দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানিতে সবচেয়ে বড় বাজার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। অবশ্য পোশাকের পাশাপাশি সম্ভাবনাময় এই বাজারে বাংলাদেশে প্রস্তুত করা বিভিন্ন ধরনের জুতার রপ্তানিও বাড়ছে। গত বছর বাংলাদেশে থেকে ১০ কোটি ৪৯ লাখ মার্কিন ডলার বা ৮৭১ কোটি টাকার সমপরিমাণ মূল্যের ৪১ লাখ ৮০ হাজার জোড়া জুতা যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হয়। ২০১৪ সালে ৬ কোটি ১৪ লাখ মার্কিন ডলার সমপরিমাণ মূল্যের ২৫ লাখ ৫৪ হাজার জোড়া জুতা রপ্তানি হয়েছিল। এর মানে, পরিমাণের দিক থেকে ২০১৪ সালের চেয়ে ২০১৫ সালে জুতা রপ্তানি ৬৩ শতাংশ বেড়েছে। এদিকে, চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে (জানুয়ারি-জুলাই) ৫ কোটি ১৩ লাখ ডলার সমমূল্যের ২০ লাখ জোড়া জুতা বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হয়েছে। গত বছর একই সময়ে রপ্তানি হয়েছিল ১৯ লাখ জোড়া জুতা। যার আর্থিক মূল্য ছিল ৪ কোটি ৮৫ লাখ মার্কিন ডলার। ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব কমার্সের অফিস অব টেক্সটাইল অ্যান্ড অ্যাপারেল (অটেক্সা) নিয়মিতভাবে যুক্তরাষ্ট্রের জুতা আমদানি-রপ্তানির হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করে। এতে দেখা যায়, গত বছর বিভিন্ন দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্র ২ হাজার ৬৮২ কোটি ডলার সমপরিমাণ মূল্যের ২৪৬ কোটি জোড়া জুতা আমদানি করেছে। এর মধ্যে চীন থেকেই সবচেয়ে বেশি ৭৬ শতাংশ বা ১৮৮ কোটি জোড়া জুতা দেশটিতে রপ্তানি হয়েছে। পরের অবস্থানে আছে ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, কম্বোডিয়া, ভারত, ইতালি, মেক্সিকো ইত্যাদি দেশ। অর্থ কিংবা পরিমাণের হিসাবে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে জুতা রপ্তানিতে বাংলাদেশ অন্য দেশের চেয়ে এখনো বেশ নিচের দিকে থাকলেও গত আট বছরে বেশ এগিয়েছে। ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের জুতা রপ্তানি ছিল মাত্র ৪০ লাখ ডলার। ২০১০ সালে তা দ্বিগুণ বেড়ে ৮২ লাখ হয়। ২০১২ সালে গিয়ে সেটি তিন গুণ বেড়ে হয় ২ কোটি ৬৭ লাখ ডলার। সব মিলিয়ে আট বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশের জুতা রপ্তানি ২৬ গুণ বেড়ে ১০ কোটি ৪৯ লাখ ডলার হয়েছে। অবশ্য বাজার হিস্যা হিসাব করলে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের মোট জুতা আমদানির মাত্র শূন্য দশমিক ৬২ শতাংশ বাংলাদেশের। লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (এলএফএমইএবি) বলছে, সারা দেশে জুতা রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১২০টির মতো। বাংলাদেশের জুতা রপ্তানির প্রায় ৬৫ শতাংশ হয় ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে। তারপরেই জাপান, ২০-২৫ শতাংশ। আর যুক্তরাষ্ট্রে ১০-১৫ শতাংশের মধ্যে। এই পণ্যের মূল্য সংযোজনের পরিমাণ ৮০-৮৫ শতাংশ। বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হওয়া জুতার মধ্যে বর্তমানে ৮১ শতাংশই চামড়ার তৈরি। গত বছর ৯ কোটি ৮৪ লাখ ডলার সমমূল্যের ৩৪ লাখ জোড়া চামড়ার জুতা রপ্তানি হয়। ২০১৪ সালে রপ্তানি হয়েছিল ২১ লাখ জোড়া চামড়ার জুতা, যার আর্থিক মূল্য ছিল ৫ কোটি ৮৫ লাখ ডলার। তার মানে, পরিমাণের দিক থেকে হিসাব করলে ২০১৫ সালে তার আগের বছরের তুলনায় চামড়ার তৈরি জুতা রপ্তানি ৬১ শতাংশ বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি অন্যান্য দেশেও চামড়ার জুতা রপ্তানি বাড়ছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরের প্রথম দুই মাস অর্থাৎ জুলাই-আগস্টে ১২ কোটি ডলারের জুতা রপ্তানি হয়েছে। এই আয় গত অর্থবছরের একই সময়ের ৯ কোটি ৭৫ লাখ ডলারের চেয়ে ২৩ দশমিক ৬২ শতাংশ বেশি। গত ২০১৫-১৬ অর্থবছর ৪৯ কোটি ডলারের বা ৩ হাজার ৯২০ কোটি টাকার চামড়ার জুতা রপ্তানি হয়। চামড়ার পাশাপাশি কাপড়, সিনথেটিক, প্লাস্টিক ও রাবারের জুতা রপ্তানিও প্রতিবছর বেড়ে চলেছে। ইপিবির হিসাবে, চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে ৪ কোটি ডলারের চামড়াবিহীন বা নন-লেদার জুতা রপ্তানি হয়েছে। এই আয় গত অর্থবছরের একই সময়ের ৩ কোটি ১৫ লাখ ডলারের চেয়ে ২৮ শতাংশ বেশি। গত অর্থবছর চামড়াবিহীন জুতা রপ্তানি করেই বাংলাদেশ ২১ কোটি ৯১ লাখ ডলার বা ১ হাজার ৭৫২ কোটি টাকা আয় করে। জানতে চাইলে বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএলএলএফইএ) চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন আহমেদ গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে জুতা রপ্তানির সিংহভাগই চীনের দখলে। তবে চীনে শ্রমিকের মজুরি এতটাই বেড়ে গেছে যে জুতা কারখানার জন্য লোক পাওয়া যাচ্ছে না। তবে প্রচুর সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও উৎপাদনের সব পর্যায়ে উন্নত কর্মপরিবেশের (কমপ্লায়েন্স) ঘাটতি থাকায় যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্য বাজারগুলোতে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় জুতা রপ্তানি বাড়েনি। তবে রাজধানীর হাজারীবাগ থেকে সাভারের চামড়াশিল্প নগরীতে ট্যানারি স্থানান্তর হয়ে গেলে জুতা রপ্তানি বাড়বে। বিষয়টি ব্যাখ্যা করে মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘দামি জুতা কেনে—এমন বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ডগুলোর জন্য পণ্য উৎপাদনে কমপ্লায়েন্সের কারণে হাজারীবাগে প্রক্রিয়াজাত হওয়া চামড়া ব্যবহার করা যায় না। নিষেধাজ্ঞা আছে। সে ক্ষেত্রে বিদেশ থেকে চামড়া আমদানি করতে হয়; নয়তো কম দামের জুতা কেনে এমন ব্র্যান্ডের কাজ করতে হয়। এতে করে আমাদের মূল্য সংযোজন কমে যায়।’ তিনি আরও বলেন, বর্জ্য পরিশোধনের জন্য শুধু সিইটিপি স্থাপনই শেষ কথা নয়; ট্যানারি স্থাপনে কারখানার প্রতিটি ধাপেই কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করতে হবে। সে ক্ষেত্রে কোনো ধরনের তাড়াহুড়ো করা ঠিক হবে না।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.