অবশেষে গরিব মায়ের কোলখালি করে অভিনব কায়দায় নবজাতক চুরির মূলহোতাকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছে পুলিশ। বিদেশি প্রকল্প থেকে দরিদ্র অন্তঃসত্ত্বা মায়েদের আর্থিক সহায়তা দেয়ার নাম করে নগরীর উপকন্ঠে শ্যামপুর এলাকার দিনমজুর নাসির উদ্দিনের প্রসূতি স্ত্রীর প্রতি সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয় চক্রটি। তাদের কথামতো গত ১৭ই জানুয়ারি সকাল ১০টার দিকে নওদাপাড়া এলাকার মাতৃসদনে ভর্তিও হন। অতঃপর সন্তান জন্মের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে কৌশলে নবজাতককে নিয়ে পালিয়ে যান। এ ঘটনায় নগরীর শাহ্ মখদুম থানায় দায়ের করা মামলায় একজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে ৮ দিনের চেষ্টার পর গতকাল দুপুরে নগরীর টিকাপাড়া বাসার রোডের ‘সপ্তষি’ নামের ৫০৭ নম্বর বাড়ি থেকে ওই নবজাতকটিকে উদ্ধার করা হয়েছে। এ সময় ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে শাহীন আক্তার শুভ্রা (৩৫) নামের এক নারীকে আটক করেছে পুলিশ। শাহীন আক্তার শুভ্রা একই এলাকার আক্তারুজ্জামনের স্ত্রী এবং একটি বেসরকারি ইউনিভার্সিটিতে কর্মরত। বর্তমানে তিনি মাতৃকালীন ছুটিতে রয়েছেন। পুলিশের ধারণা তিনিই মূলহেতা। তবে ওই নারীর উদ্ধারকৃত নবজাতক তার নিজের বলে দাবি করছে। মতিহার জোনের সহকারী কমিশনার (এসি) সুশান্ত কুমার রায় মানজমিনকে জানান, আটককৃত নারী বাচ্চাটিকে নিজের বাচ্চা বলে দাবি করছে। ডিএনএ পরীক্ষার করা হবে। তারপরে নিশ্চিত হওয়া যাবে বাচ্চাটি আসলেই তার কিনা। সূত্র জানায়, গত ১৯শে জানুয়ারি রাতে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের (রাসিক) সঙ্গে অংশীদারত্বের ভিত্তিতে পপুলেশন সার্ভিসেস অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার (পিএসটিসি) নামের একটি এনজিও পরিচালিত মাতৃসদন থেকে জন্মের মাত্র ৬ ঘণ্টা পর নবজাতকটি চুরি হয়। শুভ্রা নিজেকে একজন এনজিও’র গবেষক পরিচয় দিয়ে গর্ভকালীন থেকেই সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে নবজাতকটির মা মুক্তি খাতুনের (১৮) সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলেন। আর মুক্তিকে নানা পরামর্শ দিতেন নগরীর ডাঁশমারী এলাকার নগর স্বাস্থ্য কেন্দ্রের মাঠকর্মী তহুরা খাতুন। মুক্তির প্রসব বেদনা উঠলে গত ১৭ই জানুয়ারি সকাল ১০টার দিকে তহুরা ও শুভ্রা তাকে নওদাপাড়া এলাকায় ওই মাতৃসদনে ভর্তি করেন। ওইদিন বেলা সাড়ে ৩টার দিকে মুক্তির ছেলে সন্তান জন্ম নেয়। শুভ্রা তার চিকিৎসার খরচ বাবদ তিন হাজার টাকা দেন। এ ছাড়া বাচ্চার জন্য একটি তোয়ালে, কম্বল ও নতুন পোশাক কিনে দেন। পরে রাত সাড়ে ৯টার দিকে কৌশলে তিনি বাচ্চাটি নিয়ে পালিয়ে যান। এ ঘটনায় মুক্তি খাতুনের মা রোজিনা খাতুন বাদী হয়ে নগরীর শাহমখদুম থানায় একটি মামলা করেন।
