নিউজিল্যান্ড সফরে আশা ছিল বাংলাদেশ অন্তত ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টিতে সাফল্য পাবে। সীমিত ওভারের ক্রিকেটে গত দুই বছরের অর্জনই জ্বালিয়ে দিয়েছিল সে আশার সলতে। আশঙ্কা ছিল, নিউজিল্যান্ডের উইকেট বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের কঠিন পরীক্ষায় ফেলবে। সুইং, মুভমেন্ট, বাউন্সে এলোমেলো হবে ব্যাটিং। সাত বছর পর নিউজিল্যান্ডের কন্ডিশনে টেস্ট খেলতে নামাটা হবে অগ্নিপরীক্ষা। কিছু হিসাব মিলেছে, কিছু মেলেনি। তবে মিলে যাওয়া হিসাবের মধ্যেও অনেক গরমিল আছে। সিরিজ শেষে পেছন ফিরে তাকালে তাই দেখা যাচ্ছে শুধু ভুলে ভরা ছক। ঘরের বাংলাদেশ আর বাইরের বাংলাদেশ দল একেবারেই ভিন্ন। নিউজিল্যান্ড সিরিজের আয়নায় নিজেদের নতুন করেই দেখল তারা। ব্যাটিং ব্যর্থতা: আশঙ্কা যা ছিল, দেখা গেল তা ভুল। প্রতিটি ম্যাচেই বাংলাদেশ পেল ব্যাটিংবান্ধব উইকেট। কিন্তু মনের মতো উইকেট পেয়েও বাংলাদেশের ব্যাটিং ব্যর্থতা পুরো সিরিজেই প্রকটভাবে প্রকাশিত। ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টি, টেস্ট—কোনো সংস্করণেই ধারাবাহিক ছিল না ব্যাটিং। ক্রাইস্টচার্চের প্রথম ওয়ানডেতে নিউজিল্যান্ডের ৩৪১-এর জবাবে ২৬৪ করতে পারাই সিরিজে সীমিত ওভারের সংস্করণে কাগজ-কলমে সবচেয়ে ভালো ব্যাটিং। যদিও পরিস্থিতির দাবি সেদিনও মেটাতে পারেননি ব্যাটসম্যানরা। পরের ম্যাচে দুই শর ঘরেও যায়নি স্কোর। শেষ ওয়ানডের ২৩৬ করে ৮ উইকেটের হার। টি-টোয়েন্টি হয়ে টেস্টেও একই হাল। ব্যাটিং উইকেটেও এমন ব্যাটিং ব্যর্থতায় সবচেয়ে হতাশ ব্যাটসম্যানরাই। সবার আফসোস, এমন উইকেট পেয়েও সেটা কাজে লাগানো গেল না! ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সের দিক দিয়ে সবচেয়ে হতাশ করেছেন মাহমুদউল্লাহ ও তামিম ইকবাল। ব্যাটিংয়ে প্রাপ্তি: ব্যাটসম্যানদের ভুলে পুরো সিরিজেই ভুগেছে বাংলাদেশ দল। আবার এই ব্যাটসম্যানরাই উপহার দিয়েছেন সিরিজের সবচেয়ে সোনালি দিন। ওয়েলিংটন টেস্টের দ্বিতীয় দিনটি বাংলাদেশের ক্রিকেটের একটা ইতিহাসই লিখল নতুন করে। সাকিব আল হাসান-মুশফিকুর রহিম মিলে গড়লেন রেকর্ড ৩৫৯ রানের জুটি। পঞ্চম উইকেট জুটিতে এটি এখন বিশ্ব ক্রিকেটেরও চতুর্থ সর্বোচ্চ। যাঁরা এই কীর্তিটা গড়লেন, সেই সাকিব-মুশফিকের ব্যক্তিগত অর্জনও অনেক বড় এই সিরিজে। ক্যারিয়ারের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরিটাকে ২১৭-তে নিয়ে গিয়ে টেস্টে দেশের হয়ে সবচেয়ে বড় ইনিংসে পরিণত করেছেন। সঙ্গে মুশফিকের ১৫৯ ও তামিম, মুমিনুল