পাহাড়ে নেমে এসেছে রাত। চারদিকে গাঢ় অন্ধকার। কিন্তু এই রাতেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সামনে পাহাড়ের সারি। আকাশভরা তারা। প্রকৃতি আলো করে উঠেছে পূর্ণিমার চাঁদ। মায়াবী এই আলো চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে কেমন যেন রহস্যময় করে তুলেছে। আমরা অনেকজন, মন্ত্রমুগ্ধের মতো দাঁড়িয়ে শুনছি ব্যাঙের ডাক—ঝিঁঝি পোকার একটানা শব্দ। জোনাকি পোকার দল আলো জ্বেলে আমাদের চারপাশে উড়ছে। মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছে প্যাঁচা বা বাদুড়ের ডাক। আরও, আরও অনেক দূরে দেখা যাচ্ছে জাহাজবন্দরের বিদ্যুতিক বাতির আলোকসজ্জা। এ যেন অপার্থিব কোনো দৃশ্য, যা আমাদের কাছে খুব অচেনা। ভালো লাগায় ভরে গেল মনটা।
রাতের এই রূপ দেখতে দেখতে একসময় ঘুমিয়ে গেলাম। পাখির ডাকে সকাল হলো। কিন্তু এ কী! সূর্য কোথায়? এ যে মেঘের পালক। চারদিকে হাওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে সাদা সাদা মেঘ। এমনকি ঘরের জানালা–দরজা দিয়ে মেঘ ঢুকে ভিজিয়ে দিচ্ছে আমাদের। একসময় একপশলা বৃষ্টিও নিয়ে এল সেই মেঘ। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সূর্যের দেখা পাওয়া গেল। হঠাৎ করেই যেন দৃশ্যপট পাল্টে গেল। উজ্জ্বল সোনালি আলোয় ঝকঝক করে উঠল প্রকৃতি। চারদিকে সবুজের সমারোহ। পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। রঙিন প্রজাপতি, ফড়িংয়ের দল উড়ে উড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আবারও মনে হলো এ কী স্বপ্ন, না সত্যি?
আমাদের চারপাশের এই সৌন্দর্য কোনো কল্পনা নয়, এ সত্যি। আমরা দাঁড়িয়ে আছি বান্দরবানের উঁচু পাহাড়ের ওপর হিল রিসোর্ট সাইরুর খোলা অলিন্দে। বান্দরবান পৌঁছাতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল বলে রাতের রূপ দিয়েই শুরু হয়েছিল আমাদের সময়। খোলা চত্বরে দাঁড়িয়ে সামনে তাকিয়ে মনে হলো নজরুলের সেই গানখানি, ‘আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ঐ।’ খোলা বারান্দায় সকালের নাশতা করতে করতে দেখা যায় নীল আকাশ, পাহাড়, সবুজ বনবনানী, নিচে বয়ে চলেছে সাঙ্গু নদী। পাহাড়ের কোলজুড়ে সাজানো আছে ছোট ছোট পাহাড়ি বাড়িঘর।
এখানে নাশতাপর্বের শেষে ঘুরে বেড়ানো যায় রিসোর্টের চারপাশ। একদম উঁচুতে রয়েছে অভিনব একটি সেতু, যা দুটি পাহাড়কে এক করেছে। সেখানেই তৈরি হচ্ছে সুইমিংপুল। ইচ্ছে হলে গা এলিয়ে দিয়ে বসে চা পান করতে পারেন বা গান শুনতে পারেন। একা বসে বই পড়তে চান? খোলা বারান্দায় বসে ছবি আঁকতে চান? দল বেঁধে বসে গল্প করতে বা গান গাইতে বা আড্ডা–হুল্লোড় করতে চান? অথবা দুজনে নিভৃতে বা পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতে চান—তাহলে চিম্বুক পাহাড়ের পাশে এই সাইরুতে যেতে পারেন। বান্দরবান শহর থেকে এক ঘণ্টার পাহাড়ি পথ। রিসোর্টটির সুন্দর স্থাপত্য, আধুনিক সুবিধা, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মুগ্ধ করবে সহজেই।
সকাল গড়িয়ে দুপুর। বারান্দায় বসে সামনে তাকিয়ে থাকতে থাকতে দেখতে পেলাম আকাশজুড়ে মেঘের যে খেলা চলছে, তারই ছায়া পড়েছে পাহাড়ে। যেখানে কালো মেঘ, সেখানে পাহাড় কালো; যেখানে রোদ, সেখানে প্রকৃতি উজ্জ্বল। পাহাড়ে একসঙ্গে এত রূপ, আমি কখনো দেখিনি আগে। জুন থেকে অক্টোবর মানে গ্রীষ্ম ও শরৎকালে এখানে ক্ষণে ক্ষণে প্রকৃতি তার রূপ বদলায়। কবির ভাষায়, ‘আকাশজুড়ে মেঘের খেলা, কোথায় বা সীমানা/ দেশে দেশে খেলে বেড়ায় কেউ করে না মানা।’ আর জেনে নিন সাইরু নামের একটি পাহাড়ি মেয়ের ভালোবাসার গল্প, যা লেখা আছে এই পাহাড়ে। শীতকালটা আবার অন্য রকম ভালো। মেঘ আর রোদের আনাগোনা চলতেই থাকে।
সাইরু থেকে ফেরার পথে দেখে নিতে পারেন চিম্বুক, শৈলপ্রপাত। কিনতে পারেন পাহাড়িদের তৈরি পোশাক, পেঁপে, জাম্বুরা, আনারস, জুমের সবজি, বাংলা কলা, হলুদের ফুল, আদার ফুল, স্কোয়াশ
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.