চারদিকে মহাহইচই। গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি উপেক্ষা করে চলছে স্লোগান- ‘রিশার খুনির ফাঁসি চাই’, ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস ফর রিশা’। গতকাল সোমবার দুপুরে কাকরাইলে অবস্থিত উইলস লিটল ফাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজের চারপাশে যখন এত শোরগোল তখন স্কুলের ভেতরেই একটি প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে ঠোঁট চেপে কাঁদছিলেন অসুস্থ তানিয়া হোসেন। যিনি একদিন আগেই হারিয়েছেন তার নাড়িছেঁড়া ধন সুরাইয়া আক্তার রিশাকে। ‘জাতীয় নারী নির্যাতন প্রতিরোধ’ দিবসে (২৪ আগস্ট) এক বখাটে যুবকের ছুরিকাঘাতে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ুয়া আদুরে মেয়েকে হারান হতভাগ্য ওই মা। তিনি অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন হাতে ধরা মোবাইলের স্ক্রিনে; যেখানে ভাসছে রিশার ছবি। কখনো দেখছিলেন অসুস্থ ও মৃত রিশার ছবি, কখনো হাস্যোজ্জ্বল মেয়ের মায়াবি মুখ। বারবার স্ক্রিনের ছবি পাল্টাচ্ছিলেন আর বিড়বিড় করছিলেন আপনমনে।
তানিয়া হোসেন প্লাস্টিকের যে চেয়ারটিতে বসা, সেটি ধরে দাঁড়িয়ে ছিলেন রিশার প্রিয় বান্ধবী উমাইয়া। তারও চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে জল। নিজেকে সামলে নিয়ে রিশার মাকে জড়িয়ে ধরলেন। অনুরোধ করলেন কান্না থামানোর। কিন্তু তানিয়া হোসেনের কান্না বন্ধ হলো না, বরং আর্তনাদ করে কেঁদে ওঠেন তিনি। বলেন, ‘মা রে, বুকটা ফেটে যাচ্ছে, কী করে কান্না থামাব?’ এ সময় উপস্থিত সবার চোখ ছলছল। কেউ কাঁদছে উচ্চৈঃস্বরে, কেউবা ফুঁপিয়ে। বন্ধুহারা উমাইয়া কাঁদতে কাঁদতে বলেন, রিশা যে আমাদের এত্ত আপন ছিল, বুঝিনি।
এদিকে পুলিশ প্রশাসনকে ২৪ ঘণ্টা বেঁধে দেওয়া সময়েও রিশা হত্যার আসামিকে গ্রেপ্তার করতে না পারায় দ্বিতীয় দিনের মতো গতকাল রাজধানীর কাকরাইল মোড় অবরোধ করে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন উইলস লিটল ফাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিার্থীরা। স্কুলে বিােভ ও মানববন্ধন কর্মসূচি শেষে গতকাল দুপুর ১২টার দিকে রাস্তা অবরোধ করেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। এ সময় শিার্থীদের ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস ফর রিশা’ ‘রিশা হত্যাকারীর ফাঁসি চাই’, ‘রিশা হত্যাকারীকে গ্রেপ্তার করো’ এ ধরনের নানা স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে চারপাশ। কোনো কোনো শিার্থী কালো ও লাল কালিতে লেখা ‘রিশা হত্যাকারীর ফাঁসি চাই’ ফেস্টুন হাতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ােভের প্রকাশ ঘটান।
দুপুর একটার দিকে আন্দোলনরত শিার্থীদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেন গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার। এ সময় তিনি শিার্থীদের আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, আমরা এ হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই। শিার্থীরা যে আন্দোলনই করুক না কেন, গণজাগরণ মঞ্চ সেই আন্দোলনে কর্মী হিসেবে পাশে থাকবে। আজ ১২টা থেকে আন্দোলনরত শিার্থীদের সঙ্গে কর্মসূচিতে গণজাগরণ মঞ্চ অংশগ্রহণ করবে বলেও জানান তিনি।
