শোকের মাস এলেই যে বঙ্গবন্ধুকে আমাদের স্মরণ করতে হবে তা কিন্তু নয়, কারণ তার উপস্থিতি সারা বছর ধরেই আমাদের অনুপ্রেরণা দেয়। যেমন তা দিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস। ১৯৬৮ সালে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন ভর্তি হই তখন ‘বাংলাদেশ’ প্রতিটি মানুষের স্বপ্ন ছিল; সেই সংগ্রামমুখর সময় আমরা বঙ্গবন্ধুর দিকেই তাকিয়েছিলাম এবং তিনি তার নেতৃত্বের গুণাবলী দিয়ে সাহস, ধৈর্য, বিচক্ষণতা ও ভবিষ্যৎ দেখার বিরল প্রতিভার গুণে সমৃদ্ধ সেই নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তার বিরুদ্ধে অনেক মামলা হয়েছে। অনেক বছর তিনি কারাগারে কাটিয়েছেন। যখন তাকে আগরতলা মামলায় জড়ানো হল তখনও তিনি ধৈর্য হারাননি। তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পড়লে আমরা বুঝতে পারি কারাবাসকে তিনি কখনও জীবন থেকে সময় হারিয়ে যাওয়া ভাবেননি বরং পরবর্তী সংগ্রামের জন্য প্রস্তুতি হিসেবে নিয়েছেন।
আগরতলা মামলা থেকে বেরিয়ে এসে তিনি যখন জেগে ওঠা এই সমাজের দায়িত্ব নিলেন তখন বোঝা গিয়েছিল তার বিশাল একটি প্রস্তুতি ছিল। তার পরের ইতিহাস হচ্ছে- আমাদের এগিয়ে যাওয়ার, আমাদের বিজয়ের ইতিহাস।
একাত্তর সালের ৭ মার্চ তিনি যে ভাষণ দিয়েছিলেন সেই ভাষণে আমরা আবার অনুভব করলাম কোন গুণাবলী এতবড় একজন নেতাকে সৃষ্টি করতে পারে। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল রেসকোর্স ময়দানে খুব সামনে থেকে তার সেই বক্তৃতা শোনার। তিনি সেই বক্তৃতায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করতে পারতেন। কিন্তু তিনি জানতেন- এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক সম্পর্কে তার অগাধ অধিকার ছিল- যে, এই ধরনের ঘোষণা- যাকে বলা হয়, ইউনিলিটারেল ডিক্লারেশন ইন্ডিপেন্ডেন্ট অথবা ঊউও বা একপাক্ষিক স্বাধীনতার ঘোষণা কখনও আন্তর্জাতিক সমর্থন পায় না। তিনি এমনভাবে সেই উনিশ-কুড়ি মিনিটের বক্তৃতায় আমাদের স্বাধীনতার জন্য তৈরি হওয়ার আহ্বান জানালেন, আমাদের মুক্তির সংগ্রামে যোগদান করার জন্য ঐক্যবদ্ধ করলেন যে, পৃথিবী কোনোভাবেই তা ভিন্নপঠনে ফেলতে পারেনি। আমরা জানলাম যে, আমরা স্বাধীনতার ডাক পেয়েছি কিন্তু বিশ্ব জানল, তিনি আরেকবার সুযোগ দিচ্ছেন আলোচনার। তারপর তো আলোচনা হল কিন্তু আমরা জনতাম সে আলোচনা কখনও সফল হবে না, কারণ এ আলোচনার কোনো প্রয়োজন দেখিনি।
তারপর বঙ্গবন্ধু পালিয়ে ভারত যেতে পারতেন কিন্তু তিনি জানতেন তার সে চলে যাওয়ার ফলে সাড়ে ৭ কোটি বাঙালি অরক্ষিত হয়ে পড়বে। তখন যে হত্যা ও নিধনযজ্ঞ চালানো হবে তাদের ওপর তার জন্য তিনি হয়তো নিজেকে দায়ী ভাবতেন। তিনি আত্মসমর্পণ করলেন এবং তিনি জানতেন বিশ্ব তার দিকে থাকবে এবং বিশ্বের নজর থাকবে বাংলাদেশের দিকে। তারপরও পাকিস্তানিরা হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে, কাপুরুষের মতো মানুষকে খুন করেছে, নারীদের সম্ভ্রমহানি করেছে। এ পাকিস্তানিদের ঘৃণার ইতিহাস তো আমরা জানি।
আবার যখন বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে এলেন সেই একই মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি ১০ মার্চ ১৯৭২ সালে। মানুষকে জাগানোর মন্ত্র দিলেন। তিনি পরিষ্কার কিছু কথা বললেন, ‘আমার ভৌতকাঠামো নেই, আমার হাতে পয়সা নেই। আমার সম্পদ বিনষ্ট, আমার যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত কিন্তু আপনাদের জেগে উঠতে হবে।’ আমি মনে করি, বঙ্গবন্ধুর এই গুণাবলী আমাদের সময়ে খুবই বিরল। এই যে ধৈর্য এবং সাহস। এই যে মানুষের প্রতি তার ভালোবাসা এবং মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চিরজীবনের অঙ্গীকার- দরিদ্র মানুষের, মেহনতি মানুষের পক্ষে সংগ্রাম করার। রাষ্ট্রের কাঠামোকে বদলে দেয়ার, যাতে স্বাধীনতার সুফল সব মানুষের কাছে পৌঁছতে পারে।
তিনি দূরদর্শী নেতা ছিলেন, ভবিষ্যৎকে খুব ভালোভাবে পড়তে পারতেন, তার বিশ্বাস ছিল মানুষের ওপর। সেই বিশ্বাসের ফলে, তিনি তার দূরদর্শিতা সত্ত্বেও তার ওপর যে এত হীন একটি আক্রমণ হতে পারে, তার প্রাণসংহার করার জন্য কিছু মানুষ একত্রিত হতে পারে- এটি তার ভাবনায়ও আসেনি। বঙ্গবন্ধুর দুর্বলতা হল, তিনি মানুষকে বিশ্বাস করতেন এবং মানুষের ভেতর যে অশুভ লুকিয়ে থাকে তাকে তিনি আমলে না নিয়ে মানুষের শুভর দিকটাই গ্রহণ করতেন। তিনি খুব সহজেই বিশ্বাস স্থাপন করতেন মানুষের ওপর আর সেই বিশ্বাসের জন্য তাকে মূল্যও দিতে হয়েছে। কিন্তু আমি মনে করি, এটি তাকে একটা অসম্ভব উচ্চতায় নিয়ে গেছে, যে উচ্চতায় আমরা বিশ্বের অনেক নেতাকে বসাই যারা তাদের দেশের জন্য সংগ্রাম করেছেন। বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে, বঙ্গবন্ধুর চেতনায় বাংলাদেশ উজ্জীবিত এবং বঙ্গবন্ধুকে অনুসরণ করেই আমাদের ভবিষ্যৎ আমরা নির্মাণ করব। এই শোকের মাসে তার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা। অনুলিখন : শুচি সৈয়দ
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.