নাছির উদ্দিন শোয়েব : দেশে গুম, অপহরণ ও আটকের পর নিখোঁজের ঘটনার মধ্য দিয়ে আজ মঙ্গলবার বিশ্বজুড়ে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক গুম দিবস (ইন্টারন্যাশনাল ডে ফর দ্য ডিসাপিয়ারড)। সারা পৃথিবীতে গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্মরণে আন্তর্জাতিক দিবস পালিত হয়ে আসছে। ২০০৬ সালের ২০শে ডিসেম্বর গুম হওয়া থেকে সকল ব্যক্তির সুরক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক সনদ জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত হয়। ফলে গুমের হাত থেকে সুরক্ষা পাবার অধিকারটি আন্তর্জাতিক আইনে পরিণত হয় এবং কাউকে গুম করে দেয়া মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃৃতি পায়।
২০১১ সাল থেকে প্রতিবছর ৩০শে আগস্ট গুম হওয়া মানুষগুলোকে স্মরণ এবং সে সঙ্গে তাদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানানোর জন্য দিবসটি পালন করা হচ্ছে বিশ্বব্যাপী। আর গুমের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে রাজনৈতিক নেতাকর্মীর পাশাপাশি আছে সাধারণ লোকজনও। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এদেশে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পরিচয়ে বিভিন্ন ব্যক্তিকে তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনাও বন্ধ হচ্ছে না।
মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের তথ্য অনুযায়ী ২০০৯ সাল থেকে ২০১৬ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৭ বছরে দেশে ২৪৮ জুন গুম হয়েছেন। মানবাধিকার সংস্থার তথ্য মতে ২০১৩ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের (২০১৬) ৩১ এপ্রিল পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৩ বছরে ২২০ জন গুম হওয়ার তথ্য থাকলেও পরবর্তীতে এদের মধ্যে ৩৯ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। ১৮ জনকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে এবং ২০ জন বিভিন্ন সময়ে মুক্তি পেয়েছেন। বাকি ১৪২ জনের কোনো হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১৪ মার্চ পর্যন্ত গুম হয়েছেন ১৪ জন।
এদিকে বিশিষ্টজনরা অভিযোগ করে বলেছেন, গুম-অপহরণ জঙ্গিবাদের মতোই একটি ভয়াবহ অপরাধ। গুমের ব্যাপারে বিশেষ আইন তৈরি করতে হবে। এ প্রসঙ্গে এক সেমিনারে লেখক ও কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, ‘গুম-অপহরণ জঙ্গিবাদের মতোই একটি ভয়াবহ অপরাধ। সুতরাং যদি জঙ্গিবাদ দমন করতে চাই তাহলে এ ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধকেও আগে দমন করতে হবে। গুমকে আমরা সহ্য করব, কিন্তু জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে বলবো এতে কোনো লাভ হবে না। সুতরাং বাংলাদেশে যদি আমরা আইনের শাসন, ন্যায়বিচার এবং মানবাধিকার রক্ষা করতে চাই তাহলে এর বিরুদ্ধে সবাইকে সোচ্চার হতে হবে। আমরা জঙ্গিবাদকেও দমন করব, গুম-খুন অপহরণ এ জিনিসগুলো সম্পর্কেও আমাদের অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে প্রতিবাদ করতে হবে।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, গুমের জন্য বিশেষ আইন তৈরি করতে হবে। সরকারকে এবং রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হবে যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যারা বেআইনি কাজ করছে তার প্রতিরোধ করবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যখন বেআইনিভাবে অপরাধীদের মতোই অপরাধ করে অপরাধ দমনের চেষ্টা করে, সে সমাজে কিন্তু অপরাধ বাড়ে, সে সমাজে অপরাধ কমে না।
