১৯৮৮ সাল। চারদিকে থৈ থৈ পানি। মানুষ পরিবার-পরিজন নিয়ে দিশাহারা একটু আশ্রয় আর ভরসার জায়গা খুঁজে বের করতে। ঠিক তখন বান যেন মহাপ্রলয় হয়ে লণ্ডভণ্ড করে দেয় মরিয়মের সংসার। ৩টি অবুঝ সন্তান আর মরিয়মের মাথায় একগাদা ঋণ রেখে একদিন না ফেরার দেশে চলে যায় স্বামী বারেক মিয়া। সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটিকে হারিয়ে সত্যিকার বানের জলে ডুবে যায় মরিয়মের সোনার সংসার। সন্তানদের মুখের আহার আর পাওনাদারদের অহর্নিশি তাগাদায় দিশাহারা হয়ে উঠে সে। তবে আত্মপ্রত্যয়ে আবারো উঠে দাঁড়ায় মরিয়ম। বাবার বাড়ি থেকে শিখে আসা বাঁশ-বেতের কাজকে বেঁচে থাকার অবলম্বন হিসেবে ধরে নিয়ে সামনে পা বাড়ায় আত্মপ্রত্যয়ে উজ্জীবিত নারী। একশো কুড়ি টাকা আর ৩ অবুঝ শিশুপুত্র নিয়ে শুরু হয় মরিয়মের নতুন অধ্যায়। নতুনভাবে বেঁচে থাকা আর একটি অজোগ্রামকে কর্মমুখর করে তোলার গল্প। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার সদর ইউনিয়নের গুতিয়াবো আগারপাড়া গ্রাম। বর্তমানে এই গ্রামের পাশেই গড়ে উঠেছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাউজক) এর পূর্বাচল প্রকল্প। প্রস্তাবিত আছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ইমারত ১৪২ তলা ট্রেড সেন্টার নির্মাণের। কিন্তু ২৮ বছর আগে দেশের অন্ধকারাচ্ছন্ন আর দশটা পল্লী গ্রামের মতোই ছিল গুতিয়াব আগারপাড়া। গ্রামের ৯৫ ভাগ মানুষ ছিল কৃষিতে নির্ভরশীল। গ্রামের একেকটি পরিবার ছিল নুন আনতে পান্তা ফুরানোর মতোই হতদরিদ্রতায় মোড়ানো। মরিয়মের স্বামী বারেক মিয়া যখন মারা যান তখন বড় ছেলে আলী হোসেন সবে ৯ বছরে পা রেখেছে। মেঝো নুর মোহাম্মদ ৭ বছরের আর ছোট ছেলে ওয়াদ আলীর বয়স মাত্র ৬ মাস। এরকম একটা পরিস্থিতিতে ভেঙ্গে পড়েননি মরিয়ম। বাবার বাড়ি থেকে নিয়ে আসা দুটো জিনিসকে কাজে লাগিয়ে পুরো গ্রামকে কর্মমুখর জনপদ করে ফেলে এই নারী। সেখান থেকে শিখে আসা বাঁশ-বেতের কাজ আর সেই অমীয় বাণী “আতের (হাতের) কাম জানা মাইনষে, ভাতে মরে না”। সঞ্চিত ১২০টি টাকায় বড় ছেলেকে দিয়ে দুটো বাঁশ কিনে আনান মরিয়ম। এই বাঁশ দা‘য়ের সাহায্যে চটে-চেফে আর ফালি করে হাতের নিপুণ গাঁথুনিতে একটি ছন্দময় কবিতা লিখেন, যার স্থানীয় নাম পাতি (টুকরি)। গ্রামে তরিতরকারিসহ মালামাল বহন, বালু, মাটি বহনসহ কৃষকদের একটি নিত্যপ্রয়োজনীয় বস্তু হচ্ছে বাঁশের পাতি। বড় দুই ছেলের সহায়তায় মরিয়মের সেই একশো কুড়ি টাকার বাঁশ ৩০০ টাকার পাতি হয়ে যায় মাত্র ২ দিনে। এরপর ৬শ’, ছয় হাজার আর দিনে দিনে ছয়লাখ হতেই থাকে। নতুন একটি কাজ পেয়ে কর্মচাঞ্চল্য ফিরে আসে আগারপাড়া গ্রামে। তার দেখাদেখি কয়েক মাসেই গ্রামের জীবিকার প্রধান উৎস হয়ে উঠে বাঁশের পাতি তৈরি। সৃষ্টি হয় আরো নানামুখী কর্মসংস্থান। কেউ বাঁশের ব্যবসা করছে, কেউবা ফরিয়া ব্যাপারী, কেউ গিটের সুতলি বিক্রি করেন। কেউ পাতি নিয়ে হাটবাজারে ফেরি করে বেড়ান আবার পয়সাওয়ালা কেউ কেউ চুক্তিতে কারিগর খাটিয়ে নিজেরাই একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। রোববার মানবজমিনের এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় মরিয়ম বেগমের মেঝো ছেলে নুর মোহাম্মদের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আব্বায় মরণের পর মায় যেইভাবে কামরা শুরু করছে দেখলে তাইজ্জব অইয়া যাইতেন ভাই। তহন মায়রে আমরা সাহাইয্য করছি আর অনে আমাগো থেইক্কা ভালা কারিগর আছে গেরামে। গেরামে চাইর/পাঁচশো মানুষ অহন এই কাম করে। আল্লার রকমতে বেবাকতেই ভালা আছি আমরা। দোয়া কইরেন আঙ্গো ( আমাদের) লাইগ্যা।’ গ্রামে ঘুরে দেখা যায় বিশাল এক কর্মযজ্ঞ চলছে আগারপাড়া গ্রামে। কারো ফুসরত নেই কথা বলার, সবাই ব্যস্ত স্ব স্ব কাজে। কেউ বাঁশ কাটছে, কেউবা চেঁছে দিচ্ছে। কেউ গিঁট গাড়ছে। কেউবা রানার হয়ে বাঁশ ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে টুকরির রূপ দিচ্ছে। অনেকে তলা করে দিচ্ছে। অবাক করার বিষয় একটি পরিবারের ৫-৬ বছরের শিশু থেকে শুরু করে ৮০-৯০ বছরের বৃদ্ধটিও দক্ষতার সঙ্গে তাদের কাজটি করে যাচ্ছে। বাচ্চারা এই কাজ করে স্কুলে যায় না? এমন প্রশ্নের জবাবে কারিগর সিরাজুল ইসলাম সিরা বলেন, বেকতেই পড়ে ভাইজান, আজাইরা টাইমে ওরা কাজ কইরা ওগো বই খাতা, জামা কাপড়, স্কুল ড্রেস, বেতন, টিফিন খরচ আর মোবাইলের ফ্লেক্সিলোড করে। অর্থ আগমনের কারণে গ্রামে ৩-৪টি কিন্ডার গার্টেনসহ একটি প্রাথমিক ও একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়। রয়েছে বড় দুটি বাজার, সম্প্রতি এই গ্রামেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে রূপগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদ। এলাকার ইউপি সদস্য মোরশেদ আলম জানান, গ্রামে প্রায় ৩-৪শ’ পরিবার এ পেশায় জড়িত। প্রতিদিন সকাল অথবা বিকালে এই এলাকারই পাইকার আরব আলী, মোন্তাজউদ্দিন, আনোয়ার হোসেন, সনুরুদ্দিন, জামান মিয়ার স্ত্রীসহ ১৫-২০ বেপারী ও তাদের লোকজন কারিগরদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে তৈরি করা পাতি (টুকরি) ৫০ থেকে ৫৫ টাকা দরে কিনে নিয়ে যায়। সেগুলো তারা আবার ডেমরা সারুলিয়া, কাঁচপুর, বেরাইদ, যাত্রাবাড়ী, কুমিল্লা, গাজীপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় নিয়ে বিক্রি করে। এসব বিক্রি করে তারাও আছেন বেশ ভালোই। কারিগর সিরাজুল ইসলাম সিরা বলেন, প্রতিটি পাতি (টুকরি) তৈরি করতে মজুরিসহ মোট খরচ লাগে ৪০-৪৫ টাকা। বিক্রি করা যায় ৫০-৫৫ টাকা। গ্রামের আশেপাশে কাছাকাছি কোনো মিল-কারখানা না থাকায় গ্রামের প্রায় সব পরিবার আজ এ পেশায় জড়িত। প্রায় সারা বছরই এ পাতির (টুকরি) চাহিদা রয়েছে। প্রতিদিন একজন লোক ইচ্ছে করলে ২০-২৫টি পাতি (টুকরি) তৈরি করতে পারে। তিনি আরো বলেন, কয়েকবছর আগে এই পাতির (টুকরি) চাহিদা আরো ব্যাপক ছিল। বর্তমানে আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার সব জায়গায় হওয়ায় তার কিছুটা কমে গেছে। এ ব্যাপারে স্থানীয় সংবাদকর্মী রাসেল মাহমুদ বলেন, আমাদের এলাকার চারদিকে বিভিন্ন আবাসন কোম্পানী প্রবেশ করায় প্রায় বেশির ভাগ কৃষি জমি তারা বালু দিয়ে ভরাট করে ফেলেছে। এছাড়া কাছাকাছি কোনো মিল-কারখানা না থাকায় গ্রামের প্রায় সকলেই আজ এ পেশায় জড়িত। আর এতে অনেকেই আজ সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.