মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির বাংলাদেশ সফর নানা দিক থেকেই ছিল গুরুত্বপূর্ণ। সফর সংক্ষিপ্ত হলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ ছাড়াও মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গেও বৈঠক করেছেন। পাশাপাশি ঢাকার এডওয়ার্ড কেনেডি সেন্টারে তিনি নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও কথা বলেছেন। বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে গিয়ে জাতির জনকের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনও করেছেন তিনি, যা ছিল অনন্য একটি ঘটনা। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের দূরদর্শিতার কারণেই যে বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন ভূখণ্ড প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়েছে সেটি উঠে আসে তাঁর মন্তব্যে। এবং ৩২ নম্বরের বাড়িটিই যে একসময় বাঙালির সব আন্দোলন-সংগ্রামের কেন্দ্রবিন্দু ছিল সেটিও তিনি বলেছেন।
নানা কারণেই কেরির সফর নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। বিশেষ করে নাইন-ইলেভেনের পর সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের যে অবস্থান, তা আরো জোরদার হয়েছে সাম্প্রতিক ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদের প্রেক্ষাপটে। বাংলাদেশও উগ্রবাদের সমস্যা থেকে মুক্ত নয়। এ কারণে সন্ত্রাসবাদের মতো অভিন্ন ইস্যুতে একসঙ্গে কাজ করতে চায় দুটি দেশ। এ নিয়ে কেরির সফরকালেও আলোচনা হয়েছে। এর আগে যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় নেওয়া বঙ্গবন্ধুর খুনি রাশেদ চৌধুরীকে দেশে ফেরত পাঠানোর বিষয়টি দেখার আশ্বাস দেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি। সোমবার দুপুরে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় কেরির সঙ্গে বৈঠক শেষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী এ কথা সাংবাদিকদের জানান। সাম্প্রতিক জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জিরো টলারেন্স নীতির ভূয়সী প্রশংসা করেছেন জন কেরি। জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস মোকাবিলায় দুই দেশের পারস্পরিক সহযোগিতার নানা দিক নিয়েও কথা হয়েছে।
জন কেরির এই সফরে অনেক বিষয়েই খোলামেলা আলোচনা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশ বাংলাদেশকে যে অনেক আগ্রহের সঙ্গে দেখে—সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না। উন্নয়নের মহাসড়কে এখন বাংলাদেশ। জঙ্গিবাদ মোকাবিলায়ও সাফল্য দেখাচ্ছে সরকার। এ ছাড়া গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদান, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা, নারীর ক্ষমতায়ন, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা, বিনিয়োগ বৃদ্ধির পরিবেশ সৃষ্টি, পোশাকশিল্পে কর্মপরিবেশের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর ঘাতক রাশেদ চৌধুরীকে ফিরিয়ে দিলে সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে আরো নতুন মাত্রা যোগ হবে সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না।