২০১০ সালে ঢাকা সিটি করপোরেশনের তৎকালীন ওয়ার্ড কমিশনার চৌধুরী আলম এবং ২০১২ সালে সাবেক সংসদ সদস্য ইলিয়াস আলীর গুমের ঘটনা, ২০১২ সালে শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলাম ও ২০১৩ সালে একই সঙ্গে সাবেক সংসদ সদস্য সাইফুল ইসলাম হিরু ও লাকসাম পৌর বিএনপির সভাপতি হুমায়ন কবির পারভেজ, ২০১৩ সালে ঢাকায় একইদিনে সাজিদুল ইসলাম সুমন, মাজহারুল ইসলাম রাসেল, আব্দুল কাদের ভূঁইয়া মাসুম, আল আমিন, মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান রানা, তানভীর, এএম আদনান চৌধুরী, ২০১৪ সালে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের ওয়ার্ড কমিশনার নজরুল ইসলাম ও এডভোকেট চন্দন সরকারসহ মোট ৭ জনের গুম ও হত্যার ঘটনা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা।
মানবাধিকার সংস্থা-আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৩ সালে ৫৩ জন, ২০১৪ সালে ৮৮ জন ও ২০১৫ সালে ৫৫ জন গুম হয়েছেন। এই ১৯৬ জনের মধ্যে লাশ উদ্ধার হয়েছে ৩৬ জনের। গ্রেফতার দেখানো হয়েছে ১২ জনকে ও মুক্তি পেয়েছেন ১৯ জন। আর অপর মানবাধিকার সংস্থা- অধিকারের প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৩ সালে ৫৩ জন, ২০১৪ সালে ৩৯ জন, ২০১৫ সালে ৩৮ জন ও চলতি বছরের প্রথম ৫ মাসে ২৪ জন গুম হয়েছেন। তাদের মধ্যে লাশ পাওয়া গেছে ২৩ জনের। ফিরে এসেছেন ৬৩ জন ও ৬৭ জনের কোনো হদিস মেলেনি। অধিকারের হিসাবে চলতি বছরের প্রথম ৫ মাসে গুম হওয়া ২৪ জনের মধ্যে তিনজনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। ৫ জনকে আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে এবং ফিরে এসেছেন একজন। এখন পর্যন্ত কোনো হদিস পাওয়া যায়নি ১৫ জনের। এসব গুম-অপহরণের ঘটনায় র্যাব, পুলিশ কিংবা ডিবি পরিচয় দিয়ে তুলে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ করেছেন ভিকটিমদের স্বজনরা।
জানা গেছে, গত বছরের ১৫ জানুয়ারি রংপুরের মিঠাপুকুর থেকে দলিল লেখক আমিন, আমিনের স্ত্রী বিউটি ও প্রতিবেশী মৌসুমী এবং ৩১ জানুয়ারি মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডের একটি বাসা থেকে মিঠাপুকুর উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল বাসেত মারজানকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। ঘটনার ১৬ মাস পেরিয়ে গেলেও এই চারজনের কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। আত্মীয়স্বজন ঢাকায় ও রংপুরে একাধিক সংবাদ সম্মেলন করে স্বজনদের ফিরে পাওয়ার দাবি জানিয়েছেন। কিন্তু তাদের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। র্যাব-পুলিশও তাদের গ্রেফতারের বিষয়টি অস্বীকার করে আসছে। রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে চট্টগ্রামের শিপ ব্রেকিং ব্যবসায়ী গিয়াস উদ্দিন কুসুমকে ডিবি পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় গত বছরের ৩ জুলাই। তার স্ত্রী আফসানা নূর জুলি বলেন, প্রায় এক বছর হয়ে গেল তার স্বামীর কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। কেউ তাদের কাছে চাঁদাও দাবি করেনি। এ বিষয়ে উত্তরা পশ্চিম থানায় মামলা করেছেন তিনি। ওই মামলা তদন্ত করছে ডিবি পুলিশ। এখনও ব্যবসায়ী কুসুমের কোনো খোঁজ মেলেনি। চলতি বছরের ১৪ এপ্রিল শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলার গারো পাহাড়ের গজনী গ্রাম থেকে কলেজছাত্র প্রভাত মারাক, বিভাস সাংমা ও ওরাজেস মারাককে ময়মনসিংহের ভালুকা থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। এখন পর্যন্ত এই তিন ছাত্রের কোনো হদিস মেলেনি বলে তাদের পরিবার জানিয়েছে। গত বছরের ১৬ মার্চ ফকিরেরপুলের বাসা থেকে ছাপাখানা ব্যবসায়ী মাজহারুল ইসলাম রুবেলকে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে হ্যান্ডকাপ পরিয়ে তুলে নেয়া হয়। এর ৪ দিন পর ২০ মার্চ ফকিরেরপুল পানির