স্মার্টকার্ড যুগে প্রবেশ করলো বাংলাদেশ। নাগরিকদের উন্নতমানের পরিচয়পত্র প্রদানের কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে গতকাল উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আজ থেকে মাঠ পর্যায়ে বিতরণ কার্যক্রম শুরু হবে। পর্যায়ক্রমে তা দেশের সব নাগরিকের হাতে তুলে দেয়া হবে। বিতরণ কার্যক্রমের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্মার্টকার্ডে নাগরিকদের তথ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্টদের তাগিদ দিয়েছেন। তিনি বলেন, যত ধরনের নতুন প্রযুক্তি রয়েছে, গ্রহণ করা হবে। তবে, তার ফায়ারওয়াল থাকতে হবে। তথ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এ সময় এই স্মার্টকার্ড নকল করা সহজ হবে না বলে আশাবাদ ব্যক্ত করে প্রত্যেক নাগরিকের ব্যক্তিগত তথ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্যও তিনি নির্বাচন কমিশন এবং সংশ্লিষ্ট স্মার্টকার্ড প্রদানকারী কর্তৃপক্ষকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানান। রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে নির্বাচন কমিশন আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদকে স্মার্ট জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদানের মাধ্যমে এই কর্মসূচির উদ্বোধন করা হয়। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিব উদ্দীন আহমদ এই স্মার্ট পরিচয়পত্র প্রেসিডেন্টকে পৌঁছে দেবেন। এরপরই প্রধান নির্বাচন কমিশনার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে তার স্মার্ট জাতীয় পরিচয়পত্র তুলে দেন। এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সকাল সাড়ে ১০টায় অনুষ্ঠানের শুরুতেই মঞ্চে আসন নিয়ে ১০ আঙ্গুলের ছাপ দেন এবং স্মার্টকার্ড সংগ্রহে চোখের স্ক্যানিং করান। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী জাতীয় ক্রিকেট দলের খেলোয়াড়দের হাতে স্মার্ট জাতীয় পরিচয়পত্র তুলে দেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই উন্নত কার্ডই সব রকম সেবা দেবে। ঘরে বসেই এখন অনেক কিছু করা সম্ভব হবে। যার সহায়ক হবে এই স্মার্টকার্ড। তিনি বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ এখন বাস্তব, আমাদের আরেকটি নির্বাচনী অঙ্গীকার পূরণের মাধ্যমে এই কার্ড প্রদানের ফলে আবারো তা প্রমাণিত হলো। আমরা সবাইকে এই কার্ড দিতে পারছি। এটি জাতি হিসেবে আমাদের আরো উন্নত করবে। তিনি বলেন, অনেক প্রযুক্তি আছে, সেসব প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে এই কার্ডের ডাটার নিরাপত্তা জোরদার করতে হবে। কেউ যেন ডাটা ব্যবহার করে কোনো অপরাধ ঘটাতে না পারে, সতর্ক থাকতে হবে এটি নিয়ে। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তৃতা করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিব উদ্দীন আহমদ এবং বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর কিমিয়াও ফ্যান। অনুষ্ঠানে ‘আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেম ফর এনহ্যান্সিং অ্যাকসেস টু সার্ভিস’ শীর্ষক এই প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সুলতানুজ্জামান মো. সালেহ উদ্দীন প্রকল্প সম্পর্কে অবহিত করেন। নির্বাচন কমিশনের সচিব সিরাজুল ইসলাম অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তৃতা করেন। নির্বাচন কমিশন সূত্র জানায়, এই কার্ড প্রদানের জন্য দেশের ১০ কোটি নাগরিকের তথ্য নিয়ে একটি ডাটাবেজ তৈরি করা হয়েছে। এর আওতায় ২০১৭ সালের মধ্যে ৯ কোটি নাগরিককে স্মার্ট জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদান করা হবে এবং এর মাধ্যমে বিদ্যমান পেপার লেমিনেটেড জাতীয় পরিচয়পত্র প্রতিস্থাপিত হবে। সূত্র জানায়, বর্তমান বিশ্বের সর্বাধুনিক প্রযুক্তিতে এটি তৈরি হয়েছে। জাতীয় পরিচয়ের ডাটাবেইজ ও স্মার্ট