জন কেরির সফরের সময় যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের পণ্যের শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা নিশ্চিত করার অনুরোধ জানানো হয়েছে তাঁকে। বিশেষ করে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের জিএসপি সুবিধা পুনর্বহালের দাবি জানানো হয়েছে তাঁর কাছে। তিনি এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট কোনো বক্তব্য না দিলেও ইশারা-ইঙ্গিতে কিছু শর্তের কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন। সেগুলো পূরণ হলে আবারও যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক জিএসপি সুবিধা পাবে—এমন আশ্বাসও পাওয়া গেছে তাঁর কথায়।
আশির দশকে বাসাবাড়িতে ছোট পরিসরে যে পোশাকশিল্পের সূচনা হয়েছিল, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সেটিই এখন সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রার জোগান দিচ্ছে। চীনের পর বাংলাদেশই হচ্ছে দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ। পাঁচ হাজারেরও বেশি কারখানায় প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক কাজ করে।
এ কথা ঠিক, বাংলাদেশে পোশাকশিল্পের একের পর সমৃদ্ধি ঘটেছে ঠিকই, কিন্তু সে অনুযায়ী বাড়েনি শ্রমিকের জীবনমান। উল্টো একের পর এক দুর্ঘটনায় শ্রমিকের জীবন যাচ্ছে অকাতরে। যার বড় উদাহরণ হচ্ছে রানা প্লাজা ধসে সহস্রাধিক শ্রমিকের করুণ মৃত্যু। জন কেরি বাংলাদেশ সফরের সময় রানা প্লাজার প্রসঙ্গ তুলতে কিন্তু ভুল করেননি।
এ ছাড়া ২০০৫ সালের পর শুধু অগ্নিকাণ্ডজনিত দুর্ঘটনায়ই প্রাণ হারিয়েছে ছয় শতাধিক শ্রমিক। এসব ঘটনায় বাংলাদেশের পোশাকশিল্প নিয়ে সারা বিশ্বে একটি নেতিবাচক মনোভাবের সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলোর পরিবেশ নিয়ে অভিযোগ নতুন নয়। বহুদিন থেকেই এ ব্যাপারে ট্রেড ইউনিয়নগুলো সোচ্চার। কিন্তু যে তুলনায় পোশাকশিল্পের উন্নয়ন হয়েছে সে তুলনায় শ্রমিকের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। পরিস্থিতির যেটুকু উন্নয়ন হয়েছে তাও বিদেশি বায়ারদের নানা শর্ত পূরণ করতে গিয়ে। অর্থাৎ বিদেশি ক্রেতারা শ্রমিকের জীবনমান নিয়ে যদি কোনো প্রশ্ন না তুলতেন, তাহলে মালিকপক্ষ এ ব্যাপারে কার্যকর কোনো ভূমিকা নিত কি না সন্দেহ।
সত্যিকার অর্থে শ্রমিকের ইতিহাস হচ্ছে বঞ্চনার ইতিহাস। শ্রমিকের জীবনমান নিয়ে অনেক ভালো কথা উচ্চারিত হয় সভা-সেমিনারে। কিন্তু শ্রমিকদের ঘামে মালিকদের প্রাসাদোপম অট্টালিকা তৈরি হলেও অনেক শ্রমিককে অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটাতে হয়। দিনরাত শ্রম দিয়েও জীবনের ন্যূনতম চাহিদা তাঁরা পূরণ করতে পারেন না। অনেক সময় শ্রমিকরা তাঁদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য পথে নামতে বাধ্য হন।
দেশের রপ্তানিমুখী পোশাকশিল্পে নিয়োজিত শ্রমিকরাও বঞ্চনার শিকার। দৈনিক ১২-১৪ ঘণ্টা কাজ করে অনেক শ্রমিকই ন্যায্য মজুরি পান না। তার ওপর বেতন বকেয়া, কথায় কথায় শ্রমিক ছাঁটাই, লকআউট ইত্যাদি কারণেও শ্রমিকদের দুঃখ-দুর্দশার অন্ত থাকে না। আবার অনেক ফ্যাক্টরির কাজের পরিবেশ স্বাস্থ্যসম্মত নয়। বিভিন্ন সময় দেখা গেছে, পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা না থাকার দরুন অনেক শ্রমিককে দুর্ঘটনায় প্রাণ দিতে হয়েছে। দুর্ঘটনা মোকাবিলার জন্য কারখানাগুলোয় আলাদা সিঁড়ি থাকার কথা থাকলেও কোনো কোনো কারখানায় তা নেই। একটা কথা সবাইকে স্মরণ রাখতে হবে, শ্রমিক স্বার্থ সংরক্ষণ ব্যতীত শিল্পের বিকাশ সম্ভব নয়। এ জন্য শ্রমনীতির যথাযথ বাস্তবায়ন অত্যন্ত জরুরি। শ্রমিক ঠকানোর মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। একবিংশ শতাব্দীতে শিল্পের চরম উত্কর্ষের যুগে শ্রমিকদের জীবনমান উন্নত হবে—এটাই তো স্বাভাবিক।
