আমার আম্মার খুব শখ ছিল বেড়ানোর। সেই বেড়ানো মানে মোটেও হিল্লি-দিল্লি যাওয়া নয়। রিকশা দিয়ে বাসার কাছে রমনা পার্কে নিয়ে গেলেও তাঁর চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠত। আমাদের ছিল সাদামাটা মধ্যবিত্ত পরিবার। আব্বা সরকারি কর্মকর্তা আর আম্মা স্কুল শিক্ষিকা। অত বেড়ানো টেড়ানো আমাদের হতো না। ঢাকার এক মাথা থেকে আরেক মাথায় আম্মাকে রোজ যেতে হতো শিক্ষকতার জন্য। প্রতিদিনের সেই দীর্ঘ কষ্টকর ভ্রমণ আর তারপর সংসারের নিত্যদিনের সব দায়িত্ব পালনের পর আম্মা খুব ক্লান্ত হয়ে যেতেন দিন শেষে। তারপরও যে কোনো বেড়ানোর কথায় কখনো না করতেন না।
তখন এত ভালো বুঝতাম না, এখন চিন্তা করলে মনে হয়, আম্মা আসলে আর দশজন নারীর মতো স্বাভাবিক ছিলেন না। কখনোই কোনো শাড়ি–গয়নার আবদার ছিল না তাঁর। টিভি দেখার নেশা ছিল না। পাড়া বেড়ানোর অভ্যাস ছিল না। এমনকি পরনিন্দা, পরচর্চাও আম্মার অভিধানে ছিল না কোনোসময়। আম্মা তাঁর জীবদ্দশায় কখনোই খুব বৈষয়িক অথবা সংসারী হয়ে উঠতে পারেননি। অবসরে বই পড়া আর বেড়াতে যাওয়া ছাড়া অন্য কোনো কিছুতেই আম্মার কোনো আগ্রহ ছিল না। সব সময় নতুন কেনা বইগুলো, ঈদসংখ্যাগুলো আম্মার সঙ্গে কাড়াকাড়ি করে পড়তে হতো। পড়ার সময় বিরক্ত করলে খুব রেগে যেতেন। আর আমার কাজই ছিল ওই সময় সম্ভাব্য সব উপায়ে আম্মাকে বিরক্ত করা। আম্মা খুব চাইতেন আমরা তাঁর বেড়ানোর সঙ্গী হই। সেই ব্যাপারেও আমাদের বিশেষ আগ্রহ ছিল না। বরং সঙ্গে না যাওয়ার বাহানা খুঁজতাম সব সময়। ভীষণ রাগ হতো মাঝে মাঝে। যত হাবিজাবি জায়গাতেই আম্মাকে নিয়ে যাওয়া হোক না কেন, তাঁর সবকিছু ঘুরে দেখতে হবে। আমরা পাল্লা দিয়ে পেরে উঠতাম না। আম্মা হাঁটতে পারতেন খুব। কখনো সখনো যখন গ্রামে যেতাম আমরা, আম্মাকে আর পায় কে! হাঁটতেই থাকতেন, হাঁটতেই থাকতেন কোনো থামাথামি ছাড়া। সেই সফরগুলোতে প্রথম প্রথম খুব উৎসাহের সঙ্গে আম্মার সঙ্গী হলেও পরে মনে হতো হাত–পা ছড়িয়ে কাঁদি কোথাও বসে। কাঁদা পানি, ধান খেত, খেতের আইল, এর উঠান, ওর গোয়ালঘর সব ছাড়িয়ে আম্মা বিরতিহীন হাঁটতেন, আর মাঝে মাঝে একটু দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে, উজ্জ্বল হয়ে ওঠা গলায় বলতেন, ‘আল্লাহর সৃষ্টি কী সুন্দর!’ এটা ছিল আম্মার মুগ্ধতা প্রকাশের সর্বোচ্চ অভিব্যক্তি। ছোট ছিলাম যখন, আম্মার ওই মুগ্ধ দৃষ্টি অনুসরণ করে খুব হতাশ হতাম। হয়তো একটা খেতের আইলে বেশ গম্ভীর এক ছাগ মাতা তার দুই তিনটা তিড়িং বিড়িং করা বাচ্চা নিয়ে বৈকালিক ভ্রমণে বেড়িয়েছে। হয়তো একটা শালিক খেজুর গাছে ঝোলানো হাঁড়িতে মুখ দিয়ে রস খাচ্ছে। কিংবা আম্মার হাঁটা পথ শেষ হয়ে গেছে কোনো হলুদিয়া সরিষা খেতের সামনে। এই সব তুচ্ছ তুচ্ছ দৃশ্যে আম্মার মুগ্ধতার কারণ বুঝতে পারতাম না। আর ওই সব সৌন্দর্য অনুধাবনের জন্য আমার বয়সটাও তেমন অনুকূলে ছিল না। বেশির ভাগ সময়ই খুব বিরক্ত হয়ে যেতাম। অনেককাল আগে আমি যখন ক্লাস সেভেনে পড়তাম, তখন ডিজিটাল ক্যামেরা ছিল না, ইন্টারনেট ছিল না, মোবাইল ফোন ছিল না, ফেসবুকের তো প্রশ্নই ওঠে না। ওই সময় আমার বড়বোনের এক বান্ধবী অনেকগুলো ছবি নিয়ে আমাদের