শিার্থীদের সড়ক অবরোধ কর্মসূচির কারণে গতকাল দুপুরে প্রায় ২ ঘণ্টার মতো কাকরাইল, পল্টন, সেগুনবাগিচা ও শান্তিনগর এলাকার সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পরে পুলিশের পক্ষ থেকে রিশার সন্দেহভাজন হত্যাকারী ওবায়েদুলকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তার করা হবে বলে প্রতিশ্রুতি প্রদান এবং শিার্থীদের রাজপথে আন্দোলন না করার অনুরোধ জানানো হলে দুপুর সোয়া ২টার দিকে অন্দোলন ও অবস্থান কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নেন শিার্থীরা। তবে আজ মঙ্গলবার দুপুর ১২টার মধ্যে রিশার খুনিকে গ্রেপ্তার করা না হলে ফের আন্দোলনের ঘোষণা দেন শিার্থীরা। একইসঙ্গে আগামী ৩১ আগস্ট সারা দেশের সব শিা প্রতিষ্ঠানের শিার্থীদের নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের সামনে দাঁড়িয়ে দুপুর ১২টা থেকে একটা পর্যন্ত ঘণ্টাব্যাপী একযোগে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করার আহ্বান জানানো হয়। আন্দোলনকারী শিার্থীদের পে উইলস লিটল ফাওয়ার কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিার্থী মুনতাসির মাহমুদ এ ঘোষণা দেন।
রিশা হত্যাকাণ্ডে ক্ষোভ প্রকাশ করে গতকাল দুপুরে রিশার স্কুলের শিক ও সহপাঠীরা অভিযুক্ত ওবায়েদুলের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে স্কুলে ও রাস্তায় দাঁড়িয়ে মানববন্ধন করেন। এ সময় রিশার পরিবার ও স্বজনরাও মানববন্ধনে যোগ দেন। কর্মসূচিতে আশপাশের স্কুলের শিক, শিার্থী, গণজাগরণ মঞ্চ ও বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের কর্মীরা একাত্মতা প্রকাশ করেন। বেলা ১১টার দিকে উইলস লিটল ফাওয়ার স্কুল মাঠে সহপাঠীদের উদ্যোগে আয়োজিত শোকসভা ও প্রতিবাদী মানববন্ধনে এসে কান্নায় ভেঙে পড়েন রিশার মা। দুপুরে ওই স্কুলের শিক্ষার্থীদের কর্মসূচিতে গিয়ে সমবেদনা জানান শিামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। এ সময় তিনিও রিশার খুনির ফাঁসি দাবি করেন।
দুপুর দেড়টার দিকে রমনা বিভাগ পুলিশের সহকারী কমিশনার শিবলী নোমান ঘটনাস্থলে গিয়ে শিার্থীদের জানান, তাদের কাছে কেবল খুনি ওবায়েদুলের নাম ছিল। এখন তার স্থায়ী ও অস্থায়ী ঠিকানা, ছবি পাওয়া গেছে। তাকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি সময়ের ব্যাপার মাত্র। আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিকে গ্রেপ্তারের আশ্বাস দিয়ে তিনি শিার্থীদের সড়কে আন্দোলন না করার আহ্বান জানিয়ে কাসে ফিরে যাওয়ার অনুরোধ করেন।
এদিকে রিশার মৃত্যুর ঘটনায় অভিযুক্ত ওবায়েদুল খান ও অন্যদের আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তার চেয়ে গতকাল সোমবার পুলিশের আইজিপি, র্যাবের ডিজি ও স্বরাষ্ট্র সচিব বরাবর লিগ্যাল নোটিশ পাঠান সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইউনুস আলী আকন্দ। তিনি বলেন, এই ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার করা না হলে এ বিষয়ে একটি রিট করা হবে।
উইলস লিটল ফাওয়ার বিদ্যালয়ের শিার্থী রেজোয়ান ইসলাম বলেন, রিশা হত্যাকারীর ফাঁসি দেওয়া উচিত। অষ্টম শ্রেণির শিার্থী রিশাকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। আমরা হত্যাকারীর ফাঁসি চাই। তাকে গ্রেপ্তার করা হোক।
