হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার একপর্যায়ে জঙ্গিরা হত্যার হুমকি দিয়ে পিস্তল ধরতে তাহমিদ হাসিব খানকে বাধ্য করেছিল। অস্ত্রটি দেওয়ার আগে ভেতর থেকে গুলি বের করে নেয় জঙ্গিরা। এরপর ঢাল হিসেবে তাহমিদকে ছাদে পাঠায়। এর মাধ্যমে রেস্তোরাঁর আশপাশে পুলিশসহ সেনা সদস্যদের অবস্থান বুঝতে চেয়েছিল জঙ্গিরা। পাশাপাশি কেউ ছাদে উঠলে বাইরে থেকে গুলি ছোড়া হয় কি না তা দেখতে চেয়েছিল তারা। তাহমিদকে পাঠানোর পর হাসনাত করিমকেও ছাদে পাঠানো হয়। একপর্যায়ে জঙ্গি রোহান ইমতিয়াজ সেখানে যায়। জীবন বাঁচাতে তাহমিদ জঙ্গিদের দেওয়া অস্ত্রটি হাতে রাখেন এবং নির্দেশনা অনুযায়ী রোহানের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে কথা বলেন। ১৫ মিনিট পর তাহমিদ ও হাসনাত করিম নিচে নেমে আসেন।
কালের কণ্ঠকে দেওয়া সাক্ষাত্কারে গতকাল বুধবার এ দাবি করেছেন হলি আর্টিজানে হামলার ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী এক তরুণী (তরুণীর অনুরোধে তাঁর নাম-পরিচয় প্রকাশ করা হলো না)। ওই তরুণী বলেন, হামলার রাতে তিনি ও তাহমিদসহ ১২ জন আর্টিজান বেকারির নিচতলায় একসঙ্গে জিম্মি অবস্থায় ছিলেন। তাঁদের সঙ্গে হাসনাত করিম ও তাঁর পরিবারের সদস্যরাও ছিলেন। তবে তাঁর (তরুণীর) দাবি, সে সময় তিনি তাঁকে (হাসনাত করিম) চিনতেন না। যে জঙ্গি এসে তাহমিদের হাতে অস্ত্র দিয়ে ছাদে পাঠায় তার নাম রোহান ইমতিয়াজ। জিম্মি অবস্থা থেকে মুক্ত হওয়ার পর পত্রিকায় ছবি দেখে তার নাম জেনেছেন তিনি।
হলি আর্টিজানের জিম্মিদশা থেকে উদ্ধার করা ৩২ জনের একজন তাহমিদ। তিনি কানাডার টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। উদ্ধার পাওয়া আরেকজন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক হাসনাত করিম। উদ্ধারের পরপরই তাঁদের হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এরপর প্রায় এক মাস ধরে তাঁদের কোনো অবস্থান জানতে পারেনি পরিবার। পরে দুজনকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। গতকাল ছিল রিমান্ডের ষষ্ঠ দিন।
হলি আর্টিজানে হামলার পর ঘটনাস্থলের কাছ থেকে ভিডিও চিত্র ধারণ করেন এক কোরিয়ান নাগরিক। তাতে হাসনাত করিমকে জঙ্গিদের সঙ্গে দেখা যায়। পরে সূত্রের উল্লেখ না করে বেশ কিছু স্থিরচিত্র সংবাদমাধ্যমে ছাপা হয়েছে। তাতে তাহমিদ ও হাসনাত করিমকে এক জঙ্গির সঙ্গে ছাদে দেখা যায়। একটি ছবিতে তাহমিদের হাতে অস্ত্র দেখা যায়।
পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেছেন, তাহমিদ ও হাসনাত ঘটনায় জড়িত কি না, সে বিষয়ে এখনো নিশ্চিত নন তাঁরা। তদন্ত শেষে তা বলা যাবে। তবে শরীরী ভাষাসহ আলামতে সন্দেহ হওয়ায় তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
ওই তরুণী বলেন, ‘আমরা ১২ জন রেস্টুরেন্টটির নিচতলায় একসঙ্গে জিম্মি হয়ে ছিলাম। জঙ্গিরা সারা রাত আমাদের টেবিলে বসিয়ে রাখে। পরদিন সকাল হতেই জঙ্গিরা অস্থির হয়ে ওঠে। ওপর-নিচে ওঠানামা করছিল তারা। একপর্যায়ে জঙ্গি রোহান এসে তাহমিদকে বলে, তুমি ওঠো। তারপর তাকে একটু দূরে নিচতলার সিঁড়ির ঘরে নিয়ে যায় রোহান। একটি পিস্তল নিয়ে তাহমিদকে বলে ধরো। তাহমিদ রাজি না হলে বলে, যা বলছি করো। তা না হলে বাঁচাইয়া রাখব না। আমরা যেখানে ছিলাম সেখান থেকে তাদের কথাবার্তা শোনা যাচ্ছিল।’
প্রত্যক্ষদর্শী এই তরুণী বলেন, ঘটনার রাতে ৮টা ১০ মিনিটের দিকে তিনি হলি আর্টিজানে যান। তাঁরা রেস্তোরাঁর বাইরের লনে বসে থাকা অবস্থায় রাত ৮টা ৪০ মিনিটের দিকে জঙ্গিরা সেখানে আক্রমণ করে। এরপর জঙ্গিরা অস্ত্রের মখে তাঁদের নিচতলায় নিয়ে যায়। সেখানে তাহমিদ ও হাসনাত করিমসহ ১২ জন একসঙ্গে জিম্মি অবস্থায় ছিলেন। জিম্মি হওয়া থেকে শুরু করে মুক্ত হওয়া পর্যন্ত সময়ের মধ্যে মাত্র ১৫ মিনিট জঙ্গিদের সঙ্গে ছিলেন তাহমিদ ও হাসনাত করিম। ওই ১৫ মিনিট দুজনকে ছাদে নিয়ে গিয়ে আশপাশের পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করে জঙ্গিরা। একসঙ্গে জিম্মি থাকা কেউই তাহমিদের সঙ্গে জঙ্গিদের সখ্যের কিছু দেখতে পায়নি।
কয়েকটি সংবাদপত্রের প্রকাশিত খবরের সমালোচনা করে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সত্য ঘটনা না লিখে কিছু সাংবাদিক একটি সময়ের ছবি প্রকাশ করে নিরীহ মানুষকে ফাঁসাতে চাইছে।’
অস্ত্র হাতে তাহমিদের ছবি প্রকাশের পর শরীরী ভাষার বিষয়টি নিশ্চিত হতে স্বজনরা সংশ্লিষ্ট ছবি ও তথ্য পাঠিয়েছিল লন্ডনভিত্তিক শরীরী ভাষা বিশেষজ্ঞ ইন্ডিয়া ফোর্ডের কাছে। গত মঙ্গলবার ইন্ডিয়া ফোর্ড তাঁর মতামতে বলেছেন, ‘পরিস্থিতির শিকার হয়ে তাহমিদ হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছেন। তাঁর একমাত্র অপরাধ ছিল ভুল সময় ভুল জায়গায় অবস্থান করছিলেন তিনি; যা আমাদের যে কারো জীবনেই ঘটতে পারে।’ ইন্ডিয়া ফোর্ডের মতামতের একটি কপি কালের কণ্ঠ’র হাতেও এসেছে।