অর্কিড চাষে প্রতি বিঘায় বছরে সাড়ে চার লাখ টাকা মুনাফা। ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার একটি অর্কিড বাগান ।
ময়মনসিংহ শহর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে ফুলবাড়িয়া উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম দুলমা। নগরের কোনো কোলাহল এখানে নেই। গাছগাছালির সবুজে বিস্তীর্ণ এ দুলমা গ্রাম। কিন্তু সবুজের মধ্যেই চোখে পড়বে লাল, হলুদ, বেগুনি অর্কিডের সমাহার। এ পাড়াগাঁয়ে নিতান্তই শখের বশে অর্কিডের বাগান করা হয়নি। রীতিমতো বিশাল এলাকাজুড়ে বাণিজ্যিকভাবে অর্কিডের উৎপাদন হচ্ছে। অর্কিড ফুল ও চারা সারা দেশে যায়। এমনকি এই বাগানে অর্কিডের টিস্যু কালচারের মাধ্যমে চারা উৎপাদনের জন্য একটি গবেষণাগারও আছে। সেখানে প্রতিবছর এক লাখ চারা উৎপাদন করা হয়। ফুল ও চারা বিক্রি করে প্রতি বিঘায় মুনাফা হয় গড়ে সাড়ে চার লাখ টাকার বেশি।
দীপ্ত অর্কিড লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠান দুলমা গ্রামে ১২ একর জমিতে বাণিজ্যিকভাবে অর্কিডের উৎপাদন করছে। প্রতিবছর ৪০-৫০ লাখ টাকার অর্কিডের চারা ও ফুল বিক্রি করে প্রতিষ্ঠানটি। এ বাগানের অর্কিডের ক্রেতা মূলত রাজধানীর শাহবাগের ফুল ব্যবসায়ীরা। এ ছাড়া চট্টগ্রাম, সিলেট, কক্সবাজারেও নিয়মিত ফুল ও চারার চালান যায়।
প্রতি সপ্তাহে দুবার রাজধানীতে অর্কিডের চালান আসে। প্রতি চালানে গড়ে ৫ হাজার অর্কিড ফুল এবং ৫০টির মতো চারাগাছ কেনেন পাইকারেরা। প্রতিটি ফুলের দাম বাগান পর্যায়ে ২০ টাকা এবং গাছের দাম জাতভেদে ৩০০-৫০০ টাকা। রাজধানী ঢাকাতেই আসে প্রতি সপ্তাহে গড়ে ৪০-৫০ হাজার টাকার অর্কিড চারাগাছ ও ফুল। জানা গেছে, অর্কিড চারা ও ফুল বাজারজাতের জন্য এ প্রতিষ্ঠানের পাঁচজনের একটি দল আছে।
দীপ্ত অর্কিড লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী ইত্তেমাদ উদ দৌলা বলেন, দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ছে। তাই অর্কিড ফুল কেনায় আগ্রহ বেড়েছে। তিনি আরও বলেন, সবজি-ফলমূলের বেশি চাহিদার কারণে বিদেশি অর্কিড রপ্তানির সুযোগ থাকলেও কার্গো উড়োজাহাজে পর্যাপ্ত স্থান পাওয়া কঠিন।
জানা গেছে, দেশের এখন দুটি বাগানে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে অর্কিডের উৎপাদন হয়। দীপ্ত অর্কিড ছাড়াও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ডানকান চা-বাগানে সীমিত পরিসরে অর্কিড উৎপাদন করা হয়। এ ছাড়া ব্যক্তিপর্যায়ে কিছু অর্কিড বাগান আছে।
সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা গেছে, সব মিলিয়ে প্রায় ৩৭ একর জমি নিয়ে বিশাল বাগান করেছে দীপ্ত অর্কিড লিমিটেড। অর্কিডের পাশাপাশি গোলাপ, জারবেরা ও সবজির বাগান আছে। পুরো বাগানটিই দৃষ্টিনন্দন। সারি সারি অর্কিড রোপণ করা আছে। কোথাও লাল, কোথাও সাদা, কোথাও হলুদ; আবার কোথাও বেগুনি ফুলের গাছ। এর ফলে বাগানের অর্কিডের অংশটি দেখতে অনেকটা টিউলিপ বাগানের মতো মনে হয়। এমন দৃষ্টিনন্দন পরিবেশ দেখতে অনেকেই পরিবার নিয়ে ঘুরতে আসেন।