এ মামলায় পুলিশ কথিত স্বাস্থ্যকর্মী তহুরাকে গ্রেপ্তার করে তিন দিনের রিমান্ডে নেয়। তবে রিমান্ডে তহুরা পুলিশকে জানিয়েছিলেন, বাচ্চা নিয়ে যাওয়া ওই নারীকে তিনি চেনেন না। এরই মধ্যে পুলিশ সিসি ক্যামেরার একটি ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করে। ওই ফুটেজে দেখা যায়, নগরীর বিনোদপুর বাজারে রিকশা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে চলে যাচ্ছেন এক নারী। ফুটেজটি দেখে মুক্তির মা শনাক্ত করেন, এই সেই নারী যিনি বাচ্চা নিয়ে পালিয়েছেন। এরপরই ওই নারীকে ধরতে মাঠে নামে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা। শুক্রবার বেলা ১১টার দিকে ডিবি পুলিশের একটি দল নগরীর বাসার রোড এলাকার ওই বাসাটি ঘিরে ফেলে। এরপর মুক্তি খাতুনের বাবা মুক্তার হোসেন ও মাতৃসদনের চিকিৎসকদের ডেকে পাঠানো হয়। তারা এসে শনাক্ত করেন, এই শুভ্রাই তাদের বাচ্চা চুরি করেন। এরপর দুপুর দেড়টার দিকে পুলিশ শুভ্রাকে প্রথমে বের করে আনে। তাকে একটি মাইক্রোবাসে তোলার পর বাচ্চাটিকে বের করে আনে পুলিশ। এ সময় মহানগর পুলিশের (আরএমপি) উপ-কমিশনার (পূর্ব) আমির জাফর সাংবাদিকদের বলেন, ‘সিসিটিভির ফুটেজে আমরা যে নারীকে দেখেছিলাম এই শুভ্রাই সেই নারী। ফুটেজে আমরা সুভ্রার যে পোশাক, ভ্যানেটি ব্যাগ ও হাতে ঘড়ি দেখেছিলাম, তা এখানে জব্দ করা হয়েছে। চিকিৎসক ও ভুক্তভোগী পরিবারটিও তাকে শনাক্ত করেছে।’ তিনি জানান, বাচ্চাটিকে আপাতত সেফ হোমে রাখা হবে। যথাযথ প্রক্রিয়া শেষে তাকে তার মা-বাবার কাছে হস্তান্তর করা হবে। নবজাতক চুরি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও নগরীর শাহমখদুম থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মতিয়ার রহমান মানবজমিনকে জানান, গ্রেপ্তার শুভ্রার চার-পাঁচ বছর বয়সী এক মেয়ে আছে। তবে ছেলে সন্তান না থাকায় তিনি ৬ মাস আগে থেকেই বাচ্চা চুরির পরিকল্পনা করেছিলেন। সেই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তিনি এই বাচ্চাটিকে চুরি করে লালন-পালন করছিলেন। তিনি আরো বলেন, এই নারী প্রতিদিন বাসা থেকে বের হওয়ার সময় পেটে কাপড় বেঁধে বের হতেন, যাতে মানুষ দেখে বুঝতে পারেন যে, তিনি অন্তঃসত্ত্বা। শুভ্রার ভাড়া বাসার মালিক আমিনুল ইসলাম বলেন, শুভ্রা তার বাড়িতে প্রায় দেড় বছর ধরে ভাড়া থাকেন। তিনি রাজশাহীর একটি বেসরকারি ইউনির্ভাসিটির শিক্ষক। তার স্বামী বাঘায় ডাক্তারি পেশায় কর্মরত। আর শুভ্রার ক্লাস কেজিতে পড়া অহনা নামের একটি মেয়ে রয়েছে। সেই সুবাদে স্বামী আক্তারুজ্জামন বাঘায় থাকেন। আর স্ত্রী শুভ্রা টিকাপাড়া বাসার রোড এলাকায় অবস্থিত আমার বাড়িতে ভাড়া থাকতো। তিনি আরো বলেন, শুভ্রা গর্ভবতী ছিলেন বলে আগেই দাবি করেছিলেন। গত ১৯ কিংবা ২০শে জানুয়ারি রাত আনুমানিক সাড়ে ৯টার দিকে তার একটি ছেলে সন্তান হয় বলেও তিনি আমাদের জানান। এর আগে তারা বাচ্চা হলে বাড়িতে যে সব প্রস্তুতি লাগে, সবই তিনি করেছেন। ছোট-ছোট কাঁথা সেলাই, জামা-কাপড় ইত্যাদি সব তৈরি করেন তিনি। এদিকে চুরি হওয়া শিশুর নানা মুক্তার হোসেন জানায়, আমি বাচ্চা চিনতে পেরেছি, এই বাচ্চাই আমার নাতি। আটক হওয়া নারীই আমার মেয়ের সন্তানটিকে চুরি করে নিয়ে এখন নিজের বলে দাবি করছে।’ চুরি হওয়া নবজাতকের মা চরশ্যামপুর এলাকার দিনমজুর নাসির উদ্দিনের স্ত্রী মুক্তি খাতুন বলেন, ‘চুরির পরে আমি এখনো আমার সন্তানকে দেখিনি। আমাকে খবর দিলো। আমি আমার বাচ্চাটি দেখলে চিনতে পারবো।’
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.