ফরহাদ। বয়স ৩০ বছর। ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে রোগী হিসেবে ভর্তির রেজিস্ট্রেশন নম্বর-২৬৩২৪/৮। সংঘর্ষে জখম হয়ে তিনি গত ডিসেম্বরে ভর্তি হন হাসপাতালে। মামলার জন্য তার জরুরি মেডিকেল সনদ প্রয়োজন। কিন্তু মেডিকেল সার্টিফিকেট নিতে তাকে প্রায় দু’মাস হাসপাতালে ঘুরতে হয়েছে। ফলে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাও মেডিকেল সার্টিফিকেট হাতে না পাওয়ায় কাজ এগুতে পারছেন না। ১৯শে জানুয়ারি মেডিকেলে সার্টিফিকেট নিতে আসেন রোগীর এক আত্মীয়। সনদ না পেয়ে হাসপাতালের পরিচালকের পিএ-র কক্ষে অফিস সহায়কদের সঙ্গে চরম হট্টোগোলে জড়িয়ে পড়েন তিনি। ক্ষুব্ধ কণ্ঠে তিনি বলেন, সার্টিফিকেট নিতে তাদের ঘুরাচ্ছে সংশ্লিষ্টরা। দেই, দিচ্ছি। কেউ বলছেন সার্টিফিকেট রেকর্ডরুমে। আবার রেকর্ডরুমে গেলে বলছেন পরিচালকের কাছে। রোগীর স্বজন অভিযোগ করেন, এই হাসপাতালে বৈধ মেডিকেল সার্টিফিকেট নিতে ভোগান্তিতে পড়তে হয় রোগীকে। কিন্তু অবৈধ সনদ পেতে কোনো সমস্যায় পড়তে হয় না। ‘কিছু’ দিলেই সহজে পাওয়া যায়। রোগী ফরহাদের গ্রামের বাড়ি শেরপুর জেলার নকলা থানায়। এই ভুক্তভোগী মারামারির ঘটনায় নকলা থানায় ২রা ডিসেম্বর একটি মামলাও করেছেন বলে মেডিকেল সার্টিফিকেট সূত্রে জানা যায়। ১৯শে জানুয়ারি রোগীর স্বজনের হট্টগোলের পর ওইদিনই দ্রুত সার্টিফিকেট ইস্যু করা হয়। এ প্রসঙ্গে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মো. জহুর আলী মানবজমিনকে বলেন, মেডিকেল সার্টিফিকেট পেতে আমরা সরকারি ডাক মারফত আবেদন করেছি। বাদী তদবির করলে একটু দ্রুত সার্টিফিকেট পেতে পারে। অন্যথায় বছরের পর বছর আবেদন পড়ে থাকে হাসপাতালে। এজন্য বাদীরা সেখানে যান। শুধু ফরহাদ নন, মাসে শত শত আবেদনকারীকে এভাবে সঠিক মেডিকেল সার্টিফিকেট নিতে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয় ঢামেক হাসপাতালে। সঠিক মেডিকেল সার্টিফিকের জন্য রোগীকে ঘুরতে হয় মাসের পর মাস। এমনকি বছরের পর বছরও। আর সময় মতো মেডিকেল সার্টিফিকেট না পাওয়ায় দীর্ঘদিন মামলাও ঝুলে থাকে বলে ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেছেন। হাসপাতালের কেন্দ্রীয় রেকর্ডরুম সূত্র জানায়, সঠিকভাবে মেডিকেল সার্টিফিকেট নিতে মাসে তিন শতাধিক আবেদন জমা পড়ে। কিন্তু শতকরা ১০টিও সনদ দেয়া যায় না। কারণ, সংশ্লিষ্টদের গাফিলতি। এজন্য প্রকৃত রোগী বা রোগীর স্বজনকে মাসের পর মাস হয়রানির শিকার হতে হয়। ফলে অনেকে দুই নম্বরী পথও বেছে নেন। হাসপাতালের পরিচালক এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের বারবার চিঠি দিয়েও কাজের গতি আনতে পারেনি বলে প্রশাসন সূত্র জানিয়েছে। এদিকে, মেডিকেল সার্টিফিকেট পুলিশের আইও নেয়ার কথা থাকলেও পুলিশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা নিজে যোগাযোগ করে অনেক সময় রোগীকে বা তার স্বজনকে হাসপাতালে পাঠান। ফলে সার্টিফিকেট নিতে এসে রোগীর লোক এভাবে হয়রানির শিকার হন। সূত্র জানায়, অনেক সময় ভুয়া মেডিকেল সার্টিফিকেটও দেয়া হয়। হাসপাতালের একশ্রেণীর ডাক্তার ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে এ কাজ হরহামেশাই ঘটছে। উপযুক্ত তদারকি ও শাস্তি না পাওয়ায় ভুয়া সার্টিফিকেট কেনাবেচার সংঘবদ্ধ চক্রটি বেপরোয়া এখানে। হাসপাতালের মেডিকেল রেকর্ড সেন্টারের সূত্রমতে, প্রতি মাসে গড়ে ৮ থেকে ১০টি ভুয়া সার্টিফিকেট যাচাই করার বিষয়ে তাদের কাছে কাগজপত্র আসে। এসব সার্টিফিকেটের বেশির ভাগ মারামারি, সংঘর্ষ এবং যৌতুক নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর নির্যাতনের ঘটনা। সূত্র জানায়, এসব ভুয়া সার্টিফিকেট দেখিয়ে থানায় খুন, ধর্ষণ ও নির্যাতনসহ বিভিন্ন মামলা করা হচ্ছে। পরে এসব মামলায় বিজ্ঞ বিচারকের সন্দেহ হওয়ায় সার্টিফিকেটগুলোর সত্যতা যাচাইয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হাসপাতালের বহির্বিভাগ, জরুরি বিভাগ ও ভেতরে ভুয়া সার্টিফিকেট বিক্রির জন্য মক্কেল ধরতে ওত পেতে থাকে চক্রের সদস্যরা। সংঘর্ষ অথবা নির্যাতনের ফলে আহত কেউ হাসপাতালে ভর্তি হলে তারা প্রথমে সহযোগিতার ভান করে রোগী ও স্বজনদের সঙ্গে খাতির জমায়। মামলা করার ইচ্ছে রয়েছে জানতে পারলেই মেডিকেল সার্টিফিকেট পাইয়ে দেয়ার কথা বলে চুক্তি করে। মেডিকেল ইনজুরি সার্টিফিকেট দুই ধরনের সিম্পল কাট ও সার্প কাট (সাধারণ ও গুরুতর জখম) হয়ে থাকে। সার্টিফিকেট ভেদে মক্কেলের কাছ থেকে সর্বনিম্ন এক হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা নিয়ে থাকেন তারা। পরে বিভিন্ন বিভাগের চিকিৎসকের নাম, পদবি ও স্বাক্ষর নকল করে মেডিকেল সার্টিফিকেট দেয়া হয়। আউটডোর, ইনডোর, রিলিজ সার্টিফিকেট ও কাগজপত্রে একজন পাস করা চিকিৎসকের মতোই রোগীর চিকিৎসার বিবরণ লেখা থাকে; যা দেখে সহজে বোঝার উপায় থাকে না যে সার্টিফিকেটটি ভুয়া। সূত্র জানায়, ঢামেকের জরুরি বিভাগের এক কর্মচারী ও স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (মিডফোর্ট হাসপাতাল) চতুর্থ শ্রেণির এক কর্মচারী মিলে শক্তিশলী সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে। এ প্রসঙ্গে ঢামেক হাসপাতালের উপপরিচালক পরিচালক (প্রশাসন) ডা. খাজা আবদুল গফুরের কাছে জানতে চাইলে তিনি মেডিকেল সার্টিফিকেট ইস্যুতে দেরি হাওয়ার কথা স্বীকার করেন। যেটা জট হয়েছে সেটা অল্প সময়ের মধ্যে সমাধান করে ফেলার আশা করছেন তিনি। সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের সার্টিফিটে দেরিতে ইস্যু করার কারণ কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, মামলায় সাক্ষ্য দেয়ার বিড়ম্বনা এড়াতে এটা হয়। এজন্য দেরি হয়। আবার ওই চিকিৎসক যদি বদলি হয়ে যান। এছাড়া চিকিৎসকরা অনেক সময়ে আপারেশন রুমে থাকেন। রাউন্ডে থাকেন। সার্টিফিকেট দেয়ার নির্দিষ্ট কোনো সময় বেঁধে দেয়া নেই বলে তিনি উল্লেখ করেন। আবেদন পুলিশের মাধ্যমে হবে। ভুয়া সার্টিফিকেট ইস্যু করার দায়ে আড়াই বছর আগে একজন চিকিৎসককে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। গত বছরও ভুয়া সার্টিফিকেট ইস্যু করার দায়ে অপর এক চিকিৎসকে বদলি করা হয়েছে। এরকম ঘটনা নজরে এলে আমারা ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। এসব বিষয়ে হাসপাতাল প্রশাসন তৎপর রয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.