ফুরফুরে মেজাজে ছুটছে মারিয়ম। নিশাতও তাই। ওদের থামানোর চেষ্টা করি। না, ভ্রুক্ষেপ নেই। এগিয়ে যাই পেছনে পেছনে। একপর্যায়ে দাঁড়ায় দুজনই। দেখি, কি বই পেয়েছ তোমরা? ওরা মেলে ধরে তাদের প্রিয় পুস্তক। আমার বই সে নাম। নতুন বইয়ের ঘ্রাণ নেয় তারা। আনন্দে শিহরিত হয়। এই বই তাদের গর্বের, নতুন বছরের অর্জন। আমি বলি, চমৎকার! ওরা ঊর্ধ্বে তুলে ধরে প্রাণের সে বই। দেখি, স্বর্গের হাসি ওদের মুখে। শুধু ওদের মুখ নয়, বাংলার কোমল মূর্তির মুখখানিও আমার সামনে ভেসে ওঠে। আমি জন্মভূমির গান গাই।
৫ জানুয়ারি। আবুধাবির বাংলাদেশ স্কুলের অডিটোরিয়াম। এখানে ছোটদের মধ্যে বিনা মূল্যে নতুন বই দেওয়া হলো। সংযুক্ত আরব আমিরাতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ ইমরান এই আসরের মধ্যমণি। তিনি ছোটদের বুকে টেনে নিলেন। হাতে তুলে দিলেন চার রঙা প্রচ্ছদের আকর্ষণীয় বই। এ তাঁর নতুন বছরের ভালোবাসা। দেশে বছরের প্রথম দিনই প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এ তো প্রবাস। এই আবুধাবিতে একই দিনে অনুষ্ঠানটি করা সম্ভব হয়নি। কথায় বলে, সবুরে মেওয়া ফলে। বাস্তবে অবশ্য তাই হলো। ঢিপি দিয়ে আগেই মঞ্চে সাজিয়ে রাখা হয়েছে বই। এদিন বই হাতে পাওয়ার উচ্ছ্বাস দমিয়ে রাখতে পারেনি কোমলমতি শিক্ষার্থীরা। বাঁধভাঙা স্রোতের মতো তারা গেল মঞ্চের দিকে। বইয়ের ঘ্রাণে তখন তারা উদ্বেলিত। উৎফুল্ল স্কুলশিক্ষক, দূতাবাস কর্মকর্তা ও কমিউনিটি ব্যক্তিত্ব—সবাই। বই প্রাপ্তির আসর হয়ে উঠল একটি উৎসব।
স্কুলের অধ্যক্ষ মীর আনিসুল হাসান স্বাগত জানালেন অভিভাবক, দূতাবাস কর্মকর্তা ও কমিউনিটি ব্যক্তিত্বদের। বই অনুষ্ঠান সফল করার লক্ষ্যে শিক্ষক সহকর্মীরা সহযোগিতা করেছেন। সে জন্য তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন। বই বিতরণ করা হবে। সাজ সাজ শব্দ, সে আরও আগে থেকে। ভিন্ন ভিন্নভাবে সেগুলো ব্যাগে রাখা হয়েছে। একেক দিকে একেক ক্লাসের বই। শিক্ষার্থীরা দেখছে। দূর থেকেই ওরা তাক করছে সে বই। মনে মনে স্থির করে নিচ্ছে, ওটাই হবে তার, প্রতিজনই ভাবছে এমন। কী সেই উত্তেজনা! স্কুল পরিচালনা পর্ষদের সদস্য ইফতেখার হোসেন। তিনি শিক্ষার্থীদের আশীর্বাদ করলেন। বললেন, তারা মানুষ হবে। নতুন বইয়ের ঘ্রাণ নিয়ে সঞ্জীবিত হবে। আগামী নির্মাণ করবে তারা। তিনি পড়াশোনায় মনোযোগী হওয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। বলেন, মেধাবীরা দেশ পরিচালনায় এসে মাতৃভূমি বেশি উপকার পাবে। রঙিন বইয়ে ছোটদের আলাদা আকর্ষণ। তারা নতুন বইয়ের মধ্য দিয়ে নতুন স্বপ্ন দেখে। গত বছরও শিক্ষার্থীদের হাতে এখানে নতুন বই দেওয়া হয়েছে। বিনা মূল্যে বই বিতরণ সেটাই প্রথম। কিন্তু এবারের আয়োজন সম্পূর্ণ আলাদা। এখানে বিভিন্ন মহল থেকে অতিথি এসেছেন। ছোটরা আনন্দ করছে। অন্য রকম এক ভুবন নির্মাণ করেছে তারা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এমন পরিবেশই পড়তে চেয়েছিলেন। বাহাত্তরের সংবিধানে সব শিশুর বাধ্যতামূলক অবৈতনিক শিক্ষা নিশ্চিত করে বঙ্গবন্ধুর সরকার। শিক্ষা সুযোগ নয়, অধিকার এমন একটি স্লোগান একটি ছাত্র সংগঠনের। সেই দিকেই যাচ্ছে বোধ হয় এই সরকার। হয়তো বা হ্যাঁ, হয়তোবা না। এবার সাড়ে চার কোটি শিশুর হাতে ছত্রিশ কোটির বেশি বই তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা সরকারের। শুধু প্রাথমিক স্তরের আড়াই কোটি শিশুর হাতে এবার আসছে এগারো কোটি বই। সেদিন এখানে এই স্তরের বইই বণ্টন করা হলো। প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের হাতে আয়োজনে উঠে এল প্রাণের বই। শিক্ষার উদ্দেশ্য শিশুদের নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধে গড়ে তোলা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করা। যে মানব সন্তানের ডাকে বাংলাদেশ পেলাম তাকে জানারও একটা ব্যাপার থেকে যায়। বঙ্গবন্ধু মানুষের জন্য সারা জীবন লড়েছেন। জেল জুলুম সহ্য করেছেন। ত্যাগের মহান ঔদার্য তাঁর। এসব না জানলে নতুন প্রজন্ম গড়ে উঠবে কীভাবে। আছে আরও মানুষের অবদান। শিক্ষার বিষয়বস্তুর সংস্কারে যতটুকু অগ্রগতি তাও পিছিয়ে দেওয়ার চক্রান্ত চলছে। সরকারের বাইরের কথা বাদই দিলাম। ভেতরকার বাধার কথাও এখন জোরেশোরে এসেছে।
সে প্রসঙ্গ এখন থাক। তার চেয়ে আমরা এগোই আয়োজন নিয়ে। স্কুল অডিটোরিয়াম সে সময় কানায় কানায় পূর্ণ ছিল। এ অঙ্গন হয়ে ওঠে আনন্দ প্রাসাদ। বিনা মূল্যে বই বিতরণ অনুষ্ঠান রূপ নিল উৎসবে। ভবিষ্যতে যাতে এই ধারাবাহিকতা বজায় থাকে সে ব্যাপারে সবার সহযোগিতা খুব জরুরি। রাষ্ট্রদূত তাঁর বক্তব্যে এমনটিই বললেন। তিনি আরও বলেন, দেশের বাইরে বাংলাদেশের পাঠক্রম সচল রাখার জন্য সরকার খুবই যত্নবান। এর মধ্য দিয়ে নিজের জাতিসত্তা ধারণ করে আজকের প্রজন্ম এগিয়ে যাবে সামনের দিকে, সেই আশাবাদও ব্যক্ত করলেন। এবার কয়েক দিন সময় নেওয়া হয়েছে বই বিতরণের অনুষ্ঠান করতে। ভবিষ্যতে বছরের প্রথম দিনে এই আয়োজনটি করার ইচ্ছে। এ কথা যেমন রাষ্ট্রদূত বললেন, জানালেন স্কুলের শিক্ষকেরাও। প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা এদিন নতুন বইয়ের প্রাণ নিয়ে বাড়ি ফিরেছে। তাহলে ৬ষ্ঠ থেকে ৮ম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা কবে পাবে নতুন বই, কবে আসবে তাদের প্রত্যাশার পুস্তক! তাড়াতাড়িই এই একটি শব্দে পরিষ্কার করেই জানালেন দূতাবাস ও