তাঁদের ঘুম ভাঙে বারুদের গন্ধে। রক্তের দাগ মুছে আবারও নিত্যদিনের কাজ শুরু হয়। যুদ্ধের সঙ্গে মিতালি করেই প্রতিদিন ওঁদের বেঁচে থাকা। ইরাকের গাজওয়া ইসমাইল, সিরিয়ার খালিদ ফিরোসি, লিবিয়ার মাজিদি আবরগিবারা যেন এক মোহনায় দাঁড়িয়ে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ থেকে আন্তর্জাতিক সলিডারিটি আর্চারি চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নিতে এঁরা সবাই এখন ঢাকায়। ইরাকে আর্চারির অনুশীলনের সুযোগ-সুবিধা তেমন নেই বললেই চলে। ফাঁকা মাঠেই অনুশীলন করেন আর্চাররা। কখনো কখনো পাশ দিয়ে প্রচণ্ড গতিতে ছুটে যায় অস্ত্রবোঝাই গাড়ি। চারপাশের হট্টগোল, কান্নাকাটি আর নোংরা পরিবেশেই করতে হয় অনুশীলন। এমনও হয়েছে যে আর্চাররা যেখানে অনুশীলন করছেন তার ঠিক ১০০ মিটার দূরেই হঠাৎ বোমাবর্ষণ শুরু হয়ে গেল। তারপরও আর্চারিকে ভালোবেসে খেলাটা চালিয়ে যেতে চান গাজওয়া। বাগদাদকে অবশ্য এখন নিরাপদ শহর বলেই দাবি করলেন গাজওয়া, ‘আলহামদুলিল্লাহ, বাগদাদের অবস্থা অন্য শহরের তুলনায় অনেক ভালো।’ তবুও গত বছরে আরব লিগে চ্যাম্পিয়ন গাজওয়ার চোখে-মুখে দেখা যায় আতঙ্কের ছায়া, ‘আমি কখনো বোমা হামলার মধ্যে পড়িনি। তবে যখন ঘর থেকে বের হই, মনে হয় আবারও নিরাপদে ফিরতে পারব কি না জানি না।’ ইরাক থেকে এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছেন পাঁচজন পুরুষ ও দুজন মহিলা আর্চার। গাজওয়া পদকের জন্য লড়বেন মেয়েদের রিকার্ভ বো ইভেন্টে। গাজওয়ার বাবা প্রকৌশলী, মা শিক্ষিকা। খেলার প্রতি এমনই টান যে কোনো কিছুই দমিয়ে রাখতে পারে না গাজওয়াকে, ‘আমি চাকরি করি না। সপ্তাহে তিন দিন অনুশীলন করার সুযোগ পাই। এভাবেই গত বছর আরব লিগে চ্যাম্পিয়ন হয়েছি।’ জানালেন, পুরো বাগদাদ শহরে মাত্র পাঁচজন মেয়ে আর্চার রয়েছে। ইরাকের দলনেতা মোহাম্মদ আলী ফাইয়াদ আর্চারদের লড়াকু মনোভাবের প্রশংসাই করলেন, ‘এই আর্চারদের ভয়ডর খুব কম। একবার খোলা মাঠে আমরা অনুশীলন করছিলাম, হঠাৎই যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল অনুশীলন মাঠের ১০০ মিটার দূরে। বাধ্য হয়ে অনুশীলন বন্ধ করে নিরাপদ জায়গায় আশ্রয় নিই। আমরা ভয়কে জয় করতে শিখেছি।’ লিবিয়ার আর্চারি ফেডারেশনের অবস্থা ইরাকের চেয়েও খারাপ। আর্চাররা সরকারি সহযোগিতা তেমন পান না। ত্রিপোলির একজন মাত্র আর্চার মাজিদি নিয়মিত অংশ নেন বিভিন্ন টুর্নামেন্টে। তাঁকে এবার ঢাকায় এনেছেন দলের ম্যানেজার মোস্তফা রাবা। মওলানা ভাসানী স্টেডিয়ামে দাঁড়িয়ে আর্চারি নিয়ে নিজেদের দুর্দশার কথা বলছিলেন মোস্তফা, ‘আমাদের শহরে যুদ্ধের তেমন ভয়াবহতা নেই। কিন্তু বেনগাজিসহ অন্যান্য এলাকায় এখনো যুদ্ধ চলে। খেলাধুলায় আগ্রহ কমছে মানুষের। তবে আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি আর্চারিটা চালিয়ে যাওয়ার। যদিও আর্চার খুঁজে পাওয়া যায় না। খেলাধুলার ভেতরেই আনন্দ খোঁজার চেষ্টা করি আমরা।’ সিরিয়া থেকে প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছেন তিনজন পুরুষ ও একজন মহিলা আর্চার। দামেস্কের সেলিম আজরাক, লাটাকিয়ার খালিদ হাবিব, আল নাব শহরের বাসিল আল বাতল অংশ নিয়েছেন ছেলেদের রিকার্ভ ইভেন্টে। মেয়েদের রিকার্ভে আছেন আল নাব শহরের ফিরোসি। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ থেকে এসে আর্চাররা এভাবে নিয়মিত খেলতে পারছেন দেখেই খুশি কোচ চাদসান বাকবাক, ‘আসলে যুদ্ধটা বেশির ভাগ সময়ই হয়ে থাকে উপত্যকা অঞ্চলে। শহরে নিরাপদেই আছি আমরা। কিন্তু অনুশীলনে যাতায়াতের সময় একটু ভয়ে থাকি।’ এই আর্চারদের এক বিন্দুতে মিলিয়ে দিয়েছে যুদ্ধ। রক্তে ওঁদের আর্চারির নেশা। এত লড়াই করে যখন পদক জয়ের মঞ্চে ওঠেন এঁরা, জীবনের অন্য সব কষ্ট তখন তুচ্ছ হয়ে যায়।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.