সরকারের মোট রাজস্ব আয়ের ৪০ শতাংশের বেশি আদায় হয় চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের মাধ্যমে। আবার কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে এ প্রতিষ্ঠানেই সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি আর অবৈধ অর্থের লেনদেন হচ্ছে। রাজস্ব আদায় নয়, নিজের পকেট ভারি করাই এখানকার ৯০ শতাংশ কর্মকর্তা-কর্মচারীর প্রধান লক্ষ্য। এ জন্য পণ্য শুল্কায়নে পদে পদে হয়রানি এখানে নৈমিত্তিক ঘটনা। চলছে বহুমুখী অনিয়ম, দুর্নীতি আর জালিয়াতি। কাস্টমস কর্মকর্তাদের অনৈতিক চাহিদা মেটাতে পণ্য আমদানির পর খালাস পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়ায় আমদানিকারকদের পোহাতে হচ্ছে চরম ভোগান্তি। যে কোনো ধরনের পণ্য খালাসে গুনতে হয় লাখ লাখ টাকার ঘুষ। কাস্টমসের ভাষায় যা ‘স্পিড মানি’। বিশেষ করে আমদানি শাখায় প্রকাশ্যে চলে ঘুষের লেনদেন। প্রতিটি বিল অব অ্যান্ট্রির জন্য দিতে হয় নির্দিষ্ট অংকের ঘুষ। তা না হলে নথি নড়বে না। পণ্য খালাস জটিল হবে। আবার পণ্য চালানের একটি বড় অংশ আমদানি হয় কাস্টমস কর্মকর্তাদের সঙ্গে আগে থেকে গোপন সমঝোতার ভিত্তিতে। কিছু বড় চালানে কায়িক পরীক্ষায় অনিয়ম-জালিয়াতি ধরা পড়লেও তা অর্থের বিনিময়ে বৈধ হয়ে যায়। আর এভাবে অবৈধ পণ্য খালাসের সুযোগ দিয়ে নন-ক্যাডার কর্মকর্তারা আয় করেন মাসে কমপক্ষে ৫ থেকে ৫০ লাখ টাকা। আর ক্যাডার কর্মকর্তারা পদ ও দায়িত্বভেদে আয় করেন সর্বনিু ৫০ লাখ টাকা থেকে শুরু করে কয়েক কোটি টাকা পর্যন্ত। ভুক্তভোগীরা বলছেন, ঘুষ ছাড়া কাস্টম হাউসে কোনো কাজ হয় না। ঘুষ নেই, নথিতে স্বাক্ষরও নেই, পণ্য থাকবে পণ্যের জায়গায়। ঘুষ ছাড়া পণ্য খালাসের চিন্তা করাও যেন এখানে অপরাধ! যুগান্তরের দীর্ঘ অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী এভাবে প্রতি মাসে দুর্নীতির স্বর্গরাজ্য চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে শত কোটি টাকারও বেশি অবৈধ অর্থ লেনদেন হচ্ছে। হাতেগোনা দু-একজন শীর্ষ কর্মকর্তা শতভাগ সৎ হলেও অধিকাংশ কর্মকর্তাই এভাবে সরকারের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে নিজেদের আখের গোছাচ্ছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কাস্টমস যেখানেই আপস করে, সেখানেই দুর্নীতি হয়। দুর্নীতি না করলে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে পণ্য আমদানি-রফতানি করবে, শুল্ক ফাঁকি দেবে- এমন সাধ্য কারও নেই। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ- চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে পণ্য চালান শুল্কায়ন করে বন্দর থেকে ডেলিভারি নিতে বারবার ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে। পদে পদে হয়রানি আর ঘুষ-বাণিজ্য ছড়িয়ে পড়ায় আমদানি-রফতানিকারকরা তাদের পণ্য নিয়ে বিপাকে পড়ছেন হরহামেশাই। আমদানিকারকরা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাছে বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ করলেও আশ্বাস ছাড়া তেমন কোনো সুফল মেলেনি। বন্ধ হয়নি ঘাটে ঘাটে ঘুষ, অনিয়ম ও দুর্নীতি। যদিও অনিয়ম, দুর্নীতি রোধে অটোমেশন পদ্ধতির প্রচলন করা হলে অর্ধেকের বেশি ঘুষের টেবিল কমেছে। আগে পণ্য খালাসে ৪২ ঘাটে ঘুষ দিতে হতো। এখন তা ২০-এ নেমে এসেছে। তবে টেবিল কমলেও কমেনি ঘুষের অংক। এ জন্য দায়ী করা হচ্ছে সমস্যা সমাধানে এনবিআরের নীতিনির্ধারকদের অহেতুক সময়ক্ষেপণকে।
তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অনিয়ম ও দুর্নীতি বাড়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে- শুল্কায়ন প্রক্রিয়া পুরোপুরি অটোমেশন না হওয়া, দুর্নীতি প্রতিরোধক রিস্ক ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম চালু না থাকা, কার্যকর পোস্ট ক্লিয়ারেন্স অডিট ব্যবস্থা চালু না থাকা, শুল্কায়ন প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা ও পর্যাপ্ত দক্ষ জনবল না থাকা। পূর্ণাঙ্গ অটোমেশন না হওয়ায় ঘাটে ঘাটে ঘুষ দিয়ে কাজ করাতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। ২০১৪ সাল থেকে কাস্টম হাউস এসাইকুডা ওয়ার্ল্ডের আওতায় এসেছে। কিন্তু সার্ভারে সমস্যা হওয়ায় প্রায়ই ব্যাহত হচ্ছে শুল্কায়নের কার্যক্রম। নিলাম, বন্ড ও ল্যাবের মতো গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরগুলো এখনও আসেনি পূর্ণাঙ্গ অটোমেশনের আওতায়। এ অবস্থায় ঘুষ-দুর্নীতিসহ নানা কারণে ব্যবসায়ীদের কাছে রীতিমতো ‘আতংক’ হয়ে দাঁড়িয়েছে এখানকার কাস্টমস।
চার প্রক্রিয়ায় শুল্ক ফাঁকি : অনুসন্ধানে জানা গেছে, চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে চার প্রক্রিয়ায় শুল্ক ফাঁকির মহোৎসব চলছে। প্রথমটি হল পণ্যমূল্যে ফাঁকি। অর্থাৎ পণ্যের মূল্য কম-বেশি প্রদর্শন করা। দ্বিতীয় প্রক্রিয়া হল পণ্যের গুণগত মান নিয়ে জালিয়াতি। তৃতীয় প্রক্রিয়া হচ্ছে পরিমাণ ও ওজনে কম দেখানো। আর চতুর্থ প্রক্রিয়া পণ্যের এইচএস কোড জালিয়াতি। তবে এর সবই বেশি ঘটে বাণিজ্যিক প্রয়োজনে আনা আমদানি পণ্যের ক্ষেত্রে। প্রতিটি রাজস্ব অনিয়মের সঙ্গেই অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত। ব্যবসায়ীরা চট্টগ্রাম কাস্টমসের রাজস্ব ফাঁকির প্রধান কারণ হিসেবে ঘুষ-দুর্নীতিকেই দায়ী করেছেন। এমনও গুজব আছে- কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সকালে অফিসে ঢোকেন খালি হাতে, আর সন্ধ্যায় বাসায় ফেরেন লাখ টাকা নিয়ে বা কোটি টাকার নিশ্চয়তা পেয়ে। এভাবে কাস্টমসের অসাধু কর্মকর্তারা ফুলেফেঁপে উঠলেও বিপুল অংকের রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শত শত কোটি টাকার শুল্ক ফাঁকি ধরা পড়লেও এর সঙ্গে জড়িত কাস্টমস কর্মকর্তাদের শাস্তি তো দূরের কথা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদের অভিযুক্তও করা হয় না। গত এক বছরে শুল্ক ফাঁকির দায়ে একজন কাস্টমস কর্মকর্তা চূড়ান্ত শাস্তি পেয়েছেন এমন নজির নেই। জনবল সংকটের অজুহাতে সবাই পার পেয়ে যান। আর এ সুযোগে দুর্নীতি উৎসাহিত হচ্ছে। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা শুধু ‘কারণ দর্শানো নোটিশ’-এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। নোটিশের জবাব দিলেই যেন সব অপরাধ মাফ।
