স্বাধীনতা ও মহান মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে ৩০ লাখ শহীদের রক্ত মিশে আছে। তখনকার সাড়ে সাত কোটি বাঙালির সীমাহীন দুঃখকষ্ট, বুকফাটা আর্তনাদ, চোখের জল জড়িয়ে আছে। শব্দ দুটি জাতির আবেগের সঙ্গে যুক্ত, সে আবেগ শ্রদ্ধার, ভালোবাসার, দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধের। অন্যদিকে এই শব্দ দুটি উচ্চারিত হলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে পাকিস্তানি রাজনীতিবিদদের ঘৃণ্য মানসিকতা, তাদের সেনাবাহিনীর চরম বর্বরতা, তাদের সহযোগী রাজাকার-আলবদর বাহিনীর সীমাহীন নিষ্ঠুরতার নানা চিত্র, যাদের প্রতি রয়েছে পুরো জাতির প্রবল ঘৃণা। তাই স্বাধীনতা-উত্তরকালে যখন দেখা যায় এ দেশে ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ দেওয়া হয় কোনো স্বাধীনতাবিরোধীকে, ঘাতকদের দোসরকে কিংবা তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতাকে, তখন জাতির বিবেকবোধ যারপরনাই আঘাতপ্রাপ্ত হয়। ঘৃণায়, বিস্ময়ে তারা মর্মাহত হয়। ১৯৮০ সালে এমনিভাবে এই পুরস্কার দেওয়া হয় শর্ষীনার পীর মাওলানা আবু জাফর মোহাম্মদ সালেহকে, যাঁর মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ভূমিকা ও নিষ্ঠুরতার তথ্য বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাস গ্রন্থসহ অনেক গ্রন্থেই লিপিবদ্ধ রয়েছে। সে সময়ের স্থানীয় মানুষের স্মৃতিতে জমা হয়ে আছে। ১৯৭৭ সালে এই পুরস্কার প্রবর্তন করা হয়। প্রথমেই সে পুরস্কার দেওয়া হয় স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মূল ষড়যন্ত্রকারীদের একজন মাহবুব আলম চাষীকে। সে সময় জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় ছিলেন, যাঁকে সর্বোচ্চ আদালত থেকে অবৈধভাবে ক্ষমতা গ্রহণকারী বলা হয়েছে। তিনি স্বাধীনতাবিরোধীদের শুধু পদক দিয়েই ক্ষান্ত হননি, এ রকম অনেককে ক্ষমতায়ও বসিয়েছিলেন। জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী শাহ আজিজকে তিনি প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছিলেন। জয়পুরহাটের ঘাতক আবদুল আলীমকে মন্ত্রী বানিয়েছিলেন। তিনি গোলাম আযমকে পাকিস্তানের পাসপোর্টে বাংলাদেশে ফিরিয়ে এনেছিলেন এবং রাজনীতি করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। এমনি আরো অনেক কাজই তিনি করেছেন, যা স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হিসেবে গণ্য হতে পারে। একই ধারা বজায় রেখেছিলেন তাঁর পত্নী খালেদা জিয়াও। তাঁরা স্বাধীনতাবিরোধী ধারাকে বাংলাদেশে পুনর্বাসিত করেছেন। তাই একাত্তরের একজন মুক্তিযোদ্ধা হলেও জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতা-পরবর্তী ভূমিকা চরমভাবে বিতর্কিত হয়। সে কারণেই জিয়ার স্বাধীনতা পুরস্কার প্রত্যাহারের যে সিদ্ধান্ত সরকার নিয়েছে, তাতে বাঙালি জাতির আবেগকেই শ্রদ্ধা জানানো হয়েছে।
প্রতিটি জাতিরই নিজস্ব অহংকারের কিছু জায়গা থাকে, কিছু গর্বিত অনুভব থাকে। সেখানে আঘাত করা পুরো জাতিকে আঘাত করা এবং জাতির আবেগকে অপমান করার শামিল। স্বাধীনতাবিরোধীদের পুরস্কার প্রদান করা তেমনি একটি আঘাত। স্পষ্টতই বোঝা যায়, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধ্বংস করার লক্ষ্য থেকেই এসব কাজ করা হয়েছে। আমরা চাই, স্বাধীনতাবিরোধী যেসব ব্যক্তিকে এ পর্যন্ত ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ দেওয়া হয়েছে, সবার পুরস্কার দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রত্যাহার করা হোক। পাশাপাশি যারা স্বাধীনতাবিরোধীদের এই পুরস্কার দিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হোক। কারণ তা না হলে ভবিষ্যতেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে। আমরা কোনোভাবেই ৩০ লাখ শহীদের রক্ত কিংবা অগণিত মা-বোনের চোখের জলের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারি না।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.