ভর্তিকালে প্রত্যেকের কাছ থেকে নেয়া হবে ১০০ টাকা করে
বেসরকারি শিক্ষকদের পেনশনের জন্য শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বছরে অন্তত পৌনে দু’শ কোটি টাকা ফি হিসেবে আদায়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ অর্থ বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী অবসর বোর্ড এবং কল্যাণ ট্রাস্টে জমা হবে। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায় করা অর্থের সঙ্গে থোক বরাদ্দ, স্থায়ী আমানত, এমপিও খাতের আয়ের অর্থ মিলিয়ে শিক্ষকদের পেনশনের দাবি পূরণ করা হবে। শিক্ষা সচিব মো. সোহরাব হোসাইন এ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, অবসর ও কল্যাণ ট্রাস্টের বোর্ড সভায় শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অর্থ আদায়ের এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, প্রায় ৭৪ হাজার অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক-কর্মচারীর দাবি পূরণ করতে গিয়ে মন্ত্রণালয় এ পন্থা বেছে নিয়েছে। এছাড়াও আয় বাড়াতে প্রত্যেক এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীর কাছ থেকে আগের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ হারে অর্থ কেটে নেয়ার আরেকটি সিদ্ধান্তও হয়েছে। সে অনুযায়ী কল্যাণ ট্রাস্টে একজন শিক্ষক-কর্মচারী প্রাপ্ত বেতনের ৪ শতাংশ জমা দেবেন। বর্তমানে ২ শতাংশ হারে বেতন থেকে কেটে রাখে সরকার। আর অবসর বোর্ডের ৬ শতাংশ কেটে রাখা হবে, যা বর্তমানে ৪ শতাংশ। দুটি সিদ্ধান্তই বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া চলছে। শিক্ষকদের অবসর ভাতার জন্য ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে ফি আদায়ের এমন সিদ্ধান্ত অবশ্য সমর্থন করছেন না সংশ্লিষ্ট বিশিষ্টজনরা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের (ক্যাম্পে) নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ‘আমার এক আত্মীয়ের অবসরের টাকার খোঁজ নিতে গিয়ে আমি সেখানকার দুরবস্থা জেনেছি। শিক্ষকরা অবসর ও কল্যাণ তহবিলের অর্থ পেতে অনেক ভোগান্তি পোহান। কিন্তু তাই বলে তাদের দাবি পূরণে ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে এভাবে অর্থ আদায় করা আমি সমর্থন করি না। এ বিষয়টি দেখার দায়িত্ব সরকারের। কত জায়গায় সরকারের কত টাকা অপচয় হচ্ছে। এ খাতের দাবি পূরণে সরকারকে প্রয়োজনে আলাদা ব্যবস্থা করতে হবে।’ জানা গেছে, গত মে’তে অবসর বোর্ড ও কল্যাণ ট্রাস্টের পৃথক দুই সভায় এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে এ খাতে প্রতি বছর ভর্তিকালে এককালীন ১০০ টাকা করে আদায়ের সিদ্ধান্ত হয়। এর মধ্যে অবসর বোর্ডের জন্য ৬০ টাকা এবং কল্যাণ ট্রাস্টের জন্য ৪০ টাকা করে নেয়া হবে। উভয় সভায় সভাপতিত্ব করেন শিক্ষা সচিব। বর্তমানে সারা দেশে ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে ডিগ্রি পর্যায় পর্যন্ত এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ ছাত্রছাত্রী আছে। এসব শিক্ষার্থীর কাছ থেকে উভয় খাতে ১০০ টাকা করে নিলে আদায় হবে প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা।
কল্যাণ ট্রাস্টের সদস্য সচিব অধ্যক্ষ শাহজাহান আলম সাজু বলেন, অবসর ও কল্যাণ ট্রাস্টের দাবি পূরণ করা হয় দুটি খাতের আয় থেকে। তা হচ্ছে, উভয় সংস্থার স্থায়ী আমানত থেকে প্রাপ্ত আয় এবং প্রতি মাসে শিক্ষক-কর্মচারীদের এমপিও থেকে কর্তন করা আয়। যদি ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে ফি আদায় করা হয়, তাহলে তা এ দুই আয়ের সঙ্গে যুক্ত হবে। তিনি দাবি করেন, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বিভিন্ন প্রয়োজনে এভাবে ফি নেয়ার ঘটনা নতুন নয়। ১৯৯০ সালের পর কয়েক মাস এ খাতে ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে ফি নেয়া হয়। ১৯৯২ সালে বিএনপি সরকার তা বন্ধ করে দিয়েছিল। শিক্ষকদের ভোগান্তি দূর করতে এ ফি আরোপ জরুরি বলে মনে করেন তিনি।
বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ২৫-৩০ বছর চাকরি জীবন শেষে শিক্ষক-কর্মচারীদের ‘বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও কর্মচারীদের অবসর সুবিধা’ ও ‘কল্যাণ ট্রাস্ট’ থেকে বিভিন্ন হারে আর্থিক সুবিধা দেয়া হয়। দেখা গেছে, এতে অবসর ভাতা হিসেবে এককালীন ১২-২০ লাখ টাকা পেয়ে থাকেন একজন শিক্ষক। নতুন স্কেলে এটা ২৪ থেকে ৪০ লাখ টাকা হবে। আর কল্যাণ ট্রাস্ট থেকে একজন শিক্ষক আড়াই থেকে ৬ লাখ টাকা পেয়ে থাকেন। কিন্তু এ অর্থ পেতে তাদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। অবসর সুবিধার জন্য কোনো কোনো শিক্ষক আবেদন করে পাঁচ বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করছেন। এর মধ্যে কেউ কেউ মারাও গেছেন। শিক্ষকদের অভিযোগ, এ অর্থ পেতে তদবির আর ঘুষ দিতে হয়। পরিস্থিতি এমন যে, চেক তৈরি হওয়ার পরও ঘুষ ছাড়া তা ইস্যু করা হয় না। এক্ষেত্রে বিশেষ করে অবসর বোর্ডের কয়েকজন কর্মকর্তা, পিয়ন, ড্রাইভারের সমন্বয়ে সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। এছাড়া উভয় বোর্ডের স্থায়ী আমানতের অর্থ তফসিলি ব্যাংক থেকে বেসরকারি ব্যাংকে রাখার বিনিময়েও নানা সুবিধা নেয়ার অভিযোগ আছে। এ কারণে গত মাসের অবসর বোর্ডের বোর্ড সভায় স্থায়ী আমানতের অর্থ সরকারি ব্যাংকে রাখার সিদ্ধান্ত হয়। তবে এখন পর্যন্ত এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে।
জানা গেছে, বর্তমানে অবসর সুবিধার জন্য ৪৪ হাজার শিক্ষক এবং কল্যাণ ট্রাস্টের জন্য ৩০ হাজার শিক্ষকের আবেদন স্থগিত আছে। এ দুই সংস্থায় প্রায় ৭৪ হাজার শিক্ষকের অর্থ দাবির আবেদন জমা থাকলেও হজ বা তীর্থযাত্রী, রোগগ্রস্ত, কন্যা দায়গ্রস্ত এমন নানা বিশেষ অগ্রাধিকার খাত তৈরি করে অর্থ পরিশোধ করা হচ্ছে। এ কারণে সাধারণ দাবি উপেক্ষিত হচ্ছে। পৌনে ১ লাখ অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক-কর্মচারীর এমন ভোগান্তির বিষয়টি বারবার গণমাধ্যমে উঠে আসার পরিপ্রেক্ষিতে এবারের বাজেটে বাড়তি অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে। বাজেটে অবসর বোর্ডের তহবিলে ৫০০ কোটি টাকার একটি সিড মানি দেয়া হয়েছে। এ অর্থ ব্যয় করা যাবে না। এখান থেকে লব্ধ আয় অবসরপ্রাপ্তদের প্রাপ্য পূরণে ব্যয় করতে হবে। তবে এ তহবিলে বাজেটে একই সঙ্গে থোক বরাদ্দ হিসেবে ১০০ কোটি টাকা দেয়া হয়েছে। আর কল্যাণ ট্রাস্টে ৫০ কোটি টাকা থোক বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। উভয় তহবিল এই দেড়শ’ কোটি টাকা ব্যয় করতে পারবে।
জানা গেছে, কল্যাণ তহবিলে বর্তমানে মাসে শিক্ষকদের দাবি পূরণে প্রয়োজন ৪০ থেকে ৪২ কোটি টাকা। শিক্ষকদের কাছ থেকে কল্যাণ ট্রাস্টে ৪ শতাংশ হারে কেটে নিলে প্রতি মাসে আয় হবে প্রায় ১৭ কোটি টাকা। এর সঙ্গে যুক্ত হবে প্রায় সোয়া দুইশ’ কোটি টাকা এফডিআরের আয়। সেই সঙ্গে আছে বাজেটে দেয়া ৫০ কোটি টাকা থোক বরাদ্দ। তাই দাবি পূরণে শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ফি আদায়ই যৌক্তিক হবে বলে মনে করেন কল্যাণ ট্রাস্টের সদস্য সচিব অধ্যক্ষ শাহজাহান আলম সাজু। তিনি বলেন, অবসর বোর্ডের চাহিদা কল্যাণ ট্রাস্টের চেয়ে প্রায় তিনগুণ বেশি। শিক্ষক-কর্মচারীদের আবেদন নিষ্পত্তিতে সেখানে প্রতি মাসে ১০০ থেকে ১১০ কোটি টাকা প্রয়োজন।
অবসর বোর্ডেও আয়ের খাত দুটি। তা হচ্ছে, প্রায় আড়াইশ’ কোটি টাকা থেকে প্রাপ্ত লাভ এবং প্রতি মাসে এমপিওভুক্ত শিক্ষকের কাছ থেকে ৪ শতাংশ হারে কেটে নেয়া অর্থ। সেটি এখন ৬ শতাংশ করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। তিনি আরও জানান, এ দুই আয়ের সঙ্গে এবার বাজেটে দেয়া ১০০ কোটি টাকা যোগ হবে। কিন্তু এ অর্থ এক মাসের চাহিদা পূরণ করা যাবে। সুতরাং ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে ফি আদায় করা গেলে সামান্য হলেও সুবিধা মিলবে।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.