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী তরুণী একই কথা বলছেন। তাঁর ভাষ্য মতে, ‘রেস্টুরেন্টের নিচতলায় আমরা ১২ জন জিম্মি ছিলাম। তাহমিদসহ আমরা তিনজন, হাসনাত আংকেল এবং তাঁর স্ত্রী-সন্তানসহ চারজন, সত্য প্রকাশ নামের এক ব্যক্তি এবং রেস্টুরেন্টের একজন শেফ ও তিনজন ওয়েটার ছিল। আমরা তিনজন বাইরের লনে ছিলাম। আমাদের পাশেই কয়েকজন বিদেশি ছিল। হামলার পর প্রথমেই জঙ্গিরা তাদের নিয়ে মেরে ফেলে। তখন আমরা টেবিলের নিচে লুকিয়ে পড়ি। পরে জঙ্গিরা আমাদেরও মারতে আসে। তখন আমরা বাংলায় চিত্কার করে উঠি। সে সময় ওরা বলে, আমরা বাংলাদেশিদের মারব না, মুসলমানদের মারব না। এটা বলেছিল নিবরাস। পরে ছবি দেখে তাকে চিনেছি। ওই সময় মাঠে এসে একজন আল্লাহু আকবার বলে চিত্কার করে। আমরা পালানোর চেষ্টা করি। তখন একজন এসে ধমক দেয়। খুব চেষ্টা করলে হয়তো পালাতে পারতাম। তবে ভয়ে বের হইনি। ভয় হচ্ছিল, কোন দিক থেকে যেন গুলি করে দেয়। একপর্যায়ে বন্দুক হাতে জঙ্গিরা আমাদের লন থেকে রেস্টুরেন্টের ভেতরে নিয়ে যায়। নিয়ে বলে, এখানেই থাকো। সেখানে ছিল জঙ্গি রোহান ইমতিয়াজ ও খায়রুল ইসলাম পায়েল। মুক্ত হওয়ার পর পত্রিকায় ছবি দেখে তাদের চিনেছি।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের ধমক দিয়ে সারা রাত টেবিলে বসিয়ে রাখে জঙ্গিরা। এক সময় তাহমিদ একটু মাথা উঁচু করে কী যেন বলতে চাইছিল, হয়তো ওয়াশরুমে যেতে চাইছিল, তখন খায়রুল একটি দরজা ভাঙার চেষ্টা করছিল। সেখান থেকে দৌড়ে এসে সে বাজে ভাষায় তাহমিদকে শাসায়। বলে, মাথা নিচু করে রাখ। মাথা উঠাইছস কেন? কোপ মেরে দেব তোরে। সারা রাত সবাইকে এ রকম ভয়ের মধ্যে রাখছে। খায়রুল একটু উগ্র ছিল। পরে অন্য জঙ্গিরা আমাদের বলছে, আপনাদের ভয় নেই। আপনাদের মারব না। বিশ্বাস করেন, আমরা মুসলিমদের মারব না।’
ছবিতে তাহমিদের হাতে যে অস্ত্রটি দেখা যায় সেটি জঙ্গি রোহান ইমতিয়াজ দিয়েছিল বলে দাবি করে তিনি বলেন, ‘আমরা সবাই সে ঘটনা দেখি। আমার পাশে ছিল সত্য প্রকাশ, তিনিও দেখেন। আমার আরেক বন্ধুও দেখেছে। সকাল হলে জঙ্গিরা অস্থির হয়ে ওঠে। এক সময় রোহান নিচে এলো। একটা পিস্তল নিল। অন্য জঙ্গিরা সে সময় সিঁড়িঘরে দাঁড়ানো ছিল। রোহান এসে তাহমিদকে সিঁড়িঘরে নিয়ে গেল। সেখানে গিয়ে রোহান তাহমিদকে বলে, এটা (অস্ত্র) ধর। তখন তাহমিদ বলে, না ভাই, এটা কইরেন না। আপনারা বলছেন, কিছু করবেন না। তখন রোহান বলে, কিচ্ছু হবে না। এটা ধর। এই বলে, রোহান ট্রিগার টিপে দেখাল যে পিস্তলে গুলি নেই। তখনো তাহমিদ অস্ত্রটি ধরে না দেখে রোহান ধমক দিয়ে বলে, যা বলছি, চুপচাপ কর। আমাদের কথা শোন। নইলে বাঁচাইয়া রাখব না। তারপর হাসনাত আংকেলকে বলল, আপনি ওঠেন। এরপর তাদের নিয়ে ছাদে চলে গেল।’
ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে ওই তরুণী বলেন, “ছাদ থেকে নেমে তাহমিদ যা বলছে তা-ই শুনলাম। তাহমিদ জানিয়েছে, ওদের দুজনকে ছাদে নিয়ে বলছে, ওই দিকে যান। এদিকে যান। প্রথমে কিছুক্ষণের জন্য ওদের একা পাঠাইছে। পরে রোহান ওদের সাথে আসছে। কী কথা হয়েছে জানতে চাইলে তাহমিদ ও হাসনাত বলেছেন, রোহান তাদের দেখিয়ে বলেছে, ‘ওই যে দেখ ওখানে স্নাইপার, এখানে স্নাইপার। এগুলো ভয় দেখানোর জন্য, বুঝলা।’ হাত দিয়ে ইশারা করে তাদের মধ্যে কী কথা হয়েছে সে বিষয়ে ডিবি অফিসেও একইভাবে সবার সামনে তাহমিদ এসব ঘটনা বলেছে।”
তিনি বলেন, ‘ওরা ছাদ থেকে ফিরে আরো জানিয়েছে, যখন তাদের দ্বিতীয় তলায় নামানো হয় তখন জঙ্গিরা বলে, এখন বলেন আপনাদের নিয়ে আমরা কী করব। তখন তাহমিদ বলেছে, আপনারা কী চান? তখন জঙ্গিরা বলেছে, আমরা শহীদ হব। যুদ্ধে শহীদ হব। তখন তাহমিদ বলেছে, যতক্ষণ আমাদের রেখে দেবেন পুলিশ তো আসবে না আপনাদের কাছে। আমাদের নিরাপত্তার জন্য। আপনারা যদি আমাদের ছেড়ে দেন তাহলে হয়তো পুলিশ আসবে। আপনারা যা চান তা পাবেন। তখন জঙ্গিরা বলে, ভাইবেন না, আপনাদের ছেড়েই দিচ্ছি। এটা বলে ওদের নিচে এনে বসিয়ে রাখে।’
ছেড়ে দেওয়ার ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রত্যক্ষদর্শী ওই তরুণী বলেন, ‘সকালে আমরা একইভাবে বসেই ছিলাম। তখন রোহান নিচে নামল। বলল, আপনারা সবাই উঠে দাঁড়ান। এ সময় হাসনাত আংকেলের হাতে চাবি দিয়ে রোহান বলল, আপনি ওই গেটটা খুলে এখানে আসেন। আংকেল দরজা খুলে আসার পর ওরা (জঙ্গিরা) নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল। হঠাৎ দাঁড়াতে বলায় একটু ভয় পেয়ে যাই। একপর্যায় ওরা বলে, আপনারা এক এক করে বের হয়ে যান। তখন নিবরাস এসে বলে, এখান যার যার ফোন আছে নিয়ে যাও। ফোন নিয়ে আমরা বের হয়ে গেলাম। বের হওয়ার সময় ওরা বলে, আপনাদের সঙ্গে জান্নাতে দেখা হবে।’
আগের রাতে একসঙ্গে জিম্মি হওয়ার পরদিন সকালে মুক্ত হওয়ার আগে ছাদে যাওয়ার সময়টুকুই কেবল তাহমিদ ও হাসনাত তাঁদের থেকে আলাদা হয়েছিলেন বলে জানান ওই তরুণী। তিনি বলেন, ‘আমরা পুরো সময় নিচতলায় টেবিলে একসঙ্গেই বসে ছিলাম। রাতে তারা আমাদের কিছুই বলেনি। সারা রাত মাথা টেবিলে দিয়ে চেয়ারে বসে থাকতে বলা হয়েছে। আমরা তাই করি।’ রাতে হাসনাত করিমের সঙ্গে পরিচয় হয়নি বলে দাবি করেন তিনি।
বের হওয়ার পরের জিজ্ঞাসাবাদসহ তিক্ত অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা ১২ জন একসঙ্গে ছিলাম। সবাই দেখেছি কার কী অবস্থা। তবে তাহমিদ ও হাসনাত আংকেলকে ছাদে দেখা যাওয়ায় প্রশ্ন ওঠে। প্রথমে বের হওয়ার পরেই তাহমিদকে আটকে ফেলা হয়। তখন আমরা গিয়ে ঘটনা বললে তাদের ছেড়ে দেয়। পরে র্যাবও জিজ্ঞাসাবাদ করে। তাহমিদ তখনো ছাদে কী কথা হয়েছে তা বলেছে।’
সংবাদমাধ্যমে তাহমিদকে জড়িয়ে খবর প্রকাশে ক্ষোভ প্রকাশ করে ওই তরুণী বলেন, ‘আমরা তো বের হওয়ার পর একটা ট্রমারের মধ্যে আছি। এর মধ্যে নানা গুজব, উত্কণ্ঠা। তাহমিদকে নিয়ে টেনশন। আপনাদের তো (সাংবাদিক) ক্রেডিট দিতেই হয়! আপনাদের মনগড়া খবর আর নাটকের জন্য আমাদের সঙ্গে যে ভীতিকর একটা বিষয় ঘটে যাচ্ছে।’ দু-একটি সংবাদপত্রের খবরের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, ‘আপনাদের তো অনেক দায়িত্বশীল হওয়া দরকার। আপনারা কেন বিশ্লেষণ করবেন? মন্তব্য করবেন? তদন্তকারী সেজে মনগড়া কথা লিখবেন? তাহলে পুলিশ কী করবে? দেখুন, আমি তো হাসনাত আংকেলকে চিনিও না। যা ঘটেছে তা-ই আমি বলব। যাকে জিজ্ঞেস করবেন একই কথা বলবে। আপনারা প্লিজ সত্যটা লেখেন। নিরপরাধ কাউকে ফাঁসিয়ে দিয়েন না।’
জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে প্রত্যক্ষদর্শী ওই তরুণী বলেন, ‘আমাদের কেউই কারো কাছে সন্দেহ করে কথা বলেনি। জানি না খণ্ডিত ছবি দেখে কী করে একজনকে অপরাধী করছেন আপনারা।’ তিনি বলেন, ‘রাতে ওরা (জঙ্গি) আমাদের মোবাইল ফোন নিয়ে যায়। তবে ফোন নেওয়ার আগে বাসায় কথা বলতে দেওয়া হয়, লাউড স্পিকারে।’
তাহমিদের অস্ত্র হাতে ছাদে যাওয়ার ব্যাপারে ওই তরুণী আরো বলেন, ‘প্রথমেই কিন্তু তাহমিদ ও হাসনাত আংকেলকে একা ছাদে পাঠানো হয়। জানি না ওই ছবি কেন প্রকাশ হচ্ছে না। না আপনারা প্রকাশ করছেন না! প্রথমে ওদের পাঠিয়ে জঙ্গিরা দেখেছে শ্যুট করে কি না। যখন দেখছে শ্যুট করে না, তখন রোহানও গেছে। তাহমিদ ও হাসনাত আংকেল পুলিশকেও এই কথা বলেছেন।’
তাহমিদ ও হাসনাতের ওপর জঙ্গিদের অস্ত্র তাক না করে থাকার ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘রাতে যখন আমাদের মারবে না বলে ভালো ব্যবহার শুরু করে তখন থেকেই আর অস্ত্র তাক করে কথা বলেনি ওরা। তাদের গলায় একটা রাইফেল ঝোলানো ছিল। প্রত্যেকের হাতেই একটি চাপাতি ছিল। মূলত যখন সবাইকে মারছে তখন অস্ত্র তাক করে জঙ্গিরা। আর রাতে যখন তাহমিদ মাথা উঠাইছিল তখন খায়রুল তাক করে হুমকি দেয়। এ ছাড়া রাতে জঙ্গিরা সবার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে। প্রথমে