জানা গেছে, দীপ্ত অর্কিড বাগানে ২৫ ধরনের প্রজাতির অর্কিডের চাষ হয়। এর মধ্যে জনপ্রিয় হলো ডেনড্রোবিয়াম হোয়াইট, ডেনড্রোবিয়াম সোনিয়া, ডেনড্রোবিয়াম সাকুলা পিংক ও ডেনড্রোবিয়াম সাতু পিংক। এ ছাড়া মোকারা নুরা ব্লু প্রজাতির অর্কিডের বেশ চাহিদা রয়েছে। মোটা দাগে, প্রজাতির ভিন্নতায় অর্কিড ফুলের রঙের হেরফের হয়।
এক বিঘা জমিতে অকির্ড চাষ করলে বছরে সাড়ে চার লাখ টাকার বেশি মুনাফা হয় বলে জানা গেছে। এক বিঘায় সাড়ে ১৮ হাজার চারাগাছ লাগানো যায়। তবে পাঁচ বছরের পরিকল্পনা করে এগোতে হবে। দীপ্ত অর্কিড লিমিটেডের হিসাবমতে, শেড ও মাচা তৈরি, বীজ বপন, মজুরিসহ প্রতি বিঘায় খরচ হয় ১৫ লাখ টাকা। এ ছাড়া প্রতিবছর পরিচালনা ব্যয় আরও পাঁচ লাখ টাকা ধরে পাঁচ বছরে মোট খরচ ২৫ লাখ টাকা। ১০ শতাংশ হারে ব্যাংক সুদ ধরে এসব খরচের সঙ্গে যুক্ত হবে আরও চার লাখ টাকা। সব মিলিয়ে এক বিঘায় খরচ হবে ৪৪ লাখ টাকা।
এবার উৎপাদনের হিসাব। প্রথম বছরে একটি চারায় দুটি করে ফুল ফোটে। দ্বিতীয় থেকে পঞ্চম বছরে ফুটবে চারটি করে ফুল। সব মিলিয়ে পাঁচ বছরে ৩ লাখ ৩৩ হাজার ফুল ফোটানো সম্ভব হবে। প্রতিটি ফুলের মূল্য ২০ টাকা ধরলে পাঁচ বছরে মোট আয় হবে ৬৬ লাখ ৬০ হাজার টাকা। পাঁচ বছরে নিট মুনাফা ২২ লাখ ৬০ হাজার টাকা। বছরে মুনাফা ৪ লাখ ৫২ হাজার টাকা।
দীপ্ত অর্কিড লিমিটেডের গবেষণাগারের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শেখ শরীফ উদ্দিন আহমেদ বলেন, দিন দিন অর্কিডের চাহিদা বাড়ছে। বৈজ্ঞানিক উপায়ে চাষ করতে পারলে এ ব্যবসা বেশ লাভজনক।
সারা বছর চাহিদা থাকলেও ভ্যালেন্টাইন ডে বা বিশ্ব ভালোবাসা দিবসের সময় চাহিদা বেশি থাকে। ভালোবাসা দিবসের এক সপ্তাহ আগে থেকেই প্রতিদিন এ বাগান থেকে চার-পাঁচ ট্রাক করে অর্কিড ফুল সারা দেশে যায়। রাজধানীর শাহবাগের ফুলের পাইকারদের ছাড়া দেশের বিভিন্ন পাঁচতারকা হোটেলে এ বাগানের ফুল নিয়মিত যায়।
২০০৩ সালে অনেকটা শখের বশে ইত্তেমাদ উদ দৌলা এ বাগান করেন। প্রথমে দু-তিন একর জমিতে অর্কিড চাষ শুরু করেন। বাণিজ্যিকভাবে দীপ্ত অর্কিডই দেশে প্রথম বাণিজ্যিকভাবে অর্কিডের উৎপাদন শুরু করে। প্রথম দিকে থাইল্যান্ড থেকে একজন বিশেষজ্ঞ এসে বাগান করতে সহায়তা করেন। পুরো তিন বছর এ বাগানে থেকে তিনি চারা থেকে ফুল ফোটানো পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়াটি স্থানীয় কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেন।
তা ছাড়া এই অর্কিড বাগানের আধুনিক সব প্রযুক্তি থাইল্যান্ড থেকে আনা হয়েছে। প্রথম দিকে বছরে দু-তিন লাখ টাকার অর্কিড বিক্রি হতো। এখন তা ২০ থেকে ২৫ গুণ বেড়েছে। এই সাফল্য দেখে ২০১৪ সালের আগস্টে তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনা পরিদর্শন করেন বাগানটি। ২৫ জাতের মধ্যে অনেক গাছের প্রতিটি থেকে তিন থেকে চার বছর পর্যন্ত ফলন পাওয়া যায়। বর্ষা ও বসন্তকালে বাম্পার ফলন হয় অর্কিডের। তবে শীতে এর ফলন ভালো হয় না। এ বাগানের অর্কিড সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরবে রপ্তানি হয়েছিল। কিন্তু দুই বছর ধরে রপ্তানি হচ্ছে না।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.