নয়ন মিয়া (৮)। বাবা বুলু মিয়া ও মা বিউটি বেগম আদর করে নয়নের মণি বলেই ডাকতেন। কাওরান বাজার সুপার মার্কেটের বারান্দাতেই রাত-দিন কাটে তার। মা-বাবার স্বপ্ন ছিল ছেলেকে লেখাপড়া শিখিয়ে বড় চাকরি করাবেন। একটি স্কুলেও ভর্তি করা হয় তাকে। বাবা সবজি বিক্রি করে সংসার চালাতেন। হঠাৎ অসুস্থ হওয়াতে সে স্বপ্নে বাগড়া পড়ে। মা, ২ ভাই ও ১ বোনের সংসারে অর্থের যোগান বন্ধ হয়ে যায়। খুব টানাটানি করে চলে কিছুদিন। এক সময় সে উপায়ও বন্ধ হয়ে যায়। তারপর থেকেই সে নেমে পড়ে টুকাইয়ের কাজে। মানবজমিনের সঙ্গে আলাপকালে নয়ন মিয়া বলে, আমি অপেক্ষায় থাকি কখন গাড়ি আসবে। যখন গাড়ি আসে তখন দৌড় দিয়ে সবার আগে যাই। কারণ আমার মতো আরো অনেকেই থাকে যাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে টুকানোর কাজ করতে হয়। অনেক সময় গাড়ির ড্রাইভার, দোকানের মালিকের মারধরও খেতে হয়। নয়ন আরো বলে, প্রতিদিন সকাল, দুপুর ও সন্ধ্যায় সে কাজটা করে। আদা, রসুন, পিয়াজ, বিভিন্ন ধরনের সবজি, মরিচ টুকিয়ে একসঙ্গে জমিয়ে রাস্তার পাশে বসে সেগুলো ভাগ ভাগ করে বিক্রি করে ২শ’ ৩শ’ টাকা আয় হয়। যে আয় হয় সেখান থেকে নিজের নাস্তার জন্য ২০ টাকা রেখে বাকিটা মায়ের হাতে তুলে দেয়। মা সেই টাকা দিয়ে সংসার চালান। পাশাপাশি বাবার ওষুধ ও ছোট বোনের দুধও কিনতে হয়। নয়ন মিয়া এখন আর লেখাপড়া করে বড় হয়ে মা-বাবার স্বপ্ন পূরণের জন্য চাকরি করতে চায় না। সে এখন বড় মাপের একজন সবজি ব্যবসায়ী হতে চায়। সে মানুষের কল্যাণের জন্য কাজ করে সবার নয়নের মণি হয়ে থাকতে চায়। একই অবস্থা জামালপুরের নুর মোহাম্মদের (১১)। সে নুরুল ইসলাম ও ফুলমতি বেগম দম্পতির দ্বিতীয় সন্তান। তেজগাঁওয়ের একটি কলোনিতে চাপাচাপি করে থাকে মা-বাবা, ১ ভাই ও ১ বোনের সংসারে। কয়েক বছর ধরে শারীরিক অসুস্থতার জন্য বাবা-মা কেউ কোনো কাজ করতে পারেন না। তাই স্কুলে যাওয়াও বন্ধ হয়ে গেছে। সংসারের পুরো চাপটা এসে পড়েছে বড় বোন ও তার ওপর। বড় বোন একটি চকলেট ফ্যাক্টরিতে কাজ করেন। আর তিনি সবজি টুকিয়ে সেগুলো বিক্রি করে ১৫০ টাকা আবার কখনো ২শ’ টাকা পর্যন্ত আয় করে। ভাইবোন দুজন মিলেই পরিবারের যাবতীয় খরচ বহন করে। তবে এক বছর পরে সে গ্রামের বাড়ি জামালপুর চলে যাবে। সেখানে গিয়ে আবারো পড়ালেখা শুরু করবে। স্বপ্ন আছে লেখাপড়া শেষ করে বড় কোনো কোম্পানিতে কাজ করার। শুধু নয়ন মিয়া আর নুর মোহাম্মদ নয় এরকম শত শত পরিবারের অর্থ উপার্জনের একমাত্র উপায় কাওরান বাজার। রাজধানীর বৃহত্তম এই পাইকারি বাজারে প্রতিদিন সারা দেশ থেকে বিভিন্ন ধরনের কাঁচামাল নিয়ে প্রায় দুই তিন হাজার ট্রাক আসে। ট্রাক থেকে যখন শ্রমিকরা পণ্য নামায় তখন কিছু পণ্য ছিটকে পড়ে যায়। আর সেই পণ্যগুলো নিয়ে যায় কিছু টুকাই। সেগুলো বিক্রি করে যা আয় হয় তা দিয়েই জীবনযাপন করছে শত শত পরিবার। সরজমিন রাজধানীর কাওরান বাজার ঘুরে দেখা গেছে শত শত টুকাই, যাদের প্রত্যেকেরই বয়স ১৫ বছরের নিচে। যে সময়টা তাদের স্কুলে দৌড়ানোর কথা সে সময়টা তারা কাঁচামাল বহনকারী ট্রাকের পেছনে দৌড়াচ্ছে। একাধিক টুকাইর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রত্যেকেই তাদের অভাবের সংসারে অর্থের যোগান দিতে এ কাজ করছেন। একটু সুযোগ পেলে আর এ কাজ করবে না। সবারই লেখাপড়া করার ইচ্ছে আছে। বই-খাতা, ভালো কাপড় পরে তারাও স্কুলে যেতে চায়। লেখাপড়া করে বাবা-মা ও সমাজের জন্য কিছু করতে চায়।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.