ট্যাংকের কাছ থেকে ছাপাখানা কর্মচারী রাজু ইসলাম ও শাওনকে একইভাবে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। ২০১৪ সালের ৯ এপ্রিল ঢাকার কোর্ট-কাচারি এলাকা থেকে ব্যবসায়ী রহমত উল্লাহ সেন্টুকে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর তার আর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। তার স্ত্রী লাভলী আক্তার বলেন, একটি মামলাসংক্রান্ত বিষয়ে তিনি স্বামীকে সঙ্গে নিয়ে এক আইনজীবীর কাছে যান। সেখান থেকে বের হওয়ার পরপরই কয়েকজন যুবক তার স্বামীকে একটি মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায়। এখনও তার খোঁজ মেলেনি। রহমত উল¬াহ সেন্টুর বাসা নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের সানারপাড়। ২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা ও শাহীনবাগ থেকে বিএনপির নেতাসহ আটজনকে র্যাব পরিচয়ে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর থেকে তাদের আর কোনো হদিস নেই। নিখোঁজ আটজন হলেন : ঢাকার সাবেক ৩৮ নম্বর (২৫) ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাজেদুল ইসলাম সুমন, তার খালাতো ভাই জাহিদুল কবির তানভীর, মুগদার আসাদুজ্জামান রানা, উত্তর বাড্ডার আল আমিন, নাখালপাড়ার মাজহারুল ইসলাম রাসেল, শাহীনবাগের আবদুল কাদের ভূঁইয়া, কায়সার আহমেদ ও আদনান চৌধুরী। তাদের মধ্যে আদনান ও কাওসারকে শাহীনবাগের বাসা থেকে এবং অন্যদের বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে র্যাব পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। নিখোঁজ সাজেদুল ইসলাম সুমনের ছোট বোন সানজিদা ইসলাম বলেন, তার ভাইসহ আটজন নিখোঁজের ঘটনার পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশ সদর দফতর, র্যাব সদর দফতর, র্যাব-১ ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে লিখিত আবেদন করেও কোনো সুফল পাননি। ৯ মার্চ হাইকোর্টে রিট মামলা করেন তিনি। এর পরিপ্রেক্ষিতে সাজেদুল ইসলাম সুমনকে র্যাবের কালো পোশাক পরিহিত আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য কর্তৃক আটক/অপহরণ/গুম করা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট। তবে এসব অভিযোগ বরাবরই র্যাব ও পুলিশ অস্বীকার করে আসছে। তাদের বক্তব্য ‘র্যাব সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে আসামী গ্রেফতার করে। কোনো আসামীকে গ্রেফতারের সময় র্যাব সদস্যরা নিজেদের পরিচয় দেন এবং গ্রেফতারের পর আসামিকে সংশ্লিষ্ট থানায় সোপর্দ করেন। এ ক্ষেত্রে আইনের কোনো ব্যত্যয় ঘটে না। দুর্বৃত্তরা অনেক সময় র্যাব বা ডিবি পরিচয় দিয়ে অপহরণ করে থাকতে পারে। অপহরণ মামলায় বিভিন্ন সময়ে আসামী গ্রেফতার হওয়ার পর ভুয়া র্যাব বা ডিবি পরিচয়ে অপহরণের প্রমাণ পেয়েছে র্যাব। তাই যারা র্যাবের বিরুদ্ধে গুমের অভিযোগ আনে সেগুলো সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।
একই বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ সবসময় নিজেদের পরিচয় ব্যবহার করে সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে আসামি গ্রেফতার করে থাকে বলে দাবি করা হয়েছে। পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ডিবি পুলিশ ডিবির ইউনিফর্ম পরে অভিযান চালায়। গুম-অপহরণজাতীয় অভিযোগের সঙ্গে কোনোভাবেই পুলিশ বা ডিবি সম্পৃক্ত নয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দুর্বৃত্তরা অপকর্মের কৌশল হিসেবে ডিবি বা পুলিশের পরিচয় ব্যবহার করতে পারে। এ ধরনের বিষয়ে সন্দেহ হলে লোকজন নিকটতম থানায় যোগাযোগ করতে পারে। ডিবি বা পুলিশ আসামি ধরার পর আইন অনুযায়ী আদালতে সোপর্দ করে থাকে।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.