স্কুলের প্রতিনিধিরা। বই বিতরণ অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে ছিলেন দূতাবাসের দুই কাউন্সেলর। মোহাম্মদ শহীদুজ্জামান ফারুকী বরাবরই ব্যস্ত ছিলেন ছোটদের নিয়ে। মোহাম্মদ ইকবাল হোসেনও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আনন্দ উপভোগ করলেন। আর স্কুলের শিক্ষক অধ্যাপক এস এস আবু তাহের, তিনি আয়োজনের মধ্যে ডুবে ছিলেন। অনুষ্ঠান জোগাড় গোছানোর কাজে তাঁর ভূমিকা প্রশংসনীয়। তিনি আয়োজন অনুষ্ঠানটিও সঞ্চালনা করলেন। কথা হচ্ছিল আয়োজন নিয়ে। ইংরেজির শিক্ষক ইসরাত জাহান হুরা। উৎসব মুখর এ দিনটিকে তিনি ব্যাখ্যা করলেন। বললেন, ছোটরা নতুন বইয়ের ঘ্রাণে-পড়াশোনায় অনুপ্রাণিত হচ্ছে। মাহমুদা হুসাইন বলেন, রাষ্ট্রদূতের হাত থেকে সরাসরি বই নিল নতুন প্রজন্ম। বিষয়টি সাধুবাদ যোগ্য, মন্তব্য তাঁর। সবার জন্য বই, বৈষম্য নেই, বললেন ফারলুনা হক। এমন ব্যবস্থায় বই বণ্টন অব্যাহত থাকবে, এই প্রত্যাশাও ব্যক্ত করেন তিনি। ফিরোজ আহমেদ জীববিদ্যা ও গণিতের শিক্ষক। এবার আয়োজনে অভিভাবকেরা যথেষ্ট সারা দিয়েছে বলে জানালেন।
স্কুল পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গেও দেখা হলো। এই সময়ে কথা বললাম আমাদের শিক্ষার্থী সম্পর্কে। এলিজাবেথ কাপাতি ফিলিপাইনের নাগরিক। বললেন, ছোটরা দুরন্ত তবে পড়ালেখায় মনোযোগী। আরেক ফিলিপিনো অ্যানাবেল। তাঁর পর্যবেক্ষণ, তাদের খেলাধুলা, বাক্যালাপ বড় উপভোগ্য। তিনি বলেন, ওদের কথাবার্তায়, চলায় প্রাণের আবেগ আছে। তিনি যোগ করেন, ছোটদের দুষ্টুমিতেও থাকে এক ধরনের ভালো লাগা উপাদান। মিজানুর রহমান, মতিন মিয়া দীর্ঘদিন চাকরি করেন স্কুলে। প্রথমজন বলেন, মিলে গেছি ভালোবাসায়। আর দ্বিতীয়জন নিজেকে টেনে আনলেন অনুষ্ঠানে। বলেন, গত বছরও বই বিতরণ করা হয়েছে তবে উৎসব হলো এবার। উচ্ছ্বসিত আনন্দ তার। এ বড় পাওয়া, বলেন তিনি। কথা বলতে বলতে দাঁড়াই নিমতলায়। সেখানেও হয় প্রাণের কথা। বইয়ের আলাপ শেষ হয় না। রেশ কাটে না আয়োজনের। এখানেও হয়ে ওঠে প্রাণের মেলা। চতুর্থ শ্রেণির মাহা বই পেয়ে তার আনন্দ প্রকাশ করার ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। বলছে, কালকে থেকেই শুরু হবে নতুন বইয়ে পড়াশোনা। একই শ্রেণির নিশাত সেও এগোচ্ছে বেণি দুলিয়ে। ভালো লাগার ষোলো আনা প্রকাশ তার চোখে মুখে। ও সত্যি সত্যি বলতে চাইছে, আমার মতোন সুখী কে আছে!
আনন্দে-উৎসবে কাটল পুরো সময়। এ আনন্দ শিশুর মুখে, এ তৃপ্তি শিক্ষকের, অভিভাবকের। এই ধারায় শামিল অন্যান্য অতিথিরাও। এইভাবে নতুন বইয়ের ঘ্রাণ সারা বছর উদ্বেলিত করবে সবাইকে, এই কামনা।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.