সরকারি তিতুমীর কলেজ। শুধু ঢাকা নয়, দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম কলেজ। প্রায় ১১ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত এই কলেজের শিক্ষার্থী প্রায় ৫০ হাজার। প্রতিদিন শিক্ষার্থীদের পদচারণায় ক্যাম্পাস মুখরিত থাকে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। ১৯৬৮ সালে পাকিস্তানি শাসক জিন্নাহর নাম ব্যবহার করে ‘জিন্নাহ্ কলেজ’ নামে যাত্রা শুরু করলেও ১৯৭১ সালের পর ছাত্রনেতারা ‘জিন্নাহ্’ নাম মুছে দেন। পরে মীর নিসার আলী তিতুমীরের নামে নামকরণ করা হয় সরকারি তিতুমীর কলেজ। তৎকালীন শুধু উচ্চমাধ্যমিক পড়ানো হলেও ১৯৭২ সাল থেকে স্নাতক সম্মানের কার্যক্রম শুরু হয়। বাংলা ও রসায়ন বিষয় দিয়ে স্নাতক শুরু হলেও ২০১৬ সালে পর্যন্ত বিভাগের সংখ্যা হয়েছে ২২টি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক সেরা দশ কলেজের জায়গা করে নিলেও ঐতিহাসিক এই কলেজে রয়েছে রাজনৈতিক হানাহানি, কথায় কথায় ছাত্র ধর্মঘট, পরিবহন ও আবাসিক সংকটসহ আরো কিছু সমস্যা। কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা জানান, কলেজটি বাইরে থেকে পরিপাটি হলেও ভেতরে অন্ধকার। কলেজের তথ্যমতে, প্রায় ৫০ হাজার শিক্ষার্থীর বিপরীতে কলেজে অভিজ্ঞ শিক্ষক কর্মরত রয়েছেন ১৭১ জন। এর মধ্যে ১৮ জন অধ্যাপক, ৩৩ জন সহযোগী অধ্যাপক এবং ৫০ জন সহকারী অধ্যাপক। ছেলেমেয়ে এক সঙ্গে সহশিক্ষার সুযোগ পাওয়া এখানকার শিক্ষার্থীরা রাজধানীর অন্যান্য সরকারি কলেজের তুলনায় রাজনৈতিক সংঘাত বেশি থাকায় সব সময় একটু বেশি আতঙ্কে ভোগে। তবে শিক্ষার্থীদের একাডেমিক শিক্ষার পাশাপাশি শিক্ষকদের আন্তরিকতাসহ সকল ধরনের সহশিক্ষা কার্যক্রমের মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের প্রিয় ক্যাম্পাসে পরিণত হয়েছে কলেজটি। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ প্রতি বছর সেমিনার ফি’সহ পাই টু পাই আদায় করা হলেও কোনো বিভাগের সেমিনারই কার্যকর নয়। সেমিনারের ভেতরে ক্লাস নেয়া হয়। ছাত্রছাত্রীরা সেমিনারের সেবা নিতে পারে না। কোনো কোনো সেমিনার লাইব্রেরিয়ান বিভাগের কেরানি, পিয়ন বা আয়ার কাজও করেন। সমাজকর্ম বিভাগের কয়েকজন ছাত্র বলেন, আমাদের সেমিনার থেকে কোনোদিন বই নিয়ে পড়ি নাই। বাংলা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর কামরুন নাহার বলেন, আমাদের কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। যখন পরীক্ষা চলে তখন ক্লাস রুমের সংকট দেখা দেয়। ছাত্রছাত্রীদের সিলেবাস শেষ করার জন্য সেমিনার রুমে ক্লাস নিতে বাধ্য হই। তবে সেমিনার লাইব্রেরিয়ানকে দিয়ে আয়ার কাজ করা বা নাস্তা তৈরির কথাটা সত্য নয়। প্রাণিবিদ্যা বিভাগের এক ছাত্র বলেন, আমরা হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী বিভিন্ন জেলা থেকে এসে এখানে পড়ালেখা করি। অথচ প্রায় ৫০ হাজার ছাত্রছাত্রীর জন্য মাত্র তিনটি হল। ছাত্রদের একটি ও ছাত্রীদের দু’টি। এই হলের শিক্ষার্থী ধারণক্ষমতাও