ঝালকাঠি: সদর উপজেলার কীর্তিপাশা ইউনিয়নে জেলার প্রাচীনতম জনপদের নিদর্শন কীর্তিপাশার জমিদারবাড়ি। কালের সাক্ষী এ পুরাকীর্তিটি এখন বিলীনের পথে। প্রয়োজনীয় সংরক্ষণ, সংস্কার আর সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করালে কালের সাক্ষী এই বাড়িটি হতে পারে দেশের অন্যতম একটি পর্যটন কেন্দ্র।
অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে বিক্রমপুর পোরাগাছার রাজারাম সেনগুপ্ত কীর্তিপাশায় আসেন। তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে তিনি জলাশয় ও বনভূমির তালুক দুই ছেলে কৃষ্ণ কুমার সেনগুপ্ত ও দেবীচরণ সেনগুপ্তের জন্য পূর্ব বাড়ি ও পশ্চিম বাড়ি পত্তন করেন, যা পরে ১০ আনা বড় হিস্যা ও ছয় আনা ছোট হিস্যা জামিদারবাড়িতে রূপান্তরিত হয়। কালের বিবর্তনে ছোট হিস্যা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। তবে ঐতিহ্য হারিয়ে গেলেও সেখানে কমলীকান্দার নবীন চন্দ্র নামে বালিকা বিদ্যালয়ের কারণে কিছুটা ঐতিহ্য ধরে রেখেছে আজও। সংরক্ষণ আর সংস্কারের অভাবে বড় হিস্যার নাটমন্দির, হলঘর, ছোট-বড় মন্দির ও জমিদারদের শান বাঁধানো পুকুর ধ্বংসের পথে।
স্থানীয় প্রবীণদের কাছ থেকে জানা গেছে, প্রায় দেড়শ’ বছর আগে কীর্তিপাশা জমিদারপুত্র রাজকুমারকে বিষপ্রয়োগে হত্যা করা হয়। স্ত্রী নিজেকে সতী প্রমাণ করতে স্বামীর সঙ্গে জ্বলন্ত শ্মশানে সহমরণে যান। প্রাচীন সেই স্বামীভক্তির লোমহর্ষক ঐতিহ্যের সহমরণ সমাধিটিও ধ্বংসের পথে। রাজা কীর্তি নারায়ণের নামানুসারে কীর্তিপাশা। রামজীবন সেন কীর্তিপাশা জমিদারবাড়ির প্রতিষ্ঠাতা। এ বংশের সন্তান রোহিনী রায় চৌধুরী ও তপন রায় চৌধুরী দুটি উজ্জ্বল নক্ষত্র। গাবখান নদীর তীরে স্টিমারঘাট রোহিনীগঞ্জ রোহিনী রায় চৌধুরীর অবদান। সেই সঙ্গে ইতিহাস গ্রন্থ বাকলা। কীর্তিপাশায় আছে হাসপাতাল যা ঝালকাঠি থানা সদরে (জেলা সদর) হাসপাতালের চেয়েও পুরনো। পুরনো বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্বমহিমায় উজ্জ্বল মূল জমিদারবাড়িটি এবং দুর্গামন্দির এখন পরিত্যক্ত হয়ে আগাছাপূর্ণ হয়ে আছে। নাট্যশালার চিহ্ন রয়েছে এখনও। মঞ্চের গ্রিনরুম এবং হলরুমে পুনর্বাসিত হয়েছে বালিকা বিদ্যালয়টি। সতীদাহ প্রথার চিহ্ন একটি সহমরণ সমাধির চিহ্ন আছে এখনও। রোহিনী রায় চৌধুরীর সমাধিটি নতুনভাবে নির্মাণ করা হয়েছে। পারিবারিক শিবমন্দির এবং একটি শিবমূর্তি আছে এখনও।
