেছে। কর্মীরা এদিন প্রকৃত অর্থেই বর্ণাঢ্য, সুন্দর ও সুশৃঙ্খল একটি সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা উপহার দেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে নয় মাস যুদ্ধ পরিচালনা করার পর মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর কাছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। দিনটি ছিল ১৬ ডিসেম্বর, সাল ১৯৭১। সেই থেকে বাঙালি জাতি ডিসেম্বর মাসটি বিজয়ের মাস হিসেবে পালন করে আসছে। এই অনুষ্ঠান ও আয়োজন তারই ধারাবাহিকতা। শুরুতে অতিথিরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ওপর তাৎপর্যপূর্ণ বক্তব্য প্রদান করেন। সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে অধ্যাপক এস এম আবু তাহের বাংলাদেশ অভ্যুদয়ের শুরুর প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকে নতুন প্রজন্মের সামনে সঠিকভাবে উপস্থাপনের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। পরবর্তী প্রজন্মকে গড়ে তুলতে পারলেই কেবল আমাদের ত্যাগ অর্থপূর্ণ হয়ে উঠবে বলে তিনি তার বক্তব্যে উল্লেখ করেন।
প্রকৌশলী প্রবোধ কুমার সরকার বলেন ভিন্নভাবে ভিন্নকথা। তিনি তার বুক ফোলা আশার বাণী ব্যক্ত করেন। বলেন, যা কিছু সুন্দর কল্যাণকর তাই যেন হয় আমাদের। অনুষ্ঠানে ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা থেকে আগত পরিষদের প্রিয় বন্ধু সঞ্জয় দত্ত। বলেন, একাত্তরে ভারত বাংলাদেশের পক্ষে যুদ্ধ করেছে সেই সত্যটি তিনি পুনর্বার উপলব্ধি করেন আজ। প্রিয় এই অতিথি অনুষ্ঠান আয়োজনের উদ্যোক্তাদের ধন্যবাদ জানান। পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ খোরশেদ সূচনা বক্তব্যে অতিথিদের স্বাগত জানান। এ পর্ব সঞ্চালনা করেন আজিম ফজলুল কাদের। অনুষ্ঠানের শেষের পর্যায়ে সঞ্চালককে ভালোবাসার উত্তরীয় পরিয়ে দেওয়া হয়। গুণ, কর্ম ও যোগ্যতার ওপর ভিত্তি করে পরিষদের ভেতরকার কিংবা বাইরে একজনকে প্রায় প্রতিটি আয়োজনেই সম্মানিত করা হয়। এবার মর্যাদার এ জায়গাটি ছিল সংগঠনের সাধারণ সম্পাদকের। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন পরিষদের পক্ষে তাকে উত্তরীয় পরিয়ে দেন নিমাই সরকার। এ সময় দুই বন্ধুর সঙ্গে তাদের দুই সহধর্মিণী ছিলেন। সেলফি, ক্যামেরার ক্লিকে তখন পরিবেশ আলোকময় হয়ে ওঠে। আনন্দের ঝড় ওঠে চরাচরে। চমৎকার চমৎকার বলে সারা পড়ে যায়।
জয় বাংলা বাংলার জয়। শিল্পীরা একযোগে গেয়ে ওঠেন গানটি। সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার শুরুটাই ছিল তাক লাগানো। মন জুড়ানো গানে মিশে যান শ্রোতারা। কী ভীষণ উত্তেজনা! জয় মনের মধ্যে, জয় চোখে মুখে। জোরের সঙ্গে হারমোনিয়ামের ব্লোয়ার চাপছেন ঊর্মি হাওলাদার। তিনি সাংস্কৃতিক পর্বের পরিচালক। এদিকে তবলায় খই ফোটাচ্ছেন সজল হালদার। সব কণ্ঠ, সব সুর, সব তাল মিলে যায় এক স্রোতে। হৃদয়ের কী আকুলতা। প্রিয় জন্মভূমি, প্রাণের মায়ের জয় কে না চায়! মোস্তাকিম রাহী কামনা করেন, এই মাসটি যেন সব কালে সব সময় ভরে ওঠে গানে গানে। প্রাণে প্রাণে তারই স্পন্দন পাওয়ার ব্যগ্রতা তার কণ্ঠে। স্বপ্নপথ নামের সামাজিক সংগঠনের নাসির জোসি বলেন, জনগণ একটি প্রতিকূলতাকে জয় করে আরেকটা সমস্যার সম্মুখীন হয়। তিনি যোগ করেন, এরই মধ্য দিয়ে অর্জিত হয় তার প্রত্যাশিত বিজয়। আয়োজনে ফুলেল শুভেচ্ছা জানানো হয় পশ্চিমবঙ্গের প্রাণের অতিথি রুমকি দাসকে। চলে সম্মিলিত কিংবা একক কণ্ঠের গান। অনুষ্ঠান আয়োজনের এ পর্বে প্রকৌশলী সুব্রত হালদার, প্রকৌশলী পার্থ কুণ্ডু, ছবিয়াল বোরহান, খোরশেদ মাসুদ, মঞ্জুরুল আলম, সজীব চৌধুরী, মোজাম্মদ দিদার ও মোহাম্মদ তোহা সবাইকে শুভেচ্ছা জানান। ভালোবাসা ঢেলে দেন প্রকৌশলী সুজন পাল, সোহেল পারভেজ ও কমল পাল। ছড়ার গান নিয়ে