আফসানার মৃত্যু
ছাত্র ইউনিয়নকর্মী আফসানা ফেরদৌস আত্মহত্যা করেছেন বলে মরদেহের প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক জানিয়েছেন। ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এ কে এম শফিউজ্জামান গণমাধ্যমকে বলেন, প্রাথমিকভাবে আফসানা আত্মহত্যা করেছেন বলেই মনে হচ্ছে। চিকিৎসকের এ বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করেছেন আফসানার পরিবারের সদস্যরা। তারা বলেছেন, প্রভাবশালী মহলের চাপে এমন বক্তব্য দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে, আফসানা হত্যার ফরেনসিক রিপোর্ট প্রত্যাখ্যান করে কর্মসূচি ঘোষণা করেছে ছাত্র ইউনিয়ন। গতকাল সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এই রিপোর্ট প্রত্যাখ্যান করে সংগঠনটি আজ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি প্রদানের কর্মসূচিও ঘোষণা করে। একই সময়ে প্রগতিশীল ছাত্রজোট নেতৃবৃন্দ আলাদা সংবাদ সম্মেলন করে ফরেনসিক রিপোর্ট প্রত্যাখ্যানের ঘোষণা দেন। ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক বলেন, প্রাথমিকভাবে আফসানা আত্মহত্যা করেছেন বলেই মনে হচ্ছে। তার শরীরে কোথাও আঘাতের চিহ্ন নেই। তবে আরো কিছু পরীক্ষা বাকি থাকায় আফসানাকে ধর্ষণ কিংবা বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়েছিল কিনা তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি বলে তিনি জানান। আত্মহত্যার যে ধরনের লক্ষণ থাকে, আফসানার ক্ষেত্রে সেগুলো পাওয়া গেছে। বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়েছে কিনা বা তাকে ধর্ষণ করা হয়েছিল কিনা তা যাচাইয়ের জন্য নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। সেই প্রতিবেদন পেলে বলা যাবে। মিরপুরের সাইক ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড টেকনোলজির স্থাপত্যবিদ্যার শিক্ষার্থী আফসানাকে অচেতন অবস্থায় গত শনিবার রাতে মিরপুরের আল হেলাল হাসপাতালে ফেলে যায় দুই তরুণ। তার আগেই আফসানার মৃত্যু হয় বলে চিকিৎসকরা জানান। আফসানাকে শ্বাসরোধে হত?্যা করা হয়েছে দাবি করে তার কথিত বন্ধু তেজগাঁও কলেজ ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রবিনকে শুরু থেকে দায়ী করে আসছে পরিবার। মৃত্যুর এক সপ্তাহ পরও সন্দেহভাজন ছাত্রলীগ নেতা হাবিবুর রহমান রবিনকে ধরতে পারেনি পুলিশ। বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি লাকী আক্তার সংবাদ সম্মেলনে বলেন, এই ফরেনসিক রিপোর্ট প্রত্যাখ্যান করছি। আফসানার অস্বাভাবিক মৃত্যু প্রমাণ করে এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। ফরেনসিক রিপোর্টের নামে প্রহসন করা হয়েছে। হত্যাকাণ্ডে প্রভাবশালী কেউ জড়িত থাকলে প্রভাবিত করার চেষ্টা করা হয়। আফসানার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। তিনি আরো বলেন, এ ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তার দাবি নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি দেয়া হবে। একই সঙ্গে সারা দেশের জেলা প্রশাসকদের কাছে স্মারকলিপি দেয়া হবে বলেও জানান তিনি। একই দিন দুপুরে আলাদা সংবাদ সম্মেলনে রিপোর্ট প্রত্যাখ্যান করে প্রগতিশীল ছাত্রজোট। এতে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন জোটের সমন্বয়ক সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের সভাপতি নাঈমা খালেদ মনিকা। তিনি বলেন, আফসানার অস্বাভাবিক মৃত্যু প্রমাণ করে এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। আফসানা-তনুসহ সব ধর্ষণ হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে ২৫শে আগস্ট ঢাকায় শাহবাগে সংহতি সমাবেশ ও দেশব্যাপী বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করছি। অন্যান্য কর্মসূচির মধ্য রয়েছে ২২শে আগস্ট সন্ধ্যা ৬টায় টিএসসিতে ছাত্র অভ্যুত্থান দিবস উপলক্ষে মশাল মিছিল। ডাকসুসহ সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রসংসদ নির্বাচনের দাবিতে ২৯শে আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দুপুর ১২টায় সভা ও মিছিল। সংবাদ সম্মেলনে চারটি দাবি জানানো হয়। দাবিগুলো হলো- আফসানা হত্যার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তার ও শাস্তি নিশ্চিত করা। তনু হত্যার বিচারসহ সব নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, সুন্দরবন ধ্বংসকারী রামপাল চুক্তি বাতিল ও ডাকসুসহ সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা।
পরিবারের প্রত্যাখ্যান এদিকে ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি জানান, চিকিৎসকের বক্তব্যে হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছে আফসানার পরিবার। এ হত্যাকাণ্ড ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে প্রভাবশালীর হস্তক্ষেপে ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পরিবর্তন করা হচ্ছে বলে অভিযোগ ওই পরিবার ও এলাকাবাসীর। ন্যায়বিচারের আশায় সুষ্ঠু তদন্তের দাবি আফসানার পরিবারের। এজন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন তারা। আফসানার ভাই ফজলে রাব্বি অভিযোগ করে বলেন, আফসানাকে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করা হয়েছে। আত্মহত্যার কথা বলে বিষয়টি ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা চলছে। এমন মনগড়া রিপোর্ট সম্পূর্ণ অসত্য, প্রকৃত দোষীদের আড়াল করতেই চেষ্টা চালানো হচ্ছে। রাব্বি আরো বলেন, পুনরায় তদন্ত করলে রহস্য বেরিয়ে আসবে। আফসানার মা স্কুলশিক্ষিকা সৈয়দা ইয়াসমিন বলেন, দেশে কোনো আইন কানুন নাই। জোর যার মুল্লুক তার। সব কিছু টাকার কাছে বিক্রি হয়ে যায়। আফসানা কখনোই আত্মহত্যা করেনি। রাজধানীর তেজগাঁও কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হাবিবুর রহমান ওরফে রবিন ও তার কয়েক বন্ধু মিলে আফসানাকে হত্যা করেছে। এখন বিষয়টি ধামাচাপা দিতে ময়না তদন্ত রিপোর্টে আত্মহত্যার কথা বলা হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, চিকিৎসক ও পুলিশ উভয়েই কোনো চাপে অথবা টাকার কাছে বিক্রি হয়েই এমন অসত্য রিপোর্ট দিয়েছে। এ সময় আফসানার মা প্রকৃত তদন্ত রিপোর্ট ও হত্যাকারীদের বিচারের জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। আফসানার মামা মোফাজ্জল হোসেন বলেন, হাসপাতালে যারা আফসানার লাশ চিকিৎসার নামে ফেলে রেখে গেছে তারাই প্রকৃত খুনি। হাসপাতালের সিসি ক্যামারার ফুটেজ দেখে তাদের শনাক্ত করা হয়েছে। কিন্তু তারা সরকার দলীয় প্রভাবশালী হওয়ায় পুলিশ তাদের এখনো ধরছে না। তাদের ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করলে আসল ঘটনা উদঘাটন হবে। এদিকে আফসানা হত্যার সুষ্ঠু তদন্তের দাবিতে রোববারও উত্তাল ছিল ঠাকুরগাঁও। সকালে শহরের চৌরাস্তায় মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা। প্রতিবাদসভায় বক্তারা প্রাথমিক তদন্তের রিপোর্ট প্রত্যাখ্যান করে দোষীদের গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছেন। অন্যথায় বৃহত্তর কর্মসূচিরও হুঁশিয়ারি দেয়া হয় প্রতিবাদ সভা থেকে। গত ১১ই আগস্ট (বৃহস্পতিবার) আফসানা নিখোঁজ হয়। ১৩ই আগস্ট (শনিবার) রাতে কাফরুলের একটি বেসরকারি হাসপাতালে তাকে মৃত অবস্থায় ফেলে রেখে যায় দুই তরুণ। পরে পুলিশ এসে তার মরদেহ উদ্ধার করে।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.