বাসায় আসলেন আমাদের দেখাতে। ওনার আব্বা–আম্মা আমেরিকা ঘুরতে গিয়েছিলেন বড় ছেলের কাছে—তারই একগাদা ছবি। আমরা সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। খুব সুন্দর সুন্দর জায়গায় তোলা স্বপ্নের মতো সব ছবি। আম্মা খুব আগ্রহ নিয়ে আমাদের সঙ্গে বসে ছবি দেখছিলেন। কয়েকটা ছবিতে আম্মা আটকে গেলেন। নায়াগ্রা ফলসের সামনে তোলা ছবি। কী যে অদ্ভুত! আম্মা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বারবার দেখতে লাগলেন সেই ছবিগুলো। আমি পাশেই বসে ছিলাম। একসময় আমি শুনতে পেলাম, আম্মা খুব মৃদুস্বরে বলছেন, আমিও নায়াগ্রা দেখতে যাব, আমার মেয়েরা যখন পড়ালেখা করতে যাবে তখন। যেন নিজেকেই নিজে শোনাচ্ছেন। এমন কোনো বড় ঘটনা না, মনে রাখার মতোও বিশেষ কিছু না। কিন্তু আমার প্রায়ই মনে পড়ত। আম্মা কখনো মুখ ফুটে তার কোনো ইচ্ছার কথা বলেছেন, এ রকম কিছু আমি মনে করতে পারি না। এ জন্যই বোধকরি এই কথাটা আমার মাথায় গেঁথে গিয়েছিল। এমন না যে, আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, আম্মাকে নায়াগ্রা দেখাবই দেখাব যেভাবেই হোক। শুধু মনে হতো কোনো দিন যদি যেতে পারি নায়াগ্রায়, আম্মাকে নিয়ে যাব নিশ্চয়ই। সরিষা খেত, হাঁসের বাচ্চা, উঠানে শুকাতে দেওয়া অঢেল লাল মরিচ দেখে ‘আল্লাহর সৃষ্টি কত সুন্দর’ বলা আমার আম্মা কী ভীষণ অবাক হবেন নায়াগ্রা দেখলে, এটা ভাবতেই আমার ভালো লাগত। আগস্টের এক শেষ বিকেলে আমি প্রথমবারের মতো নায়াগ্রার সামনে দাঁড়ালাম, আম্মা মারা যাওয়ার ঠিক এক বছর আঠারো দিন পর। বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে যাওয়ার মতো সুন্দর নায়াগ্রা। জানি না এর সঙ্গে তুলনা করবার মতো কি আছে পৃথিবীতে। আমি আমার আবেগ সামলাবার জন্য রেলিং আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে রইলাম। মনে মনে মন্ত্রপাঠের মতো বলতে লাগলাম, আম্মা একবার আস, একটু দেখে যাও, একবার এসে দাঁড়াও আমার পাশে! আমার এই অযৌক্তিক প্রার্থনায় স্বভাবতই কোনো কাজ হলো না। অসংখ্য মানুষের মাঝে আমি একা একা দাঁড়িয়ে থাকলাম। চারদিকে তাকিয়ে দেখি মহররমের মেলার মতো ভিড়। আমাদের উপমহাদেশীয় অনেক পরিবার দেখা যাচ্ছে। তাদের বেশির ভাগের সঙ্গেই বয়স্ক মা-বাবারা আছেন। শাড়ি পরা, সালোয়ার কামিজ পরা অনেক বয়স্ক নারী কী পরিতৃপ্ত, আনন্দিত মুখে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আমার চোখ জ্বালা করে ওঠে, বুকের ভেতর বাষ্প জমতে থাকে। কত কাছে এলাম স্বপ্নের, কিন্তু কোনো দিন এই স্বপ্ন পূরণ হবে না। একটা অক্ষম রাগে, অভিমানে আমার গলা বুজে আসে। মনে হয় সমস্ত ইচ্ছাশক্তি দিয়ে আম্মাকে নিয়ে আসি আমার পাশে, এক মুহূর্তের জন্য হলেও দুই চোখ ভরে দেখুক। আমার ঘাস-ফুল-লতা-পাতা দেখে মুগ্ধ হওয়া আম্মা নায়াগ্রা দেখে কী করে খুব দেখতে ইচ্ছা করে আমার। কান ভরে শুনতে ইচ্ছা করে আম্মার মৃদু দীর্ঘশ্বাস আর তারপর কিশোরীদের মতো ঝলমলে গলায় বলে ওঠা ‘আল্লাহর সৃষ্টি কী সুন্দর!’
(শিরোনামটি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর একটি কবিতার লাইন)
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.