লৌকিক আচার-আচরণ,বিশ্বাস আর পৌরাণিকতায় সমৃদ্ধ সাতক্ষীরা । নানা কিংবদন্তীর প্রবাহমান ধারায় সজীব এখানকার ঐতিহ্য । বঙ্গোপসাগরের আঁচল
ছোঁয়া সুন্দরবন, আর সুন্দরবনকে বুকে নিয়ে সমৃদ্ধ এখানকার প্রকৃতি, এমনি অর্থনীতিও । সুন্দরবনের চোখ জুড়ানো চিত্রল হরিণ, বিশ্ববিখ্যাত ডোরাকাটা বাঘ থেকে শুরু করে বনদেবী, রাজা প্রতাপাদিত্যের জাহাজঘাটা, বিভিন্ন মোঘলীয় কীর্তি, অসংখ্য প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, পুরাকালের কাহিনী, জারি-সারি,পালাগান, পালকি গান এসবের মধ্যেই সাতক্ষীরার মানুষের আত্মীক পরিচয় গ্রন্থ। এখানে জন্মেছেন কবি,সাহিত্যিক,শিল্পী, সুফী দরবেশসহ বহু বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব, জন্মেছেন জীবন সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ সাহসী মানুষ । শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধেপ্রতিবাদমুখর আত্নত্যাগী বীর ।
গ্রামবাংলার লোকজ ঐতিহ্যই এখনও পর্যন্তসাতক্ষীরার সংস্কৃতির মূলধারাটি বহন করে চলেছে । খুব সহজেই এখানে মিলিত হয়েছে লৌকিক আচার -আচরণের সাথে পৌরাণিকত্বের । যেন দুটো নদীর সম্মিলিত এক বেদবান ধারা । বছরের প্রায় প্রতিটি সময়ধরে অগনিত মেলা বসে সাতক্ষীরায় । সাগরদ্বীপ দুবলোর মেলা থেকে শুরু করে খুলনা, যশোর এমনকি পশ্চিমবঙ্গেওএর প্রভাব পরিলক্ষিত । এ জেলার শুধু নয় দক্ষিণাঞ্চলের সবচেয়ে বড় মেলাটি বসে সাতক্ষীরা শহরেই,পলাশপোল, গুড়পুকুরের পারে ।
গুড়পুকুরের নামানুসারেই মেলার নামকরণ করা হয়েছে গুড়পুকুরের মেলা । মেলাটির বয়স এখনও সঠিকভাবে জানা যায়নি । মেলা নিয়ে অতীতে তেমন লেখালেখিও হয়নি । মেলাটির উৎপত্তি সম্পর্কে সোবহান খান চৌধুরীর (৮০) বক্তব্য এরকম, ‘অনেক পথ হেঁটেছেন’ আজ ক্লান্তিতেপা আর উঠতে চায় না । শেষ ভাদ্রের ভ্যাপসা গরমে মিইয়ে এসেছে সমস্তশরীর । ওই যে গৌরদের পুকুরপারের বটগাছটা ওর ছায়ায় একটু জিরিয়ে নেয়া যাক । বরে ছায়ায় বসতে না বসতেই ঘুম এসে গেল ফাজেলের, শেকড়ে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লেন তিনি । গাছতলার ঘুম । গাছতলার রোদেরর মতই ছেঁড়া ফাটা নড়বড়ে । বটের পাতার ফাঁক দিয়ে সূর্যের তীব্র রশ্মি এসে পড়লো ফাজেলের মুখে । ঘুম ভেঙে যেতে লাগলো । অস্বস্তিবোধ করলেন তিনি । মগডালে বসেছিল এক পদ্মগোখরো সাপ । সে তা লক্ষ্য করলো এবং নেমে এলো নিচে, যে পাতার ফাঁক দিয়ে সূর্যরশ্মি এসে ফাজেলের মুখে পড়েছে ঠিক সেখানে । ফণা তুলে দাঁড়ালো সাপটা । ফণার ছাড়া এসে পড়লো ফাজেলের মুখে । তিনি আরাম পেয়ে আবারও ঘুমিয়ে পড়লেন । কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে থাকার পর আবার ঘুম ভেঙে গেলো । এর মধ্যে ক্লান্তিঅনেকটা দূর হয়ে গেছে । বটের পাতায় পাতায় দৃষ্টি ঘোরাতে লাগলেন । হঠাৎদেখতে পেলেন সেই সাপটিকে । তখনও সে ফণা তুলে সূর্যকে আড়াল করে আছে । এবার ফণাটা একটু দুলে উঠলো, দুলে উঠলো গাছের পাতারা। তখন তার চোখে ঘুমের রেশমাত্র নেই । শরীরে নেই একবিন্দু ক্লান্তি। ফাজেল বটতলা ত্যাগ করলেন এবং এলাকার হিন্দুদের ডেকে বললেন,‘এখানে তোমরা মনসা পূজা কর’ ।
মেলার নাম গুড়পুকুর আর পুকুরের নাম গুড় । এই নামের জট এখনও খোলেনি । কিভাবে হলো এ নামকরণ- কেউ বলেন মনসা পূজার সময় পুকুরে বাতাসা ফেলা হতো । ওই বাতাসার জন্যে পুকুরের পানি মিষ্টি লাগতো। তখন থেকেই গুড়পুকুর । অনেকের ধারণা পুকুরে পানি থাকতো না বেশিদিন । স্বপ্ন দর্শনে জানাগেলো একশ ভাঁড় গুড় ঢালতে হবে পুকুরে । স্বপ্ন নির্দেশ মোতাবেক কাজ করা হলো । সেই যে পুকুরে পানি এলো আর শুকালো না । আবার শোনা যায় পুকুরের তলদেশ থেকে এক সময় মিষ্টি পানি উঠতো তাই এর নাম গুড়পুকুর হয়েছে । একজন বললেন পুকুরের জায়গাতে অসংখ্য খেজুর গাছ ছিল এবং প্রচুর রস হতো ওই গাছে । একবার গাছের সমস্তরস দিয়ে গুড় তৈরি করে তা বিক্রি করা হলো এবং ওই বিক্রিত টাকা দিয়ে পুকুরটি কাটা হলো । তখন থেকে গুড়পুকুর ।
আবদুস সোবহান খান চৌধুরী বলেছেন, আসলে ওসব কিছুই নয় । চৌধুরীপাড়ার রায় চৌধুরীরা গৌর বর্ণের ব্রাক্ষ্মন ছিলেন । তাই তাদের পুকুরকে বলা হতো গৌরদের পুকুর । কালক্রমে হয়েছে গুড়পুকুর । পুকুর সংলগ্ন বসবাসকারী নিতাই কর্মকার (৭৫) ও সোবাহান খান চৌধুরীর বিবরণের সাথে ঐকমত্য পোষণ করেন ।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.