সর্বোচ্চ ৫০০। যা শিক্ষার্থীর তুলনায় কিছুই না। হলেও রয়েছে বিভিন্ন প্রকার না পাওয়ার বেদনা। আক্কাছুর রহমান আঁখি হলের আবাসিক ছাত্র মো. মেসবাউর রহমান বলেন, হলে কোনো রিডিং রুম নেই। রুমগুলোতে ৬ জনের থাকার জায়গায় ১০ জনের বেশি থাকতে হয়। খাবারের মান একেবারেই নিম্ন। কলেজে খেলাধুলার মধ্যে ক্রিকেট, ফুটবল, ব্যাডমিন্টন ও ভলিবল খেলা হয়। এছাড়া রয়েছে বিএনসিসির প্রশিক্ষণরত ক্যাডেট, সামাজিক সংগঠনের মধ্যে বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোর, বাঁধন ও বাংলাদেশ স্কাউটস। রাজনৈতিক সংগঠনের মধ্যে ছাত্রলীগ, ছাত্রদলের কার্যক্রম রয়েছে। কলেজ কর্তৃপক্ষ দাবি করেন, তিতুমীর কলেজে সকল প্রকার রাজনৈতিক দলের সহাবস্থান রয়েছে। ছাত্রলীগের সভাপতি কাজী মিরাজুল ইসলাম ডলার বলেন, ঢাকার মধ্যে একমাত্র সংঘাতমুক্ত আমাদের কলেজ। অন্যান্য কলেজে দেখা যায় একই ছাত্র সংগঠনের সভাপতি এবং সেক্রেটারির আলাদা আলাদা গ্রুপ থাকে। তাদের মধ্যে প্রায়ই সংঘর্ষ হয়। আমাদের এখানে এমন কোনো সংঘর্ষের ঘটনা নেই। তবে ছাত্রদলের সভাপতি তসলিম আহসান মাসুম বলেন, কিছুদিন আগে সদস্য আহ্বান করে ফরম ছাড়া হয়েছিল ছাত্রদলের পক্ষ থেকে। সেখানে ১৩০০ বেশি শিক্ষার্থী ফরম পূরণ করে। এছাড়া, বিভিন্ন সময় প্রোগ্রামে অংশ নেয় এমন ৮০০ এর বেশি ছাত্র রয়েছে। তিনি অভিযোগ করে বলেন, ২০১৪ সালের আগ পর্যন্ত ছাত্রলীগ-ছাত্রদলের সহাবস্থান ছিল ক্যাম্পাসে। এরপর মারমুখী হয়ে ওঠে। ছাত্রদলের সঙ্গে না পারলে পুলিশ দিয়ে হয়রানি করে। সাধারণ ছাত্ররা ফরম ফিলাপের জন্য কলেজে আসলে বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন করে। যোগাযোগ করা হলে কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর আবু হায়দার আহমেদ নাছের বলেন, আমাদের কলেজে ছাত্রছাত্রীর জন্য তিনটি আবাসিক হল রয়েছে। এগুলোর মধ্যে ছেলেদের জন্য আক্কাছুর রহমান আঁখি ছাত্রাবাস। মেয়েদের জন্য সুফিয়া কামাল ছাত্রীনিবাস ও সিরাজ ছাত্রীনিবাস। ইতিমধ্যে আমাদের আরো দুইটি ছাত্রাবাস নির্মাণের জন্য পাস হয়েছে। এখন টেন্ডার পর্যায়ে রয়েছে। এছাড়া, কলেজের একাডেমিক কাম পরীক্ষা কেন্দ্রের জন্য ১০ তলা ভবনের কাজ শুরু হয়েছে। এগুলো শেষ হলে কলেজের ভৌত অবকাঠামোগত যে সমস্যা রয়েছে সেগুলোর কিছুটা সমাধান হবে। তিনি বলেন, আমাদের প্রতিষ্ঠানটির সুষ্ঠু কার্যক্রম পরিচালনার জন্য নিজস্ব নিরাপত্তা কর্মী রয়েছে। এছাড়া প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ জন শিক্ষকের সমন্বয়ে শক্তিশালী একটি টিম কর্মরত থাকে। এই টিম সার্বিক শৃঙ্খলা বিধানে নিয়োজিত থাকে। রুটিন অনুযায়ী ক্লাস হচ্ছে কিনা। বাইরের থেকে আসা ভর্তিচ্ছুরা বা বিভিন্ন কাজে আসা ছাত্রছাত্রীদের কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা সেগুলোর খবর রাখে। এছাড়া, সম্পূর্ণ ক্যাম্পাসটি সিসি টিভি ক্যামেরার আওতাধীন। যা সরাসরি অধ্যক্ষের কার্যালয় থেকে তদারকি করা হয়।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.