সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশীদের অর্থ পাচার বাড়ছে। বর্তমানে জমা আছে প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা। এ তথ্য সুইস ব্যাংকই প্রকাশ করেছে। কিন্তু কারা এই পাচারের সঙ্গে জড়িত- এ বিষয়ে কোনো তথ্য দিচ্ছে না ব্যাংকটি।
বাংলাদেশ ব্যাংক বারবার চিঠি দিয়েও সাড়া মেলেনি। দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক) এই অর্থ পাচারের তথ্য না পেয়ে উদ্বিগ্ন।
উভয় দেশের দ্বিপক্ষীয় চুক্তির অভাবেই বাংলাদেশকে তথ্য দিচ্ছে না সুইস কর্তৃপক্ষ- এমন মত প্রকাশ করে দুদক থেকে সরকারের বিভিন্ন দফতরে চিঠি দেয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, অর্থ পাচারের তথ্য এবং অর্থ পাচার বন্ধে বাংলাদেশ ও সুইজারল্যান্ডের মধ্যে চুক্তির প্রয়োজন। এই চুক্তি করার ব্যাপারে দুদক সব ধরনের সহায়তা করবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে এ তথ্য।
দুদকের চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘গড়ে প্রতিবছর অর্থ পাচার হয়েছে প্রায় ৫৮৯ কোটি মার্কিন ডলার। এর একটি অংশ সুইজারল্যান্ডে জমা হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। এরূপ অর্থ পাচার দুর্নীতিকে উৎসাহিত করার পাশাপাশি জাতীয় অর্থনীতির জন্য মারাÍক হুমকি হয়ে দেখা দিচ্ছে। ফলে এর প্রতিরোধ জরুরি হয়ে পড়েছে।’
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব মো. ইউনুসুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, দুদক দফতরে এখনও এ ধরনের চিঠি এসে পৌঁছেনি। তবে এ ধরনের চিঠি পেলে অবশ্যই গুরুত্বসহকারে বিষয়টি দেখা হবে। তিনি আরও বলেন, অর্থ পাচার প্রতিরোধ ও তথ্য পেতে বাংলাদেশ ব্যাংক কয়েকটি দেশের সঙ্গে এ ধরনের চুক্তি করেছে।
জানা গেছে, বাংলাদেশের টাকা রাখার তথ্য চেয়ে সুইস ব্যাংকের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে এ ধরনের কোনো চুক্তি না থাকায় সংস্থাটি কাক্সিক্ষত কোনো তথ্য দিচ্ছে না বাংলাদেশকে। এ ছাড়া সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকিং আইন, ১৯৩৪ অনুসারে কোনো ব্যক্তির অ্যাকাউন্টের হিসাব অন্যকে প্রদান করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। সুইজারল্যান্ডে ফিন্যান্সিয়াল মার্কেট সুপারভাইজরি অথরিটি এসব নিয়ন্ত্রণ করে। মূলত মধ্যযুগ থেকে সুইজারল্যান্ডে এমন মূল্যবোধ প্রচলিত, যার বরখেলাপ ভয়াবহ অপরাধ। ফলে কোনো ধরনের চুক্তি ছাড়া কোনো তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না।
সম্প্রতি দুদকের মহাপরিচালক ফরিদ হোসেন ভূঁইয়া স্বাক্ষরিত চিঠিতে আরও বলা হয়, বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) এবং সুইজারল্যান্ডের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট উভয় আন্তর্জাতিক সংস্থা এগমন গ্রুপের সদস্য। পাশাপাশি বাংলাদেশ ও সুইজারল্যান্ড উভয় দেশ জাতিসংঘের দুর্নীতিবিরোধী কনভেনশন (ইএনসিএসি) স্বাক্ষরকারী দেশ। ফলে এই দু’দেশের মধ্যে একটি সমঝোতা বা মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স চুক্তি স্বাক্ষর হলে তা দুর্নীতি ও মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে সহায়ক হবে বলে মনে করে কমিশন।
ওই চিঠিতে বলা হয়, বিভিন্ন পত্রিকার সংবাদের সূত্রে দুর্নীতি দমন কমিশন জানতে পারে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশীদের প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা জমা আছে। প্রতি বছর এই অর্থের পরিমাণ বেড়ে চলছে। সেখানে বলা হয়, ২০০৪-১৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে মোট অবৈধ অর্থ পাচার হয়েছে প্রায় ৫ হাজার ৫৮৮ কোটি মার্কিন ডলার।
সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের প্রকাশিত সর্বশেষ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালে বাংলাদেশীদের অর্থ জমার পরিমাণ হচ্ছে ৪ হাজার ৫৫৪ কোটি টাকা। আগের বছর অর্থাৎ ২০১৩ সালে এই অর্থের পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ২৩৬ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশীদের টাকা জমা রাখার পরিমাণ বেড়েছে ১ হাজার ৩১৮ কোটি টাকা বা ৪০ দশমিক ৭২ শতাংশ। আগে ২০১২ সাল শেষে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশীদের অন্তত এক হাজার ৯০৮ কোটি টাকার সমপরিমাণ অর্থ ছিল। এই টাকার পুরোটা পাচার হয়েছে দেশ থেকে। সেখানে আরও দেখা গেছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারত এবং পাকিস্তানের পরই রয়েছে বাংলাদেশের অবস্থান।
সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত এক দশকের মধ্যে ২০১৩ সালেই সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশীদের সবচেয়ে বেশি অর্থ গচ্ছিত ছিল। এর আগে সর্বোচ্চ পরিমাণ অর্থ গচ্ছিত ছিল ২০০৭ সালে। সে বছর সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ ছিল ২৪ কোটি ৩০ লাখ সুইস ফ্রাঁ বা দুই হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি।
২০০৮ সালে বাংলাদেশীদের গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ নেমে আসে ১০ কোটি ৭০ লাখ সুইস ফ্রাঁ বা ৮৯২ কোটি টাকায়।
২০০৯ সালে এর পরিমাণ ছিল ১৪ কোটি ৯০ লাখ সুইস ফ্রাঁ বা এক হাজার ২৪১ কোটি টাকা।
২০১০ সালে তা আরও বেড়ে হয় ২৩ কোটি ৬০ লাখ সুইস ফ্রাঁ বা এক হাজার ৯৬৮ কোটি টাকা। তবে ২০১১ সালে তা বেশ কমে হয় ১৫ কোটি ২৩ লাখ সুইস ফ্রাঁ বা এক হাজার ২৯৫ কোটি টাকা।
ওয়াশিংটনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) রিপোর্ট অনুসারে ২০০১ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত এক যুগে বাংলাদেশ থেকে ২ হাজার ১৩ কোটি ডলার পাচার হয়েছে। স্থানীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ ১ লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকা।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বুধবার যুগান্তরকে বলেন, সুইস ব্যাংক তাদের রিপোর্টে বাংলাদেশের টাকা জমা আছে বলে জানায়। কিন্তু নির্দিষ্ট করে কার কত টাকা তা উল্লেখ করে না। টাকা রাখার তথ্য পেতে সরকার সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে চুক্তি করার চেষ্টা চালাতে পারে। তবে সরকার চাইলেই সুইজারল্যান্ড সরকার চুক্তি করতে বাধ্য নয়। এ ধরনের চুক্তি একমাত্র আমেরিকার সঙ্গে সুইস ব্যাংকের রয়েছে। কারণ আমেরিকার সঙ্গে তাদের ব্যবসা আছে। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ এবং সুইজারল্যান্ড উভয় দেশই এগমন গ্রুপের সদস্য। কিন্তু এর অর্থ এই নয়, সদস্য হলে ব্যাংকের গ্রাহকের সব তথ্য বাংলাদেশকে প্রদান করবে।
ড. সালেহ উদ্দিন আরও বলেন, যদি নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তির টাকার তথ্যসংক্রান্ত বাংলাদেশের আদালতের কোনো আদেশ থাকে সে ক্ষেত্রে অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসের মাধ্যসে সুইস ব্যাংকে তথ্য চেয়ে পাঠাতে হবে। সুইস ব্যাংক তখন বিবেচনা করতে পারে। এ ছাড়া গ্রাহকের তথ্য তারা কোনোভাবেই দেবে না।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.