ভয় থাকলেও রাত যত বেড়েছে তত ভয় কেটেছে। মনে হতে থাকে, তারা আমাদের ছেড়ে দেবে। কারণ তারা তো হামলার পরপরই অনেককে মেরে ফেলছে। এতক্ষণ বাঁচিয়ে রাখেনি। তাদের কোনো কথা বলারই সুযোগ দেয়নি। যাদের দেখে মনে হইছে মুসলিম বা বাংলায় কথা বলতেছে, তাদের রাখছে। আমাদের বলেছে, আপনাদের মারব না। আর পুলিশে কেউ চেনাজানা থাকলে ফোন করে বলেন, তারা (পুলিশ) যেন গুলি না করে। তারা গুলি করলে আমরা জানি না আপনারা বাঁচবেন কি না।’
রাতের খাবারের ব্যাপারে জিম্মিদশা থেকে মুক্ত ওই তরুণী বলেন, ‘ফ্রিজ থেকে খাবার বের করে শেফদের দিয়ে রান্না করায় জঙ্গিরা। সাহরির জন্য শুধু ফিশ ফ্রাই খেতে দেয়। জঙ্গিরা আমাদের সঙ্গে খায়নি। তারা বেকারি থেকে কেকও এনে দেয়। জঙ্গিরা আমাদের সবার মোবাইল ফোন নেওয়ার পর কারো কারোটা ব্যবহার করেছিল। বিদেশিদের ল্যাপটপও ব্যবহার করেছে তারা।’
ওই তরুণী আরো দাবি করেন, ‘তাহমিদ ও হাসনাতকে জঙ্গি রোহান ছাদে নিয়ে যাওয়ার পর তারা প্রায় ১৫ মিনিট সেখানে ছিল। এরপর ফিরে আসে। জিম্মি হওয়ার পর দুজন (তাহমিদ ও হাসনাত করিম) তাদের কাছ থেকে এই সময়টুকু আলাদা ছিল। এরপর দরজা খুলতে যায় হাসনাত; যে দৃশ্যও ভিডিও ফুটেজ আকারে ভাইরাল হয়েছে।’
মুক্ত হওয়া মেয়েদের সঙ্গে জঙ্গিদের আচরণ সম্পর্কে ওই তরুণী বলেন, ‘ওরা আমাদের ওড়না দিয়ে নিজেদের ঢাকতে বলে। পরে আমরা মুসলিম জেনে ভালো ব্যবহার করে।’
রেস্টুরেন্টের কর্মচারীদের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘এক জাপানির সঙ্গে এক শেফ ফ্রিজে লুকিয়ে ছিল। তাদের অস্ত্র দেখিয়ে বের করে আনা হয়। হাসনাত আংকেলের স্ত্রীর হিজাব পরা দেখে ওরা খুশি হয়।’
প্রসঙ্গত, গত ১ জুলাই রাতে গুলশানের ৭৯ নম্বর সড়কের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা চালায় জঙ্গিরা। তারা ১৭ বিদেশিসহ ২০ জনকে হত্যা করে। জঙ্গিদের হামলায় নিহত হন দুই পুলিশ কর্মকর্তাও। পরদিন অপারেশন ‘থান্ডারবোল্টে’ পাঁচ জঙ্গিসহ ছয়জন নিহত হয়। জিম্মি অবস্থা থেকে ৩২ জনকে উদ্ধার করা হয়। আহতদের মধ্যে পরে হাসপাতালে শাওন নামের আরেকজন মারা যায়।
(নিরাপত্তাজনিত কারণে এবং প্রত্যক্ষদর্শী ওই তরুণীর অনুরোধে সংবাদে তাঁর নাম ও বিস্তারিত পরিচয় প্রকাশ করা হলো না। কালের কণ্ঠ’র কাছে তাঁর সাক্ষাৎকারের রেকর্ড রয়েছে।)
– See more at: http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2016/08/11/392039#sthash.QbuH9ArQ.dpuf
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.