আরেক শিার্থী সানজানা আফিয়া বলেন, যে পর্যন্ত হত্যাকারী ওবায়েদুলকে গ্রেপ্তার করা না হবে, আমরা রাস্তা থেকে সরব না। স্বাধীন দেশে কেন এমন হবে? এই দেশে আমাদের কোনো নিরাপত্তা নেই কেন? এ সময় শিার্থীদের ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস/ওবায়েদুলের ফাঁসি চাই’ এমন সেøাগান দিতে দেখা যায়। গতকাল দুপুর দুইটার দিকে উচ্চমাধ্যমিক ২য় বর্ষের ছাত্র মুনতাসির মামুন নিজেকে এই আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী ঘোষণা করে বলেন, হত্যাকারীকে যতণ পর্যন্ত গ্রেপ্তার ও বিচারের আওতায় আনা না হবে, ততণ পর্যন্ত আমরা এই আন্দোলন চালিয়ে যাব। ৩১ আগস্ট বেলা ১২টায় দেশের সব শিা প্রতিষ্ঠানকে রিশা হত্যাকারীর বিচারের দাবিতে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করারও আহ্বান জানান তিনি।
গতকাল উইলস লিটল স্কুলের মিলনায়তনে রিশার মৃত্যুতে অনুষ্ঠিত শোকসভায় বিদ্যালয়টির শিক, শিার্থী ও অভিভাবকরা যোগ দেন। এ সময় বক্তারা হত্যাকারীকে দ্রুত গ্রেপ্তার ও তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান।
শোকসভায় শিামন্ত্রী বলেন, যারা আমাদের শিার্থীদের হত্যা করে, তারা মানুষ নামের পশু। এই হত্যা আমি মেনে নিতে পারি না। আমি সুস্পষ্ট করে বলতে চাই, শিার্থীদের কারো গায়ে আঘাত মানবো না। তাদের নিরাপত্তা চাই। কোনো শিার্থী ভুল করলে আমাকে বিচার দেবেন, আমি তা দেখব। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলেছি, সারা দেশের শিা প্রতিষ্ঠান ও পরিবারের দাবি, খুনির বিচার। এটা অবিলম্বে কার্যকর করতে হবে। ঘাতক ওবায়েদুলের ছবি গণমাধ্যমে এসেছে জানিয়ে তিনি বলেন, সে এখন আর অপরিচিত নয়। তাকে যে যেখানে দেখবেন, সেখানেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে খবর দিয়ে ধরিয়ে দেবেন। শোকসভায় রিশার পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে শোকসভায় অংশগ্রহণের আগে রিশা হত্যার বিচার দাবি করে শিক্ষার্থীরা শিামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদকে স্কুলের সামনে ঘিরে ধরেন। এ সময় শিক্ষার্থীরা ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ সেøাগান দিতে থাকেন।
রিশার বাবা রমজান আলী গতকাল বলেন, ঘটনার পর পাঁচ দিন পেরিয়ে গেলেও পুলিশ ওবায়েদুলকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। এতে আমরা বিস্মিত। রিশা হত্যার সর্বোচ্চ বিচারের দাবি জানান তিনি।
ঢাকা মহানগর পুলিশের ডিসি (গণমাধ্যম) মাসুদুর রহমান জানান, সুরাইয়া আক্তার রিশার হত্যাকারীকে গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে। আসামি ওবায়েদুলের বাড়িতে তল্লাশি চালানো হয়েছে। চাঞ্চল্যকর বিধায় পুলিশ ও ডিবি পুলিশ সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে এ ঘটনার তদন্ত করছে। জানা গেছে, বখাটে ওবায়েদুল প্রায়ই রিশার স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকত। ঘটনার দিনও সে স্কুলের সামনে দণ্ডায়মান ছিল। রিশার সঙ্গে কথা বলার একপর্যায়ে তাকে ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যায় ওবায়েদুল। তাকে গ্রেপ্তারের জন্য পুলিশ ও মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.