এসপি বাবুল আক্তার
‘অব্যাহতিপত্রে নয়, জিজ্ঞাসাবাদের নামে তুলে নিয়ে সাদা কাগজে আমার সই নেয়া হয়েছিল। আর ওই কাগজে সই করতে চাপ সৃষ্টি করেছিলেন ঘটনার রাতে মিন্টো রোডের গোয়েন্দা কার্যালয়ে উপস্থিত পুলিশ কর্মকর্তারা। পরে সেটিই পদত্যগপত্র হিসেবে প্রস্তুত করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব বরাবর পাঠানো হয়।’
রোববার যুগান্তরের কাছে কথাগুলো বলেছেন আলোচিত পুলিশ সুপার বাবুল আক্তার।
এদিন রাজধানীর মেরাদিয়ায় শ্বশুর মোশাররফ হোসেনের বাড়িতে পদত্যাগপত্র প্রসঙ্গে নানা কথা বলেন এসপি বাবুল। তিনি বলেন, ‘আমি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করিনি, ষড়যন্ত্র আর পরিস্থিতির শিকার হয়েছি।’ তবে তার বিরুদ্ধে কারা ও কেন ষড়যন্ত্র করেছে এবং কোন পরিস্থিতিতে তিনি সাদা কাগজে সই করতে বাধ্য হয়েছেন- সে বিষয়ে তিনি এখনই কিছু বলতে রাজি হননি।
কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘এখনও আমি চাকরি ফিরে পেতে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের সুদৃষ্টির অপেক্ষায় আছি। তবে সুবিচার না পেলে ঘটনার রাতে আমার সঙ্গে কি আচরণ করা হয়েছিল, তা তদন্তের জন্য সরকারের কাছে আবেদন করব।’
তবে বাবুল আক্তারের উল্লিখিত সব অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছেন পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) একেএম শহীদুল হক।
রোববার তার দফতরে যুগান্তরকে তিনি বলেন, ‘পদত্যাগে বাধ্য করার প্রশ্নই ওঠে না, পুলিশ সুপার পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তাকে বাধ্য করা যায় না।’
তিনি স্বেছায় পদত্যাগ করেছেন দাবি করে আইজিপি বলেন, বাবুল আক্তার তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে পারেন ভেবে দীর্ঘদিন ওই পদত্যাগপত্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়নি। প্রায় দেড় মাস অপেক্ষার পর ওই পদত্যাগপত্র স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়।
আইজিপি বলেন, ‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ওই পদত্যাগপত্র পাঠানোর পরপরই তিনি (বাবুল) কাজে যোগ দেয়ার আবেদন করেন। কিন্তু সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা এখন আর পুলিশ সদর দফতরের হাতে নেই।’
এদিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. মোজাম্মেল হক খান রোববার যুগান্তরকে বলেন, বাবুল আক্তারের পদত্যাগ ও তা প্রত্যাহারের জন্য যে দুটি আবেদন করেছিলেন, তা রোববার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের পর তা নিষ্পত্তির জন্য মহামান্য রাষ্ট্রপতির দফতরে যাবে। তিনি (রাষ্ট্রপতি) যে সিদ্ধান্ত দেবেন সেটাই কার্যকর হবে।
সরকারের সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব বরাবরে ২৪ জুন চাকরি থেকে অব্যাহতি চেয়ে এবং ৯ আগস্ট তা প্রত্যাহারে দুটি পৃথক আবেদন করেন এসপি বাবুল।
অব্যাহতি প্রত্যাহারের আবেদনে তিনি দাবি করেন, ‘পরিস্থিতির শিকার হয়ে অনিচ্ছাকৃতভাবে বাধ্য হয়ে আমি অব্যাহতিপত্র স্বাক্ষর করেছি। এটি আমি স্বেচ্ছায় দাখিল করিনি।’ এছাড়া বাবুল আক্তার ৪ আগস্ট পুলিশ সদর দফতরের ডিআইজি (প্রশাসন) বরাবরে কাজে যোগদান করতে আরেকটি পত্র দেন।
সব মিলিয়ে আলোচিত এ পুলিশ কর্মকর্তার চাকরিতে ফেরা না ফেরা নিয়ে বিতর্ক যেন শেষই হচ্ছে না। পুলিশ সদর দফতর থেকে বাবুল আক্তারের পদত্যাগপত্র স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
আবার বাবুল আক্তার নিজেই বলছেন, তিনি পদত্যাগপত্র দেননি। আবার চাকরিতে যোগ দেয়ার আবেদনও করছেন।
সব মিলিয়ে পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আক্তারকে নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে এক ধরনের ধোঁয়াশা। জনমনে দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন। কি কারণে বাবুল আক্তারকে চাকরি থেকে পদত্যাগ করতে হবে সে প্রশ্নও তুলছেন কেউ কেউ।
সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু খুনের নেপথ্যে যদি বাবুল আক্তার কলকাঠি নেড়ে থাকেন তাহলে চাকরি থেকে পদত্যাগ করা তার সমাধান (বিচার) হতে পারে না। বিদ্যমান আইন অনুযায়ী তার বিচার হওয়া উচিত।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাবেক আইজিপি এমএ কাইয়ুম বলেন, বাবুল আক্তারের বিষয়ে অহেতুক জটিলতা সৃষ্টি করা হয়েছে। ওই রাতে এভাবে বাবুল আক্তারকে জিজ্ঞাসাবাদের নামে তুলে নিয়ে যাওয়ায় এ জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। ওই রাতে যদি তিনি (বাবুল) নিজেই পদত্যাগপত্র দেন তা আইনে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
তিনি বলেন, ওই পুলিশ কর্মকর্তা তার স্ত্রীর নেপথ্য ঘাতক বলে যেটা গুঞ্জন রয়েছে, আর সেটা যদি সত্যি হয়, তবে চাকরি থেকে অব্যাহতি বা পদত্যাগ কোনো সমাধান নয়। তিনি যদি স্ত্রী হত্যার নেপথ্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকেন তাহলে তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি কার্যক্রম চলা উচিত। অন্যথায় কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ ছাড়া তার চাকরিতে যোগদানে বাধা দেয়ার প্রশ্ন আসে কেন।
এক্ষেত্রে স্বচ্ছতার অনেক অভাব এবং এ নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এক প্রশ্নের জবাবে সাবেক এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘যতক্ষণ পর্যন্ত তার (বাবুল) পদত্যাগপত্র সংক্রান্ত সরকারি আদেশ জারি না হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি চাকরিরত বলে আমি মনে করি।’
প্রসঙ্গত, ৫ জুন স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু নির্মমভাবে খুন হওয়ার পর থেকেই এসপি বাবুল আক্তারকে নিয়ে চলছে নানা বিতর্ক। বিশেষ করে ৫ জুন স্ত্রী খুন হওয়ার ১৯ দিনের মাথায় (২৪ জুন) হঠাৎ করেই বাবুল আক্তারকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গোয়েন্দা কার্যালয়ে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর থেকেই শুরু হয় এ বিতর্ক।
মাহমুদা খানম মিতু হত্যা মামলার তদন্তের অগ্রগতি কিংবা ঘাতকদের গ্রেফতার নিয়ে তেমন আলোচনা না হলেও বাবুল আক্তারের কর্মস্থলে যোগ দেয়া নিয়ে চলছে নানা বিতর্ক। তবে চারদিকে যখন বিতর্ক বাবুল আক্তার তখনও থেকেছেন নিশ্চুপ।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.