দুই বছর আগের কথা। আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটির (এসিএস) মিটিং হচ্ছে ইন্ডিয়ানাপোলিস (Indianapolis) শহরে। গবেষণাকর্ম উপস্থাপন করতে যাই স্টকহোম থেকে। রসায়নের জন্য সে সম্মেলন জগৎখ্যাত। পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে আসেন নবীন-প্রবীণ গবেষকরা। রসায়নের বিভিন্ন শাখায় কাজ করেন তাঁরা। রসায়নবিদদের সত্যিকারের এক মিলনমেলা। ওখানে গেলেই দেখা মেলে সহস্র মেধাবী মানুষের। তাঁদের মধ্যে খুঁজে বেড়াই বাংলাদেশের সন্তানদের। সেখানেই পরিচয় একজন রসায়নের অধ্যাপকের সঙ্গে, যিনি বাংলাদেশের সন্তান মোহাম্মদ আল-মাসুম। যুক্তরাষ্ট্রের টেনিসি স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের জৈব রসায়ন বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত।
বগুড়ার নামাজঘর নামক স্থানে জন্ম তাঁর। বগুড়া জিলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক এবং সরকারি আজিজুল হক কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষে তিনি ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে। অধ্যাপক তৌফিকুর রহমানের কাছে তাঁর গবেষণার হাতেখড়ি। শিক্ষকের প্রশংসায় তিনি বিগলিত। পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করলেন তাঁকে। তৌফিকুর রহমান পরিচিত ছিলেন শেলি রহমান নামে। বাংলাদেশের একজন কৃতী রসায়নবিদ।
বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃতিত্ব ফলাফল নিয়ে আল-মাসুম কর্মজীবন শুরু করেন বুয়েটে। অল্প সময়ের মধ্যেই, ১৯৮৮ সালে UNESCO ফেলোশিপ নিয়ে গেলেন টোকিও ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে। কাজ করেছেন এক বছর। সেখান থেকে ফিরে মনোবুশাকাগো নিয়ে গেলেন তহুকু বিশ্ববিদ্যালয়ে। ডক্টরাল গবেষণা করেছেন অধ্যাপক ইয়োশিনরি ইয়ামমোটোর সঙ্গে। ১৯৯৬ সালে পিএইচডি শেষ করে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কাজ শুরু করেন সেখানেই। দুই বছর কাজ করে পাড়ি জমান আমেরিকায়। জৈব রসায়নের বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা করেছেন আমেরিকায়। অবশেষে স্থায়ীভাবে অধ্যাপনা ও গবেষণা শুরু করেন টেনিসি স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে।
বাংলাদেশে রসায়ন শিক্ষার দুর্বল অবস্থা তাঁকে ব্যথিত করে। খেদ নিয়ে বললেন, রসায়নের মতো বিজ্ঞানের মৌলিক ও অপরিহার্য বিষয়ে নেই কোনো উন্নতমানের গবেষণা। পিএইচডি ডিগ্রি ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ প্রসঙ্গে উষ্মা প্রকাশ করলেন। বললেন, স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে দেশে উচ্চশিক্ষিতের হার অনেক কম ছিল। তখন শিক্ষক নিয়োগের জন্য পিএইচডি করা শিক্ষার্থী পাওয়া যেত না। কিন্তু এখন পরিস্থিতি অনেক বদলেছে। এখনো সেই নিয়ম ধরে রাখার কোনো অর্থ নেই।
স্বপ্ন দেখেন, একদিন বাংলাদেশ থেকেই বেরিয়ে আসবে রসায়নে নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী। শিক্ষার্থীরা যেন দেশেই করতে পারে উন্নত মানের গবেষণা, সে জন্য সম্মিলিত প্রচেষ্টার কথা বললেন। প্রবাসে থেকেও বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে রসায়নের গবেষণা ও শিক্ষা কার্যক্রম নিয়ে যেকোনো সহযোগিতা করতে তিনি আগ্রহী। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণায় বিনিয়োগের জন্য সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের এগিয়ে আসা উচিত বলে মনে করেন তিনি।
সদা বাংলাদেশের কথা মনে পড়ে তাঁর। দুই কন্যা ও স্ত্রী নিয়ে সংসার। প্রবাসজীবন কেমন লাগে? এমন প্রশ্নে হেসে বললেন, ‘এত বছর পর তো আর প্রবাসজীবন থাকে না। এটাই জীবন এখন।’ রসায়নে গবেষণা, শিক্ষকতা আর জীবন-সংসারের রসায়ন নিয়ে কেটে গেছে বহু বছর। বললেন, খুব বেশি চাওয়া নেই এখন। কন্যারা সফল সুন্দর মানুষ হোক আর বাংলাদেশ ভালো থাকুক—এইটুকুই চাওয়া।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.