ক্যাডার কর্মকর্তারাই খলনায়ক : এদিকে চট্টগ্রাম কাস্টমসে ঘুষের নামে স্পিড মানি নিত্যকার ঘটনা হলেও আসল লেনদেন হয় পর্দার আড়ালে। কাস্টমসের ক্যাডার কর্মকর্তারাই এখানে প্রধান ‘খলনায়ক’। গোপন সমঝোতায় লেনদেন হয় কোটি কোটি টাকা। পণ্যভেদে এ অংক শত কোটি টাকাও ছাড়িয়ে যায়। একাধিক কর্মকর্তা এ প্রক্রিয়ায় জড়িত থাকেন। এ সুযোগে এক শ্রেণীর আমদানিকারক দিনকে রাত, আর রাতকে দিন বানিয়ে নিজেদের আখের গোছান। এক পণ্য ঘোষণার আড়ালে চলে আসে আরেক পণ্য। কম মূল্যের পণ্যের স্থলে বেশি দামি বা বেশি চাহিদার পণ্য। যাতে লাভ অনেক বেশি। কাস্টমস সহায় থাকলে ঝুঁকি অনেক কম। এতে উভয় পক্ষই বড় অংকের সুবিধা পেয়ে সরকারের রাজস্ব আত্মসাতে সহায়তা করে বলে দাবি করেছে দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র।
আমদানিকারক, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টসহ ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে ঘুষ নেন না এমন কর্মকর্তা খুব কমই আছেন। সহকারী কমিশনার থেকে শুরু করে এডিশনাল কমিশনার পর্যন্ত সব স্তরের কর্মকর্তাই কম-বেশি ঘুষ নেন। তবে যুগ্ম কমিশনার থেকে শীর্ষ পর্যায়ে হাতেগোনা কয়েকজন কর্মকর্তা আছেন যারা একবারেই ঘুষ নেন না। তাদের ভয়ে অন্যরা থাকেন তটস্থ। অসাধু কর্মকর্তাদের কেউ মিডিয়ার মাধ্যমে কেউবা আবার সরাসরি ঘুষের টাকা নেন। কাস্টমসে দায়িত্ব পালনকারী সিংহভাগ কর্মকর্তা নানা ছল-ছুতোয় ঘুষ নিয়ে থাকেন আমদানিকারকদের কাছ থেকে। সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট ও কাস্টমসে কর্মরত রাজস্ব কর্মকর্তা, সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা, উচ্চমান সহকারী ও বিভিন্ন সেকশনে নিয়োজিত ‘ফালতু’দের মাধ্যমেই ঘুষের টাকা আদায় করেন তারা। তবে ঘুষ প্রদানকারী বা ভুক্তভোগী কেউই ‘ঘুষখোর’ কাস্টমস কর্মকর্তাদের বিষয়ে প্রকাশ্যে কথা বলতে চান না বা নাম প্রকাশ করতে চান না। তারা বলছেন, তা যদি হয় তবে আর ব্যবসা-বাণিজ্য করতে হবে না। তাদের কোনো ফাইল অনুমোদন হবে না। হয়রানি-ভোগান্তি আরও বাড়বে।
সোনার খনি : নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়ী নেতার মতে, রীতিমতো ‘মগের মুল্লুকে’ পরিণত হয়েছে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস। আমদানি পণ্য খালাসে সর্বনিু থেকে সর্বোচ্চ ধাপ পর্যন্ত ঘুষ নির্ধারিত থাকে। আর এই অবৈধ অর্থ বিলিবণ্টন হয় সর্বোচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে। কাস্টমস কর্মকর্তাদের জন্য চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস যেন ‘সোনার খনি।’ রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য হেন কোনো কাজ নেই যা কাস্টমস কর্মকর্তারা করেন না। অযৌক্তিক মনগড়া শুল্কায়ন করে যে কোনোভাবেই হোক রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জনই কর্মকর্তাদের প্রধান লক্ষ্য। আমদানিকারকরা এ কারণে এখানে অসহায়। এ সুযোগ কাজে লাগানোর কারণে অবৈধ অর্থের লেনদেনের পরিমাণও অনেক বেড়ে যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, আমদানিকারকরা একটি চালানে যদি ১ লাখ টাকা ঘুষ দেন তাহলে এর কমপক্ষে ১০ গুণ বেশি রাজস্ব ফাঁকি দেন। এ হিসাবে প্রতি মাসে চট্টগ্রাম কাস্টমসের মাধ্যমে অবৈধ লেনদেন শত কোটি টাকাও ছাড়িয়ে যায়। আর এ সুযোগে রাজস্ব ফাঁকি হয় হাজার কোটি টাকারও বেশি। অবিশ্বাস্য হলেও বিষয়টি ওপেন সিক্রেট। একদিকে আমদানিকারকরা লাভবান হন। অপরদিকে পিয়ন থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা কোটিপতি থেকে শত কোটি টাকার সম্পদের মালিক হন। এ জন্য রাজস্ব প্রশাসনের কর্মকর্তাদের একবার হলেও এই কাস্টম হাউসে চাকরি করার স্বপ্ন থাকে। আর যারা ভাগ্যবান তারা বারবার এখানে নিয়োগ পান। এ জন্য তাদের বিনিয়োগ করতে হয় পদভেদে লাখ টাকা থেকে কোটি টাকা। নিয়োগ পেয়েই তাদের মনোযোগ থাকে অর্থের দিকে। সরকারের দেয়া দায়িত্ববোধ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এভাবে বিক্রি হয়ে যায়। তবে কাস্টমসের শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন সৎ কর্মকর্তার তৎপরতায় এখন পর্যন্ত প্রত্যাশিত রাজস্ব আদায় করা যাচ্ছে। অথচ সংশ্লিষ্টদের দাবি, এর চেয়ে অনেক বেশি রাজস্ব আয় হবে যদি কাস্টমসের ঘুষ, দুর্নীতি আর অবৈধ ‘কমিশন বাণিজ্য’ বন্ধ হয়।
বড় লেনদেন পর্দার আড়ালে : এ নিয়ে অনুসন্ধানকালে পাওয়া গেছে চমৎকার তথ্য। বড় বড় ঘুষ বা অর্থের লেনদেন হয় পর্দার আড়ালে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার ঘনিষ্ঠ বা বিশ্বস্তরাই এ কাজটি করে থাকেন। সহকারী কমিশনার থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত অবৈধ লেনদেন সমঝোতায় বিশ্বস্ত রাজস্ব কর্মকর্তা বা সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তারাও জড়িত থাকেন। সবকিছু ঠিক থাকলে লেনদেন হয় কাস্টম হাউসের বাইরে বা তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে। এ লেনদেন হয় নগদ বা চেকে। এরপর সিগন্যাল পেলেই কর্মকর্তা ফাইল ছাড়েন। অনুমোদন করে দেন আমদানিকারকের পক্ষের প্রস্তাব। তা না হলে বিভিন্ন প্রশ্ন বা ‘কোয়ারি’র কথা ফাইলে লিখে দেন। বিভিন্ন পরীক্ষার কথা বলেন। যা নিয়মের মধ্যেই পড়ে। কিন্তু এতে আমদানিকারকের ঘুম হারাম হয়ে যায়। বন্দরে পণ্য চালানের ডেমারেজ বাড়ে। ব্যাংকের সুদ বাড়ে। সময়মতো সরবরাহ চালান ডেলিভারি না পেলে লোকসানের ঝুঁকি থাকে। সবকিছু মিলিয়ে কর্মকর্তার দাবির মুখে নতি স্বীকার না করে উপায় থাকে না কারোর। এ ক্ষেত্রে আমদানিকারকের পক্ষে লেনদেন সমঝোতার কাজটি সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টই করে থাকে। এতে লাভ থাকে উভয় পক্ষের।