ও সাব্বিরের ফিফটি মিলে প্রথম ইনিংসের ৫৯৫ রান এখন টেস্টে বাংলাদেশ দলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংগ্রহ। সৌম্য সরকারের রানে ফেরাটাও ব্যাটিংয়ের প্রাপ্তি। চোট আর চোট: একসঙ্গে এত চোট এর আগে কবে দেখেছে বাংলাদেশ! এক মুশফিকুর রহিমই আহত হন তিনবার। শেষবার তো বাউন্সারের আঘাতে সিরিজেরই বাইরে চলে গেলেন। ইমরুল কায়েস চোট পেয়েছেন দুবার এবং দ্বিতীয়বার তিনিও মাঠের বাইরে। তামিমও সামান্য চোট পেয়েছেন। টি-টোয়েন্টি সিরিজের শেষ ম্যাচে হাত ফাটিয়ে মাশরাফি বিন মুর্তজা নিউজিল্যান্ড ছেড়েছেন গলায় স্লিং বেঁধে। আর মোস্তাফিজুর রহমান তো শরীরে চোট নিয়েই ঘুরছেন। সর্বশেষ খবর, স্ক্যান রিপোর্টে তাঁর কোমরে কোনো সমস্যা ধরা পড়েনি। কিন্তু তাতেও আশাবাদী হওয়া যাচ্ছে না, কারণ মোস্তাফিজ নিজে বলছেন তাঁর কোমরে ব্যথা। অনুশীলনে চার-পাঁচ ওভারের বেশি বল করতে পারেন না। সমস্যাটা মোস্তাফিজের কোমরে না মনে, সেটা নিয়েই এখন সন্দিহান টিম ম্যানেজমেন্ট। এক হালি অভিষেক: তাসকিন আহমেদের বহুপ্রতীক্ষিত টেস্ট অভিষেকটা নিউজিল্যান্ডেই হলো। এই সিরিজেই টেস্ট এবং ওয়ানডে অভিষেক নুরুল হাসান ও শুভাশিস রায়ের। ওয়ানডে অভিষেক হয়েছে লেগ স্পিনার তানভীর হায়দারের। শেষের জন ছাড়া অভিষেকে সবাই মোটামুটি সফল। সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনা দেখিয়েছেন নুরুল হাসান এবং সেটা ব্যাটিং-উইকেটকিপিং দুই জায়গাতেই। তারুণ্যনির্ভর পেস আক্রমণটাও খারাপ ছিল না। প্রথম টেস্টে দুই টেস্ট খেলা কামরুল ইসলামের সঙ্গে এর আগে টেস্ট না খেলা তাসকিন, শুভাশিসকে রেখে চমকই দিয়েছিল টিম ম্যানেজমেন্ট। তাঁরা হতাশ করেননি। ফিল্ডিংয়ে হতাশা: পুরো সিরিজে বাংলাদেশের ফিল্ডাররা নিশ্চিত ক্যাচ ছেড়েছেন ২০টি। নিউজিল্যান্ডে বাংলাদেশের ফিল্ডিং কেমন ছিল, সেটা বিস্তারিত না বললেও চলে। এককথায় ফিল্ডিং ছিল চরম হতাশাজনক। অনেক ক্যাচ ফিল্ডারদের হাত ফসকে গেছে, ফ্লাইট বোঝায় সমস্যা ছিল, অনেক ক্যাচে ফিল্ডার বলের নিচেই যেতে পারেননি। গ্রাউন্ড ফিল্ডিংয়েও ছিল প্রচুর ভুল। অভিজ্ঞ একজন দামি ফিল্ডিং কোচ বহন করেও এই ব্যর্থতা মানা কঠিন। অবশ্য বাংলাদেশ দলের পুরো কোচিং প্যানেলটাই ব্যয়বহুল। পুরো সিরিজটাও। প্রধান কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহের পরামর্শে নিউজিল্যান্ডে আসার আগে প্রায় কোটি টাকা ব্যয়ে সিডনিতে হয়েছে অনুশীলন ক্যাম্প। প্রাপ্তি কী, সেটা বিসিবি এবং কোচই ভালো বলতে পারবেন।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.