দেশ থেকে পাটখড়ির ছাই রপ্তানি হচ্ছে। ব্যতিক্রম এ পণ্যের রপ্তানি দিন দিন বাড়ছে। আর সে কারণে বাড়ছে ছাই উৎপাদনের কারখানাও। পাটখড়ি বা পাটকাঠির ছাই চারকোল নামেও পরিচিত। বাংলাদেশ থেকে পাটখড়ির ছাইয়ের প্রধান আমদানিকারক দেশ হচ্ছে চীন। তাইওয়ান, ব্রাজিলেও এটি রপ্তানি হচ্ছে। এর বড় বাজার রয়েছে মেক্সিকো, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জাপান, ব্রাজিল, তুরস্ক, দক্ষিণ কোরিয়া, জার্মানিসহ ইউরোপের দেশগুলোতে। পাট দিয়ে চট, বস্তা, কাপড়, কার্পেট তৈরি হলেও পাটখড়ি এত দিন গ্রামে মাটির চুলায় রান্না করার কাজে এবং ঘরের বেড়া দেওয়ার কাজেই ব্যবহৃত হতো। দেশের পার্টিকেল বোর্ড কারখানাগুলোতেও উপকরণ হিসেবে পাটখড়ি ব্যবহৃত হয়। কিন্তু পাটখড়িকে ছাই বানিয়ে তা রপ্তানির পথ দেখান ওয়াং ফেই নামের চীনের এক নাগরিক। তা-ও মাত্র চার বছর আগে। আর এই চার বছরের ব্যবধানে দেশে ছাই উৎপাদনের কারখানা গড়ে উঠেছে ২৫টি। রপ্তানিকারকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পাটখড়ির ছাই থেকে কার্বন পেপার, কম্পিউটার ও ফটোকপিয়ারের কালি, আতশবাজি ও ফেসওয়াশের উপকরণ, মোবাইলের ব্যাটারি, প্রসাধনপণ্য, দাঁত পরিষ্কারের ওষুধ ইত্যাদি পণ্য তৈরি হয় বিদেশে। ‘গ্রিন ইন্ডাস্ট্রি’ আখ্যা দিয়ে পাটখড়ির ছাই উৎপাদন ও রপ্তানি বৃদ্ধিতে সরকার ইতিবাচক। গত মঙ্গলবার পাটখড়ির ছাই রপ্তানিতে ২০ শতাংশ নগদ সহায়তা দেওয়ার প্রজ্ঞাপন জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিছু উদ্যোগ রয়েছে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়েরও। ইতিমধ্যে দেশের সব জেলা প্রশাসকের (ডিসি) কাছ থেকে ছাই উৎপাদন ও রপ্তানি-বিষয়ক তথ্য সংগ্রহ করেছে এ মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে গত জুলাইয়ে একটি আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বর্তমানে একটি নীতিমালা তৈরির কাজ চলছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, পাটখড়ির ছাই রপ্তানিতে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৫৪ কোটি টাকা রপ্তানি আয় হয়েছে। তবে বাংলাদেশ চারকোল উৎপাদক ও রপ্তানিকারক সমিতি (প্রস্তাবিত) সূত্রে জানা গেছে, বাস্তবে এ খাত থেকে বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হচ্ছে ১৫০ কোটি টাকা। আর সহজেই আয় হওয়া সম্ভব বছরে ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। নাম না প্রকাশের শর্তে একটি কারখানার ব্যবস্থাপক বলেন, তাঁদের দৈনিক চাহিদা ৫০০ মণ পাটখড়ি। মৌসুমে প্রতি মণ পাটখড়ি কিনতে হয় ১৮০-২০০ টাকা দরে। আর যখন মৌসুম থাকে না, তখন দাম পড়ে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। নারায়ণগঞ্জের চারকোল কারখানা মাহফুজা অ্যান্ড আহান এন্টারপ্রাইজের চেয়ারম্যান সৈয়দ মনিরুল ইসলাম গত বৃহস্পতিবার মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘সহজ যোগাযোগের কারণে এবং জাহাজ ভাড়া কম পড়ে বলে চীন হলো আপাতত বাংলাদেশি পাটখড়ির ছাইয়ের প্রধান গন্তব্যস্থল। তবে আরও নতুন দেশ আমরা খুঁজছি।’ কারখানাগুলোকে পরিবেশবান্ধব দাবি করে মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘প্রযুক্তির মাধ্যমে পাটখড়ি পোড়ানোর পর আমরা কার্বনগুলোকেই মূলত ধরে রাখি।’