চালানভেদে ঘুষের হার : নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ব্যবসায়ী জানান, আমদানি চালান অনুযায়ী ঘুষের হার ভিন্ন ভিন্ন থাকে। একটি কনসাইনমেন্ট কাস্টমস থেকে রিলিজ করতে ঘুষের পরিমাণ গড়ে ক্ষেত্রবিশেষে ১০ হাজার টাকা থেকে কয়েক লাখ টাকা ছাড়িয়ে যায়। টেক্সটাইল মেশিনারিজ, কাগজ ও মন্ড, কসটিক সোডা, প্লাস্টিক মোল্ডিং কম্পাউন্ড, হার্ড বোড বা ডুপ্লেক্স বোড, পার্টস ও মেশিনারিজ, টিনপ্লেট, কাঠ, গুঁড়াদুধ, এসিড, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ইত্যাদির ক্ষেত্রে ঘুষ দিতে হয় ২৫ থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত। ৫ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয় লিফট, বিভিন্ন ফলদদ্রব্য, প্লাস্টিকজাতীয় দ্রব্য, বিভিন্ন প্রকার তেল, গার্মেন্ট এক্সেসরিজ, তুলা, সুতা, ফিল্ম সরঞ্জাম কেমিক্যাল, খাদ্যশস্য ইত্যাদি পণ্যের ক্ষেত্রে। জাহাজ এবং কনটেইনার কোম্পানিগুলোকে ঢাকার আইসিডিতে পণ্য নিতে সর্বনিু ৩ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়। আর বাল্ক কার্গোর ক্ষেত্রে ঘুষ গুনতে হয় টনপ্রতি পণ্যে।
চেম্বার নেতারাও ক্ষুব্ধ : চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে পণ্য চালান খালাসে ঘুষের ঘটনায় ব্যবসায়ী নেতারাও ক্ষুব্ধ। এর মধ্যে চট্টগ্রাম চেম্বার সভাপতি মাহবুবুল আলম মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, কাস্টম হাউসে লাখ লাখ টাকার ঘুষের লেনদেন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। নানা ছলছুতোয় অসাধু কর্মকর্তারা আমদানিকারকদের ফাঁদে ফেলে ঘুষ আদায় করেন। বিভিন্ন সময়ে চেম্বারের তরফ থেকে সরকারের উচ্চপর্যায়ে কাস্টমসে ঘুষের লেনদেন বন্ধ করার জন্য বলা হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। কেবল কাস্টমস কর্মকর্তারাই যে ঘুষ আদায় করেন তা নয়; অনেক অসাধু আমদানিকারক ও ব্যবসায়ী আছেন যারা নিজেদের স্বার্থে সরকারি রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে পণ্য ছাড় করেন। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে ঘুষ নেন কাস্টমস কর্মকর্তারা। তিনি আরও বলেন, জাতীয় রাজস্বের বড় একটি অংশের জোগানদানকারী চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে ঘুষ-দুর্নীতি বন্ধে সরকারের শীর্ষ মহলকে এখন থেকেই ভাবতে হবে। নয়তো ঘুষের জাঁতাকলে পিষ্ট সাধারণ আমদানিকারকরা প্রতিযোগিতার বাজারে টিকতে না পেরে ব্যবসা-বাণিজ্য গুটিয়ে নিতে বাধ্য হবেন। যা দেশের সার্বিক অর্থনীতি ও অগ্রগতির জন্য কখনোই মঙ্গলজনক হবে না।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন চেম্বারের সহসভাপতি ও বিজিএমইএ’র পরিচালক এএএম মাহবুব চৌধুরী মঙ্গলবার বিকালে যুগান্তরকে বলেন, বিজিএমইএ’র এক সদস্যের আমদানি করা কাপড়ের একটি চালান ল্যাব টেস্টের নামে আটকে রাখা হয় ১৫ দিন ধরে। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের ল্যাবে এই পণ্য টেস্ট করা হলেও ফলাফলে সন্তুষ্ট হতে না পারায় তা টেস্টের জন্য পাঠানো হয় ঢাকায়। অথচ উৎকোচ দিলে এই চালান অনেক আগেই ছাড় হতো। ল্যাব টেস্টেও উত্তীর্ণ হতো। তিনি বলেন, এই পণ্যের নমুনা রেখে চালানটি ছাড় করার অনুরোধ জানানো হয় কাস্টমসকে। টেস্টে ঘোষণাবহির্ভূত কিছু পেলে সে ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় রাজস্ব আদায় করার সুযোগ আছে। কিন্তু সেটিও মানতে নারাজ কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। মূলত কাস্টমসের কিছু অসাধু কর্মকর্তা এভাবে পণ্য আটকে রেখে হয়রানি করছেন অমাদানিকারকদের।