আসে মাহিয়া। দেশাত্মবোধক গান গায় সাকিন। মেতে ওঠে আসর। আসে প্রকৃতির কন্যা মিথি। রবীন্দ্রসংগীতের সুরে নাচে সে। ছড়া পড়ে দোয়া ও মাহরুখ। তাদের মা শাহিদা আরবি এ সময় ছোটদের সঙ্গে ছিলেন। সংগঠকের ভূমিকায় ছিলেন আরেক তরুণী মা সাইমুন নাজনীন। অনুষ্ঠানে মানে ছোট্টমণিরা। এদিনও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। প্রত্যয়, স্বীকৃতি, সোফিয়া, রিও আয়োজনে আনন্দের সময় কাটায়। অধ্যক্ষ মীর আনিসুল হাসান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নকে টেলিফোনে শুভেচ্ছা জানান। এতে তিনি বলেন, আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ন্যায় ও মানবিক বোধের সম্মেলন ছিল। এই দিক থেকে বলা যায়, আমাদের যুদ্ধ মহাকাব্যিক দ্যোতনা পেয়েছে। আর এটিই হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা। এই অনুষ্ঠানে তার থাকার কথা ছিল। ওই দিনই চোখের জরুরি অস্ত্রোপচার হয় বলে তিনি আসতে পারেননি। সংগঠনের সাবেক সভাপতি উত্তম কুমার হাওলাদারও ওই সন্ধ্যায় অনুষ্ঠানের সাফল্য কামনা করে ফোনে কথা বলেন। অনিবার্য কারণে তাকে বাংলাদেশে একদিন বেশি থাকতে হয়।
মঞ্চে দেশাত্মবোধক গান চলছিল। সেখানে সংগীত পরিবেশন করেন পরিচালক উপস্থাপক ছাড়াও লাকি হালদার উল্কা, রুমিজা সুলতানা দীপু, মলি কুণ্ডু ও ইন্দিরা পাল কলি। সাংস্কৃতিকসন্ধ্যা উপস্থাপন করেন মিতা কুণ্ডু। আয়োজনে কানাডার ওয়াটার লু বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার কৌশল বিভাগের ছাত্র রাজীব সরকার এসেছিলেন প্রাণের টানে। তখন ছুটিতে তিনি আবুধাবিতেই ছিলেন। সঙ্গে এসেছিলেন তার মা বকুল রানি। অন্যদিকে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক মেধাবী শিক্ষার্থী ত্রিদিব পাল অনুষ্ঠানে না থাকতে পেরে আফসোস প্রকাশ করেন। তার মা সুবর্ণা পাল বিমানবন্দর থেকে ইলেকট্রন বার্তায় তথ্যটি জানান। অনুষ্ঠান চলাকালে ত্রিদিব কানাডার উদ্দেশে বিমানে ওড়েন। আফসোস প্রকাশ করে পরিষদের তথ্যবিষয়ক উপদেষ্টা পূর্বা। দ্বাদশ শ্রেণির নির্বাচনী পরীক্ষার কারণে তারও উপস্থিত থাকা সম্ভব হয়নি অনুষ্ঠানে। উল্লেখ্য, অনুষ্ঠান আয়োজনে আনুষঙ্গিক কাজে তার যোগ ছিল ষোলো আনা। গান, নাচ, গান—এইভাবে চলতে থাকে। জনপ্রিয় ধারার দেশাত্মবোধক গানের সুরে নাচে উর্নিশা হাওলাদার। একপর্যায়ে মৃত্তিকা কন্যার হাতে উড়ে বাংলাদেশের পতাকা। শাস্ত্রীয় ধারা ওডিশি আর কত্থক আঙ্গিকের ছিল দুই নৃত্য। মঞ্চে কুন্দন মুখার্জি পরিচালিত রসমঞ্জুরীর দুই শিক্ষার্থী নৃত্য পরিবেশন করে। নৃত্যে সব বাধা অতিক্রম করে সামনে যাওয়ার প্রার্থনা ওডিশিকন্যা অনংশার। আর রবি শংকরের বিখ্যাত এক যন্ত্রসংগীতের কত্থকায়নে নাচে দূর্বা।
শেষের আগে মঞ্চ থেকে ঘোষণা করা হয়, কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের নিজস্ব চ্যানেল থেকে সংবাদ প্রচারিত হচ্ছে। দর্শক শ্রোতারা মনোযোগ দেন। তারা তাৎক্ষণিক খবর শোনেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন পরিষদের বিশেষ চ্যানেল। বিজয়ের মাসের আয়োজনে খবর পড়ছি…খবর পড়েন এই লেখক। সংবাদের রেশ কাটতে না কাটতে সমবেত কণ্ঠে শিল্পীরা গেয়ে ওঠেন প্রাণের গান। ভরাট কণ্ঠ। ও আমার দেশের মাটি, তোমার পরে ঠেকাই মাথা। প্রেমে, ভালোবাসায় মায়ের সামনে নিজের দেহমন সঁপে দেয় তার সন্তান। তারা আকুলতায় শ্রদ্ধা নিবেদন করে জন্মভূমির প্রতি। এরপর প্রীতিভোজ। গানে গানে প্রাণে প্রাণে সুর বাজে। বিশ্বময়ীর-বিশ্ব মায়ের আঁচল পাতা মাটিতে সন্তান মিশে যায়। হৃদয়ে গেঁথে নেয় মায়ের শ্যামলবরণ কোমল মূর্তি। প্রবল আকুতি তার সকল সহা সকল বহা মায়ের সমীপে। এই সুর এই গানের বন্দনাতে আসে সারাটি ডিসেম্বর, পুরো বিজয়ের মাস। আহা, প্রাণের সে কী অনুভব!
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.