দর্শনীয় স্থান হিসেবে কীর্তিপাশা জমিদারবাড়ি অনেক পরিচিত এবং আরও অনেক বিস্ময়কর দেখার মতো কীর্তি রয়েছে যেমন একটি সতীদাহ প্রথার সমাধি এবং জমিদার প্রসন্ন কুমার রায় চৌধুরীর সমাধি মন্দির একটি শিবমন্দির। এগুলো দেখতে এখানে প্রতি বছর ডিসেম্বর মাস থেকে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে অনেক লোক আসেন এবং এই জমিদারবাড়ি ঘুরতে আসেন আর এখানে এসে তারা অনেক সময় পিকনিক করে থাকেন। কীর্তিপাশা জমিদারি এই পরিবারের দুর্গাদাস সেনের প্রপৌত্র কৃষ্ণরাম কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়। কৃষ্ণরাম এবং তার অপর দুই ভাই রায়েরকাঠি জমিদারদের কর্মচারী হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। কোনো এক সময়ে জয় নারায়ণের জমিদারি বিপর্যয়ের সম্মুখীন হলেও কৃষ্ণরামের বুদ্ধিমত্তায় জমিদারি রক্ষা করা সম্ভব হয় এবং তিনি মজুমদার উপাধিতে ভূষিত হন।
এই পরিবারের কালী প্রসন্ন কুমারের স্ত্রী হর সুন্দরী স্বামীর মৃত্যুর পর চিতায় আত্মাহুতি দেন। তার এই আত্মাহুতি তৎকালীন সময়ে বিশেষ আলোড়ন সৃষ্টি করে। কীর্তিপাশা জমিদারদের কীর্তিগুলোর সব কিছুই প্রায় বিলুপ্ত। শুধু তাদের ভগ্ন বসতবাড়ি এবং হরসুন্দরী দেবীর সহমরণের বেদিটি কোনো প্রকারে টিকে থেকে অতীত দিনের ধর্মীয় বিশ্বাসকে প্রকাশ করে চলেছে। ২০০৪ সালে স্থানীয় সুশীল সমাজ এবং জেলা প্রশাসনের প্রচেষ্টায় জমিদারদের কিছু ঐতিহ্যের নিদর্শন নিয়ে কীর্তিপাশা জাদুঘর স্থাপন হয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, সেই জাদুঘর এখন গরু-ছাগলের বিচরণ ক্ষেত্র।
দিন দিন সম্পদ চুরি হয়ে জমিদারবাড়ি এখন সম্পদশূন্য। জমিদারবাড়ির বড় হিস্যায় ১৯৭৫ সালে কমলীকান্দার নবীন চন্দ্র বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৮৭ সালে বিদ্যালয়টি স্বীকৃতিপ্রাপ্ত হয়। ১৯৯৭ সালে প্রাচীন স্থাপত্যকীর্তি বজায় রেখে মেরামত প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত হয়। বর্তমানে জমিদারবাড়ির প্রাচীন ঐতিহ্য হারিয়ে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। সংস্কার, সংরক্ষণে এই কীর্তিপাশা জমিদারবাড়িটি হয়ে উঠতে পারে দেশের অন্যতম একটি পর্যটনকেন্দ্র।
জমিদারবাড়িতে ঘুরতে আসা কয়েকজন পর্যটক জানান, বহু দূর-দূরান্ত থেকে কীর্তিপাশা জমিদারবাড়ির নাম শুনে ঘুরতে এসে কেবল হতাশাই নন, ভেতরে প্রবেশ করতেও ভয় পাচ্ছেন তারা।
কীর্তিপাশা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবদুর শুক্কর মোল্লা জানান, দীর্ঘদিন ধরেই একই অবস্থায় পড়ে আছে জমিদার বাড়িটি। তাই সরকারের কাছে স্থানীয়দের দাবি, যাতে কালের সাক্ষী এই কীর্তিপাশা জমিদারবাড়িটি দ্রুত সংস্কার ও সংরক্ষণ করা হয়।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.