একই ধরনের অভিযোগ এনেছেন সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট কর্মচারী ইউনিয়নের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নেতা। ইন্টেরিয়র ডেকোরেশনে ব্যবহƒত হয় এ রকম দুই কনটেইনার এমডিএফ বোড আমদানি করা হয় চীন থেকে। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের টেস্টে পণ্যের ঘোষণা অনুযায়ী রিপোর্টও আসে। কিন্তু উন্নত ল্যাবে টেস্টের কথা বলে পণ্যের নমুনা পাঠানো হয় ঢাকায়। এক মাস ধরে ফাইলটি নিয়ে ঘোরাচ্ছেন কাস্টমসের অসাধু কর্মকর্তারা। ঘুষ না দেয়ার কারণেই এমন হয়রানি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন এ সিঅ্যান্ডএফ কর্মচারী নেতা।
সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের এক নম্বর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কাজী মাহমুদ ইমাম বিলু কাস্টম হাউসে ঘুষের লেনদেন প্রসঙ্গে যুগান্তরকে বলেন, কাস্টমসের ক’জন কর্মকর্তা ঘুষ নেন না তা হাতে গুনে বলা যাবে। কিন্তু ক’জন কর্মকর্তা ঘুষ নেন তা বলা মুশকিল। কারণ কর্মরত বেশিরভাগ কর্মকর্তাই ঘুষ ছাড়া কিছুই বোঝেন না। সুনির্দিষ্ট করে কোনো কর্মকর্তার নাম উল্লেখ না করে তিনি বলেন, আমদানিকারক, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সংশ্লিষ্ট সবাই ‘ঘুষখোর’ কর্মকর্তাদের এক নামে চেনেন। এটা অনেকটা ওপেন সিক্রেট। মাসে বা বছরে কী পরিমাণ ঘুষের লেনদেন হয় কাস্টম হাউসে এর সঠিক কোনো পরিসংখ্যান দিতে না পারলেও এই সিঅ্যান্ডএফ নেতা বলেন, চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে ঘুষ লেনদেন ও রাজস্ব ফাঁকির পরিমাণ ‘অকল্পনীয়’।
কাস্টম হাউসে ঘুষের লেনদেন ও আমদানিকারকদের হয়রানির অভিযোগ প্রসঙ্গে জানার জন্য চট্টগ্রাম কাস্টমস কমিশনার এএফএম আবদুল্লাহ খানের সঙ্গে সেল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করলে ফোন রিসিভ না করায় তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। রোববার বিকাল ৫টা ৫৫ মিনিট ও সন্ধ্যা ৬টা ৩০ মিনিটে ফোন দিলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। যুগান্তরের পরিচয়ে ক্ষুদেবার্তা পাঠানো হলেও তিনি সাড়া দেননি। তবে এর আগে তার কার্যালয়ে কাস্টমস কমিশনার ঘুষ লেনদেন ও হয়রানি প্রসঙ্গে যুগান্তর প্রতিবেদককে বলেন, ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো কর্মকর্তা আমদানিকারকদের হয়রানি করছেন তা ঠিক নয়। তাছাড়া কাস্টমসের কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ঘুষ গ্রহণের সুনির্দিষ্ট অভিযোগও তার কাছে নেই। থাকলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেবেন।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.