বারাক হোসেন ওবামা (দ্বিতীয়)। জন্ম সনদ অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার পরিচয় এটাই। যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াইয়ের হনুলুলুতে ১৯৬১ সালের ৪ঠা আগস্ট তার জন্ম। অতি সাধারণ এই বারাক ওবামা যুক্তরাষ্ট্রে নতুন এক ইতিহাস সৃষ্টি করে ২০০৯ সালের ২০শে জানুয়ারি প্রবেশ করেন হোয়াইট হাউসে। না, তাকে অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে মার্কিনিরা বেছে নেননি। একটি দলের প্রধান হিসেবে তাকে বেছে নেয়া হয়নি। কোনো আন্দোলনের কারণেও নয়। তিনি গভর্নর ছিলেন না। ছিলেন না একজন জেনারেল বা বর্ষীয়ান কোনো আইন প্রণেতাও। তার পূর্বসূরি ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় মারা যাননি এবং এর ফলে সৃষ্ট শূন্য স্থানে তিনি ‘দুর্ঘটনাক্রমে’ প্রেসিডেন্ট হিসেবে আসেননি। তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন একান্তই নিজের চেষ্টায়। তার বক্তব্য। তার ব্যক্তিত্ব এবং তার মধ্যে রয়েছে এক ধরনের প্রতীকী ভাবমূর্তি। এসব দিয়েই তিনি মন জয় করেছেন বিশাল যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের। তিন বছর ধরে তিনি এজন্য বিভিন্ন প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়েছেন। সব বাধাকে পেছনে ফেলে তিন দশকের চেয়েও বেশি সময়ের মধ্যে অর্ধেকের বেশি পপুলার ভোটে প্রথম ডেমোক্রেট হিসেবে তিনি প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। এক্ষেত্রে তিনি নিজে ও তার ভিতর থেকে যেসব বার্তা বেরিয়ে এসেছে তা আলাদা করা যায় না। আশা ও পরিবর্তনের ক্ষেত্রে তিনি নিজেকে প্রদর্শন করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের লাখ লাখ মানুষের আদর্শ হলো সহনশীলতা, সহযোগিতা, সমতা ও ন্যায়বিচার। সেসব মানুষ তাদের সেই আদর্শের প্রতিফলন দেখতে পেয়েছিলেন ওবামার মাঝে। এক্ষেত্রে তাদের কাছে আয়না হয়ে উঠেছিলেন ওবামা। তিনি দু’দফায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করছেন। আগামী ২০শে জানুয়ারি নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের মধ্য দিয়ে তিনি বিদায় নেবেন রাষ্ট্রযন্ত্র থেকে। এ দুই মেয়াদে তার সামনে এসেছে নানা ঘাত প্রতিঘাত। তিনি কখনো আবেগে আপ্লুত হয়েছেন। তাকে প্রকাশ্যে কাঁদতে দেখা গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের চিবুক বেয়ে অশ্রু ঝরছে এ দৃশ্য ছাপা হয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। তার সামনে এসেছে অর্থনৈতিক মন্দা। ভূ-রাজনৈতিক সঙ্কট। কিন্তু তার মধ্যেও তরুণ এই প্রেসিডেন্ট শুধু ওবামা হিসেবে বিশ্বের কাছে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি কিভাবে তা করেছেন তা জটিল এক হিসাব। তখনো তিনি নির্বাচিত হননি প্রেসিডেন্ট, তিনি সবেমাত্র ডেমোক্রেট দলের মনোনয়ন পেয়েছেন। এমন সময় তিনি জার্মানি সফরে যান। যোগ দেন সেখানকার জনতার সঙ্গে। ওইদিন জার্মানির সমাবেশে তার আবেশে জড়ো হয়েছিলেন প্রায় ২ লাখ মানুষ। মনোনয়ন গ্রহণ করা নিয়ে তিনি বক্তব্য রাখেন একটি ফুটবল স্টেডিয়ামে। সেখানে লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। প্রেসিডেন্ট হিসেবে বিজয়ী ওবামার বক্তব্য শোনার জন্য পার্কে নামে মানুষের বাণ। প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার প্রথম বক্তব্য শোনার জন্য ন্যাশনাল মলে মানুষের যে ঢল নেমেছিল তা ইতিহাস সাক্ষ্য দেবে যুগে যুগে। ২০০৯ সালের অক্টোবর। তখনো তিনি নিজে বড় কোনো কাজ করে ওঠেননি। কিন্তু নরওয়ের নোবেল প্রাইজ কমিটি তাকে