২০০৬ সালের এপ্রিলে আমার বাবা যখন প্রথম কম্পিউটার এনে দিলেন, ‘হৈমন্তী’র অপুর মতো আমিও বলতে পারতাম, ‘আমি পাইলাম, আমি ইহাকে পাইলাম।’ কিন্তু সে সুযোগ আমার হয়নি। লেপের ধবধবে সাদা কভার এনে পুরো কম্পিউটার ঢেকে দিয়ে মা শুধু বললেন, ‘নষ্ট হয়ে যাবে।’ আমার সেই মা এখন ঢাকার যানজটে বসে দিব্যি স্মার্টফোনে গেম খেলে সময় পার করেন, বাজারে গিয়ে ক্যালকুলেটর অ্যাপ বের করে হিসাব কষেন। ঘরে ফিরে কম্পিউটারে মৃদু শব্দে গান ছেড়ে খানিকটা জিরিয়ে নেন।
প্রযুক্তি এখন আর তাঁর কাছে না-জানা ভিনদেশি কোনো ভাষার মতো দুর্বোধ্য নয়। কারণ তাঁর জানা আছে প্রযুক্তির যন্ত্রগুলো ঘরের অন্যান্য যন্ত্রের মতোই সব সময় সহজে ব্যবহার করা যায়। তাঁকে প্রথম স্মার্টফোন কিনে দেওয়ার পর সন্তানদের কাছ থেকে প্রযুক্তির টুকটাক ব্যাপারগুলো শিখে নেন। এরপর জানার চেষ্টা করেছেন নিজের আগ্রহ থেকেই।
আরেক বন্ধুর ফুফুর কথা এখানে বলা যেতে পারে। ছেলে ইনজাম ক্লাস সেভেনে থাকতেই কম্পিউটারে বেশ দক্ষ হয়ে ওঠে। মা শিমা নাসরিনকেও শেখায় কীভাবে কম্পিউটার ও স্মার্টফোন ব্যবহার করতে হয়। এখন শিমা নিজের আগ্রহেই প্রযুক্তির জ্ঞানের পরিধি বাড়ানোর চেষ্টা করছেন। ফেসবুক ব্যবহার করে নিজেই এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওয়েবসাইটে সামাজিকতা রক্ষা করেন। নিজের ভাবনা তুলে ধরেন ফেসবুক পোস্টে, অন্যের লেখা–ছবিতে কমেন্ট করেন।
সন্তানের এক পা দুই পা করে হাঁটতে শেখা, দা দা বোল থেকে মুখে কথা ফোটা কিংবা প্রাথমিক অক্ষরজ্ঞান হয় বাবা-মায়ের কাছ থেকেই। বাবা-মাকে দেখেই জীবনের অনেক কিছু শেখে সন্তান। এবার না হয় সন্তানের হাত ধরেই শুরু হোক বাবা-মায়ের প্রযুক্তিতে হাতে খড়ি।
ইন্টারন্যাশনাল কমিউনিকেশন অ্যাসোসিয়েশনের ২০১৪ সালে করা এক জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, অন্তত ৪০ শতাংশ অভিভাবক সন্তানের কাছ থেকে প্রযুক্তির ব্যবহার শেখেন। তবে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের সভাপতি মোস্তাফা জব্বার বলেন, ‘শুধু বাংলাদেশ না, পৃথিবীর সব দেশেই বয়োজ্যেষ্ঠদের মধ্যে একধরনের প্রযুক্তি-প্রতিবন্ধকতা কাজ করে। তাঁরা ভাবেন, বয়স তো অনেক হলো, এই সময়ে এসে কী দরকার এসব ঝামেলায় জড়ানোর?’
তাঁদের এমন ভাবনার পেছনে কিছু কারণের উল্লেখ করেন মোস্তাফা জব্বার। যেমন আশির দশকে প্রযুক্তি বলতে ছিল একটা কম্পিউটার। যাবতীয় কাজ হবে এটা দিয়েই। এরপরে যদিও ইন্টারনেট এল, জগৎটা বড় হলো, যন্ত্র কিন্তু সেই কম্পিউটারই ছিল। বর্তমানে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, প্রত্যেকটা কাজের আলাদা অ্যাপ, সব মিলিয়ে প্রথমেই বিষয়টা জটিল মনে হচ্ছে তাঁদের কাছে।
তবে শুধু সন্তানের কাছ থেকে শিখলেই হয়তো এর সমাধান হবে না বলে উল্লেখ করেন মোস্তাফা জব্বার। তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রকেও দায়িত্ব নিতে হবে। তা ছাড়া ডিজিটাল বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। অনেক সেমিনারে গিয়ে তরুণ শিক্ষার্থীরা আমাকে বলে বাবা আমাকে কম্পিউটার ব্যবহার করতে দেয় না, মা ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দিয়েছেন। ইন্টারনেট সম্পর্কে বাবা-মাদের মধ্যে একটা নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে। ইন্টারনেটে যে কিছু শেখা যায় এটাই তাঁরা জানেন না। তাই তাঁরা যদি প্রযুক্তি শিক্ষা না পান তবে হয়তো আমাদের উন্নয়ন বন্ধ হয়ে যাবে না, কিন্তু ডিজিটাল বাংলাদেশের দিকে এগিয়ে যাওয়ার গতি কমে যাবে।’
মোস্তাফা জব্বার নিজের সন্তানের উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘আমার ছেলে বিজয়ের জন্ম ১৯৯৩ সালে। চার বছর বয়স থেকে তাঁকে আমি কম্পিউটারের সফটওয়্যারের মাধ্যমে শিক্ষার ব্যবস্থা করে এসেছি। ছোট থেকেই সে কম্পিউটার ব্যবহারে পারদর্শী। দেশে আসা মাত্রই তাঁকে ইন্টারনেট সংযোগ দিয়েছি। কোনো ধরনের বাঁধা দেয়নি। আমার ছেলে তো খারাপ হয়ে যায়নি।’
সন্তান কী কী করতে পারে
*যেকোনো প্রযুক্তির বিষয় খুবই সহজ ভাবে মজার করে শেখাতে হবে
*প্রয়োজনে প্রতিটা ধাপ লিখে লিখে টিউটোরিয়াল তৈরি করে দেওয়া যেতে পারে
*প্রথমেই যে তাঁরা শিখে ফেলবেন, এমনটা আশা করা ঠিক হবে না। তাই ধৈর্য নিয়ে বোঝাতে হবে
*তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের সময় প্রাইভেসি সম্পর্কে সচেতন করতে ভুললে চলবে না
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.