পোশাকশিল্পের অমিত সম্ভাবনার কারণে এ খাতে সরকারের পক্ষ থেকে নানা রকম সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকেন মালিকরা। এমনকি শুল্ক সুবিধা দেওয়া ছাড়াও নানা সময় নানা প্রণোদনা দেওয়া হয়। এসবের অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে শেষ পর্যন্ত তা যেন শ্রমিকের জীবনমান উন্নয়নে ভূমিকা রাখে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে পোশাকশিল্পের মতো শ্রমঘন একটি শিল্পে মালিক-শ্রমিকের মধ্যে আস্থার সম্পর্ক অনেক প্রকট।
পোশাকশিল্পের মালিকরা অনেক সময় বলে থাকেন যে তাঁদের একতরফা দোষারোপ করা হয়। শ্রমিকের জীবনমান উন্নয়নে তাঁদের পক্ষ থেকে সম্ভব সব কিছুই করা হচ্ছে। এমনকি তাঁরা দেশের অর্থনীতিতে একটি বড় অবদান রেখে চলেছেন—সে কথা স্মরণ করিয়ে দিতেও তাঁরা ভোলেন না। আমরা গার্মেন্ট মালিকদের অবদানের কথা অস্বীকার করছি না। কিন্তু এটাও স্বীকার করতে হবে যে বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতায় পোশাক শ্রমিকদের জীবনমান এখনো কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় পৌঁছেনি। এর আগে বাংলাদেশের শ্রমিকদের জীবনমানের কথা শুনে পোপ সেটিকে ক্রীতদাস প্রথার সঙ্গে তুলনা করেছিলেন, যা আমাদের জন্য মোটেও সুখকর নয়। গার্মেন্ট মালিকরা বলছেন, যদি ক্রেতারা সামান্য বেশি মূল্যে পোশাক কেনেন, তাহলে শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে তা যথেষ্ট ভূমিকা রাখবে। এ ক্ষেত্রে তাঁরা বলছেন, ক্রেতারা শুধু অভিযোগ তুলেই তাঁদের দায়িত্ব সারছেন।
এ কথা ঠিক, জনসংখ্যাধিক্যের এ দেশে সস্তা শ্রমের কারণেই বিদেশি ক্রেতারা এ দেশের পোশাকশিল্পের দিকে ঝুঁকেছেন। যে কারণে চীনের পর বাংলাদেশই সবচেয়ে বেশি পোশাক রপ্তানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে। এ সাফল্য ধরে রাখতে হলে সব পক্ষেরই দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। যার যে দায়িত্ব সেটি পালন করতে হবে নিষ্ঠার সঙ্গে। শ্রমিকের জীবনমান উন্নয়নের ব্যাপারে সবাইকেই ভূমিকা রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে শ্রমিকদেরও দায়িত্ব রয়েছে। যখন-তখন কারখানায় ভাঙচুর-ধর্মঘট করার মতো হটকারী সিদ্ধান্ত থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। কোনো সমস্যা থাকলে তা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বশীল হতে হবে।
মনে রাখা জরুরি যে কোনো কোটা বা বিশেষ সুবিধা চিরকালীন কোনো ব্যবস্থা নয়। এ জন্য একটি সুষ্ঠু প্রতিযোগিতামূলক বাজারব্যবস্থায় যাতে টিকে থাকা যায় সেদিকে নজর দিতে হবে। কেউ অভিযোগ করার পর শ্রমিকের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করা হবে—এটা কেন? আমাদের পোশাকশিল্প রক্ষায় ও এর উত্তরোত্তর সমৃদ্ধিতে যা করণীয় তা নিজেদেরই করতে হবে। জন কেরিরা যাতে কোনো অভিযোগ করার সুযোগই না পান সেই সুবিধাও আমাদের নিতে হবে।
– See more at: http://www.kalerkantho.com/print-edition/sub-editorial/2016/09/05/401950#sthash.b7UNVF1I.dpuf
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.