সর্বোচ্চ সম্মানজনক পদক শান্তিতে নোবেল প্রাইজ পুরস্কারে ভূষিত করে। তাকে পুরস্কার দেয়ার ঘোষণায় নোবেল কমিটি বলে, ওবামা বিশ্ববাসীর দৃষ্টি যেভাবে আকর্ষণ করেছেন এমন ব্যক্তিত্ব বিরল। তিনি তার দেশবাসীকে উন্নতর ভবিষ্যতের আশা দিয়েছেন। অর্থনীতি যখন মহাসংকটে এমনই এক সময়ে তিনি ক্ষমতায় আসেন। তিনি শিক্ষাখাত, পরিবেশগত গবেষণা, শিল্পের আধুনিকায়ন, স্বাস্থ্য সংস্কারে রেকর্ড পরিমাণ বিনিয়োগ করেন। মৌলিক চিকিৎসা, বিজ্ঞান গবেষণা, বিকল্প জ্বালানি ব্যবস্থায় বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করেন। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি তিনি নতুন করে সাজান। এতে অনেক বিশেষজ্ঞ উদ্বেগ প্রকাশ করেন। কিন্তু তার সেই নীতির ফল কি তা কয়েক বছর ধরে বোঝা যাচ্ছিল না। তবে তা যে ব্যর্থ হয়েছে তা নয়। তার এমন উদ্যোগকে খাটো করে দেখা যাবে না। তার ক্ষমতার মেয়াদেই আল কায়েদা প্রধান ওসামা বিন লাদেনকে পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে হত্যা করেছে যুক্তরাষ্ট্রের নেভি সিলের সদস্যরা। প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের পর তিনিই মধ্যম শ্রেণির মানুষের সর্বোচ্চ আয়কর কমিয়েছেন। তাকে নিয়ে যদি ইতিহাসবেত্তারা মাত্র একটি বিষয় লিখতে চান তাহলে কি লিখবেন! তারা লিখবেন দাসপ্রথা বাতিল হওয়ার ১৪৩ বছর পরে ইলিনয়ের একজন তরুণ সিনেটর যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আফ্রিকান বংশোদ্ভূত প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। তিনি হলেন বারাক হোসেন ওবামা। ২০০৯ সালে তিনি যখন ক্ষমতা গ্রহণের পর প্রথম বক্তব্য রাখেন তখন তার বয়স ছিল মাত্র ৪৭ বছর। তার কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল ‘আশা আর পরিবর্তনের’ নব বারতা। দায়িত্ব পালনের সময় তিনি কাব্যকে সুশাসনের গদ্যে পরিণত করতে লড়াই করেছেন। তবে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বিরাজমান ছিলই। তার ক্ষমতাকালে পুলিশ গুলি করেছে নিরস্ত্র কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর। বিতর্ক হয়েছে তার জন্মস্থান নিয়ে। তবে যে যা-ই বলুন তার গতিময় নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে এক উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে। ওবামার প্রথম দফা প্রেসিডেন্সির প্রায় পুরোটা সময় সংগ্রাম করতে হয়েছে অর্থনৈতিক মন্দার বিরুদ্ধে। রিয়েল এস্টেট বাণিজ্যে ধস আসে। তা ক্রমাগত অর্থনীতিতে স্থবিরতা নিয়ে আসে। ওয়াল স্ট্রিট ব্যাংকগুলোতে ও এর ঋণগ্রহীতাদের যেন এক ঘূর্ণিঝড় গ্রাস করে। এসব মিলে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার সঙ্গে জুড়ে যায় যুক্তরাষ্ট্রও। সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ ও ফেডারেল রিজার্ভের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে লাগাম টেনে ধরার নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেন ওবামা। তিনি সরকারি খাতে ৮৩১০০ কোটি ডলারের প্রকল্প হাতে নেন। তার প্রথম দফা ক্ষমতার মেয়াদে রাজনৈতিক ও সামাজিক হতাশা থেকেই যায়। তিনি অর্থনীতিতে তিনি বেশ কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করতে সক্ষম হন। ২০১১ সালের ২রা মে। বারাক ওবামা এক ভাষণে বললেন, আমি আমেরিকার জনগণ ও বিশ্ববাসীকে জানাতে চাই যে, যুক্তরাষ্ট্র আজ রাতে একটি অপারেশন পরিচালনা করেছে। এই অপারেশনে হত্যা করা হয়েছে (আল কায়েদা প্রধান) ওসামা বিন লাদেনকে। এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে ওবামা যুক্তরাষ্ট্রের লাখ লাখ মানুষের মনে জমে থাকা ক্ষোভ ও হতাশা সরিয়ে দেন। তিনি এর মাধ্যমে জানান দেন বিশ্বে সবচেয়ে শক্তিধর দেশ যুক্তরাষ্ট্র। ৯/১১ হামলার জন্য দায়ী ব্যক্তি দায়মুক্তি পাবে না। যদিও এ অভিযান নিয়ে অনেক কথা আছে। ওসামা বিন লাদেন আত্মগোপন করে ছিলেন পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে অ্যাবোটাবাদের একটি ‘দুর্গম’ বাড়িতে। ২রা মে রাতে পাকিস্তানকে না জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্র নৌবাহিনীর নেভি সিল সদস্যরা ওই বাড়িতে অভিযান চালিয়ে হত্যা করে লাদেনকে। লাদেনকে হত্যা করা হলেও আল কায়েদার শাখা প্রশাখা ও এর সঙ্গে সম্পৃক্তরা এখনো বিদ্যমান রয়েছে পৃথিবীর বুকে। তবে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের তাদের নেতৃত্ব ক্ষয়ে গেছে। ওবামা তার শেষ স্টেট অব দ্য ইউনিয়ন ভাষণে বলেছেন, আমার প্রেসিডেন্সির মেয়াদে যে দু-একটি বিষয়ে অনুশোচনা করি তার অন্যতম হলো- এখনও বিভিন্ন দলের মধ্যে হিংসা ও সন্দেহের মাত্রা ভালোর দিকে যাওয়ার পরিবর্তে খারাপ হয়েছে। ওবামা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই কংগ্রেসে তার প্রতিটি পদক্ষেপের বিরোধিতা করেছে রিপাবলিকানরা। তিনি চেষ্টা করেছেন কুখ্যাত গুয়ানতানামো বন্দি শিবির বন্ধ করে দিতে। চেষ্টা করেছেন অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ কার্যকর করতে। তবে তিনি যা-ই করেছেন প্রতিটি পদক্ষেপেই তিনি রিপাবলিকানদের রাজনৈতিক হিংসার শিকার হয়েছেন। তার সময়ে উল্লেখযোগ্য অর্জনের মধ্যে রয়েছে ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক অস্ত্র বিষয়ক চুক্তি। এ চুক্তির মধ্য দিয়ে তিনি ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করা থেকে বিরত রাখতে সক্ষম হন। দুই দশকেরও বেশি এ নিয়ে ইরানের ওপর অবরোধ রয়েছে। ওবামা ওই চুক্তি করে সেই অবরোধ শিথিল করেন। এজন্য তাকে ভিন্ন কৌশল নিতে হয়েছে। তিনি ইরানের সঙ্গে গোপনে আলোচনা চালিয়ে গেছেন। তবে এতে ইরানের ‘শত্রু’ বলে পরিচিত ইসরাইল ও সৌদি আরবের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে টান ধরে। কিন্তু ওবামা ওই চুক্তি করার মাধ্যমে ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি থেকে বিরত রাখতে সক্ষম হন। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদকে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারে সীমা লঙ্ঘন না করতে আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু আসাদ তাই করেছেন। তিনি রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করেছেন রাশিয়া ও ইরানকে সঙ্গে নিয়ে। কিন্তু তারপরও সিরিয়ায় সামরিক হামলা বা সরাসরি যুদ্ধ শুরু করেননি তিনি। কারণ, তিনি যুদ্ধবিরোধী টিকিটে ক্ষমতায় এসেছেন। এখন সিরিয়ায় যে অবস্থা তাতে এ সংকট দীর্ঘ সময় চলবে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বোদ্ধারা। সাবেক প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন যেভাবে চীন সফরে গিয়েছিলেন বারাক ওবামার কিউবা সফরকে সেই একইভাবে স্মরণীয় করে রাখা হবে। ওবামা চেয়েছেন লাতিন আমেরিকার এ দেশটির সঙ্গে উন্নত সম্পর্ক গড়ে তুলতে। কিউবার ওপর যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘ সময় অবরোধ আরোপ করেছিল। কিন্তু ওবামার উদ্যোগে দু’দেশের মধ্যে নতুন করে সম্পর্ক পুনঃস্থাপিত হয়। অবরোধ শিথিল করা হয়। দু’দেশে দু’দেশের দূতাবাস চালু হয়েছে।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.