জানা গেছে, বিশেষ চুল্লির মাধ্যমে পাটখড়ি পুড়িয়ে ছাই করা হয়। কারখানাগুলো গড়ে উঠেছে ফরিদপুর, জামালপুর, ঝিনাইদহ, খুলনা, নারায়ণগঞ্জ, রাজশাহী, পাবনা, লালমনিরহাট ও রাজবাড়ীতে। পাট অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, দেশে বছরে ৩০ লাখ টন পাটখড়ি উৎপাদিত হয়। এর মাত্র ৫০ শতাংশকেও যদি ছাই করা যায়, তাহলে বছরে উৎপাদন দাঁড়াবে প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার টন। এক টন ছাইয়ের দাম ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ ডলার। প্রস্তাবিত পাটখড়ির ছাই রপ্তানিকারক সমিতিটি বাণিজ্য এবং বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের কাছে ছাই রপ্তানির সম্ভাব্য নানা দিক তুলে ধরেছে। এতে বলা হয়, এ খাত থেকে বছরে রপ্তানি আয়ের সম্ভাবনা রয়েছে ৩১ কোটি ২৫ লাখ ডলার। আর সরকার এ খাত থেকে বছরে রাজস্ব পাবে ৪০ কোটি টাকা। এ ছাড়া প্রত্যক্ষভাবে ২০ হাজার ও পরোক্ষভাবে ২০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে এ খাত থেকে। সমিতি বলছে, ছাই উৎপাদনের কারখানাগুলো পরিবেশবান্ধব, বহির্বিশ্বে ছাইয়ের ভালো চাহিদা রয়েছে এবং সহজেই আন্তর্জাতিক বাজার ধরা যাবে। এ কারখানায় বিদ্যুৎ বেশি লাগে না, কারখানা স্থাপনে বিনিয়োগের পরিমাণও খুব বেশি নয়। তা ছাড়া কাঁচামাল পাওয়া যায় সহজেই। জানতে চাইলে প্রস্তাবিত সমিতির আহ্বায়ক কাজী শিপন প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশকে শুল্কমুক্ত পণ্য রপ্তানির সুযোগ দেয় চীন। কিন্তু পাটখড়ির ছাই রপ্তানিতে এ সুবিধা পাওয়া যায় না। ২৭ শতাংশ শুল্ক দিতে হয়। কিছুদিনের মধ্যে চীনের সঙ্গে এ ব্যাপারে একটি বৈঠক রয়েছে এবং এ বৈঠক থেকে চীনে শুল্কমুক্ত ছাই রপ্তানির ব্যাপারে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত আসবে বলে তিনি আশাবাদী। পাটখড়ির ছাই উৎপাদনে এখন পর্যন্ত দেশে কোনো নীতিমালা নেই এবং লাইসেন্স দেওয়ার কোনো দপ্তরও নেই। কাজী শিপন বলেন, ‘আমাদের নিয়ন্ত্রণের জন্য একটা কর্তৃপক্ষ থাকা এখন জরুরি।’ ইপিবি যে রপ্তানি আয়ের কথা বলছে, তার সঙ্গে আপনাদের তথ্য মিলছে না কেন—জানতে চাইলে কাজী শিপন কেউ কেউ মূল্য কম দেখিয়ে রপ্তানি করে থাকতে পারেন বলে জানান। দেশে প্রথম পাটখড়ির ছাই উৎপাদনের কারখানা করেন চীনা নাগরিক ওয়াং ফেই। যৌথ উদ্যোগে তিনি যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের নিবন্ধকের কার্যালয় (আরজেএসসি) থেকে ২০১১ সালের ২৭ নভেম্বর মিমকো কার্বন কোম্পানি লিমিটেড নামে নিবন্ধন নেন। পরের বছর ২০১২ সালে প্রথমে জামালপুরে এবং পরে খুলনা ও ফরিদপুরে চালু হয় কারখানা। ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী এই কারখানার বার্ষিক আয় ৮০ লাখ ডলার। দেশীয় উদ্যোক্তা ইউনুস মোল্লা পরে পুরো কোম্পানি কিনে নেন বলে জানা গেছে।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.