বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রাণপুরুষ, বিদ্রোহ, সাম্য ও মানবতার কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৪০তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ১৯৭৬ সালের এ দিনে (১৩৮৩ বঙ্গাব্দের ১২ই ভাদ্র) ঢাকায় তৎকালীন পিজি হাসপাতালে (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের জাতীয় কবি। আমৃত্যু অন্যায়, অত্যাচার আর জুলুমের বিরুদ্ধে তিনি তার ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে পালন করেছেন সোচ্চার ও আপসহীন ভূমিকা। মানবতার জয়গানে উচ্চকণ্ঠ এ কবি লিখেছেন, ‘গাহি সাম্যের গান/ মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান…।’ সব রকম অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে কবি ‘চির উন্নত মম শীর’ বলে আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত হয়ে কখনও আপস করেননি। লোভ-লালসা, খ্যাতি, অর্থ, বিত্ত-বৈভবের কাছে মাথানত করেননি। উল্টো ‘হে দারিদ্র্য তুমি মোরে করেছো মহান’ এমন পঙ্ক্িতমালা রচনা করে দারিদ্র্যের জয়গান করেছেন মহান কবি। শোষিত-বঞ্চিত মানুষের মুক্তির জন্য আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন কবি নজরুল। মানবতার মুক্তির পাশাপাশি সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার, কূপমণ্ডূকতার বিরুদ্ধেও তিনি ছিলেন সোচ্চার। মুক্তবুদ্ধি ও চিন্তার পক্ষে কলম ধরেছেন নির্ভীক চিত্তে। তার রচিত ‘চল্ চল্ চল্’ গানটি আমাদের রণসংগীত। পরাধীনতার নিগড় থেকে বের হয়ে আসার জন্য তার আগুনঝরা কবিতা এবং গানের মধ্য দিয়ে আজীবন সংগ্রাম করেছেন মহান এ কবি। আজীবন বিদ্রোহী দৃষ্টিভঙ্গি আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার কণ্ঠের কারণে তিনি ভূষিত হন ‘বিদ্রোহী কবি’ অভিধায়। তিনি তার কবিতার পঙ্ক্তিমালায় তুলে ধরেছেন নিপীড়িত মানুষের কথা। বৃটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ছিলেন কবি নজরুল। বৃটিশ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে তিনি কারাভোগ করেছেন বারবার। নিষিদ্ধ হয়েছে তার একের পর এক গ্রন্থ। তবুও এই মহান পুরুষ বৃটিশ শাসকদের কাছে মাথানত করেননি। বাঙালির নবজাগরণ এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রেরণার উৎস ছিল তার গান ও কবিতা। প্রেমে ও দ্রোহে, কোমলে-কঠোরে বাংলা সাহিত্য ও সংগীতে কবি নজরুল ইসলাম দিয়েছেন নতুন মাত্রা। তার লেখাতে কবি যেমন বিদ্রোহী ছিলেন, তেমনি ছিলেন ব্যক্তিগত জীবনেও। ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে কুমিল্লা থেকে ফেরার পথে নজরুল দুটি বৈপ্লবিক সাহিত্যকর্মের সৃষ্টি করেন। একটি হচ্ছে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা ও অপরটি ‘ভাঙ্গার গান’। ১৯২২ সালে তার বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ অগ্নিবীণা প্রকাশিত হয়। ছোটগল্প, উপন্যাস, গান, নাটক সাহিত্যের সকল শাখায় স্বচ্ছন্দ বিচরণ করলেও মূলত কবি হিসেবেই তিনি পরিচিত ও প্রতিষ্ঠিত। কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ই জ্যৈষ্ঠ (১৮৯৯ সালের ১৪ই মে) পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে। পিতা কাজী ফকির আহমেদ, মা জাহেদা খাতুন। তার ডাক নাম ‘দুখু মিয়া’। ১৯৭২ সালের ২৪শে মে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগে ভারত সরকারের অনুমতি নিয়ে কবি নজরুলকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। সেই সঙ্গে তাকে দেয়া হয় জাতীয় কবির মর্যাদা। বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে অবদানের জন্য ১৯৭৪ সালের ৯ই ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কাজী নজরুলকে ডিলিট উপাধিতে ভূষিত করে। একই বছরের ২১শে ফেব্রুয়ারি তাকে দেয়া হয় একুশে পদক। কবির জীবনের শেষ দিনগুলো কাটে তৎকালীন পিজি হাসপাতালে। ৭৭ বছর বয়সে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের পাশে সমাধিস্থ করা হয়। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া পৃথক বাণী দিয়েছেন। আজ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় জাতীয় কবিকে স্মরণ করবে জাতি। জাতীয় কবির মৃতুবার্ষিকী উপলক্ষে বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও পেশাজীবী সংগঠন বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে কবির সমাধিতে পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন, ফাতেহা পাঠ ও আলোচনা। বাংলাদেশ বেতার, টেলিভিশন ও বিভিন্ন বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল কবির মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা প্রচার করবে। বাংলা একাডেমি দুইদিনব্যাপী কর্মসূচির অংশ হিসেবে আজ সকাল ৭টায় বাংলা একডেমির পক্ষ থেকে কবির সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবে। আগামীকাল বিকাল ৪টায় একাডেমির কবি শামসুর রাহমান সেমিনার কক্ষে একক বক্তৃতা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। এ ছাড়া নজরুল ইনস্টিটিউট, শিল্পকলা একাডেমি ও নজরুল সংগীত শিল্পী পরিষদ বিস্তারিত কর্মসূচি পালন করবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মসূচির মধ্যে আজ সকালে ফজরের নামাজের পর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদে কোরআনখানি, সকাল ৭টায় অপরাজেয় বাংলার পাদদেশ থেকে ছাত্র-ছাত্রী শিক্ষক কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের শোভাযাত্রা সহযোগে কবির সমাধি প্রাঙ্গণে পুষ্পার্পণ এবং ফাতেহা পাঠ করা হবে। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৪০তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ সকাল ৮টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ প্রাঙ্গণে কবির সমাধি সৌধে পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন, ফাতেহা পাঠ ও দোয়া মাহফিলে অংশ নেবেন। এ ছাড়া সকালে কবির কবরে শ্রদ্ধা জানাবেন বিএনপির নেতৃবৃন্দ।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.