জাতীয় পরিচয়পত্র বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রত্যয়নকারী কর্তৃপক্ষের সনদপ্রাপ্ত। এটি ট্র্যাভেল কার্ডসহ আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন জাতীয় পরিচয়পত্র হিসেবে বিবেচিত হবে। স্মার্ট জাতীয় পরিচয়পত্র নাগরিকদের শ্রেণি, বয়স, অবস্থা-অবস্থান ও পেশাভিত্তিক রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করবে। এর মাধ্যমে সেবা প্রদানকারী সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানসমূহ অনলাইন ও অফলাইন উভয় পদ্ধতিতে নাগরিকদের পরিচিতি সঠিকভাবে যাচাই করতে পারবে। ডাটাবেইজে অভিগম্যতা লাভের মাধ্যমে অনলাইনে এবং অফলাইনে চিপ/এমআরজেড/বারকোড/ফিঙ্গার প্রিন্ট স্ক্যানারের মাধ্যমে সহজেই স্মার্ট জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্যাদি যাচাই করা সম্ভব। ইতিমধ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের মাধ্যমে ৬৪টি প্রতিষ্ঠান এর সেবা গ্রহণ শুরু করেছে বলেও অনুষ্ঠানে জানানো হয়। আজ ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১৯ নম্বর ওয়ার্ড এবং উত্তরের ১ নং ওয়ার্ডসহ কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ীর জনগণ ও ছিটমহলের অধিবাসীদের মধ্যে প্রথম দিনে এই কার্ড বিতরণ করা হবে বলেও জানানো হয়। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মানবীয় যোগাযোগ প্রসারের এই সময়ে তথ্য সাধারণ কোনো বিষয় নয়, এটি বিশেষ ধরনের ক্ষমতাও। এখন তথ্যের উপযোগিতাও অফুরন্ত। সাম্প্রতিক সময়ে আত্মঘাতী জঙ্গিদের চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে ছবি সংবলিত ভোটার তালিকার সঙ্গে তাদের আঙ্গুলের ছাপ যাচাই করে অনেকের পরিচয় বের করা সম্ভব হয়েছে। তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন ‘আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেম ফর এনহ্যান্সিং অ্যাকসেস টু সার্ভিস (আইডিইএ) প্রকল্পের আওতায় স্মার্ট জাতীয় পরিচয় প্রদানের কাজ হাতে নেয়। এই কঠিন কাজটি করার জন্য নির্বাচন কমিশন এবং আর্থিক সহায়তার জন্য বিশ্বব্যাংককে তিনি ধন্যবাদ জানান। প্রাথমিকভাবে এ ডাটাবেইজ তৈরির উদ্দেশ্য ছিল ছবিসহ ভোটার তালিকা প্রণয়ন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তখন বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় তারাই এই দাবি তুলেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা প্রণয়নের পর প্রাথমিকভাবে পেপার-লেমিনেটেড সাধারণ জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদান করা হলেও সেবা প্রাপ্তিতে জাতীয় পরিচয়পত্রের নানাবিধ ব্যবহারের সম্ভাবনা দেখা দিলে বাংলাদেশের প্রকৃতি, জাতীয় প্রতীক ও প্রতিকৃতিসমূহকে সন্নিবেশিত করে স্মার্ট জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আপনারা জেনে খুশি হবেন যে, স্মার্ট জাতীয় পরিচয়পত্র নকল করা অসম্ভব। বর্তমান বিশ্বের সর্বাধুনিক প্রযুক্তিতে এটি তৈরি হয়েছে। শেখ হাসিনা বলেন, ডাটাবেইজ ও স্মার্ট জাতীয় পরিচয়পত্র এখন আমাদের জাতীয় সম্পদে পরিণত হয়েছে। নির্বাচন কমিশন থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে নাগরিকদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ এবং কাজে লাগানো, তাদের প্রাতিষ্ঠানিক কাজে সময় বাঁচানো, তাৎক্ষণিকভাবে পরিচয়ের তথ্যাদি যাচাই করার জন্য লিংক স্থাপন করা হয়েছে। প্রতি মুহূর্তেই তার সুফলও পাওয়া যাচ্ছে। তিনি বলেন, সরকারি কর্মজীবীদের বেতন নির্ধারণের কাজে সহায়তা করার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগকে কমিশনের ডাটাবেইজে প্রবেশাধিকার দেয়া হয়। ডাটাবেইজে সংরক্ষিত পরিচয়ের তথ্যাদি ব্যবহার করে প্রজাতন্ত্রের চাকরিজীবীদের অনলাইনে বেতন নির্ধারণ করা হয়। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বেতন নির্ধারণের সুবিধার্থে প্রজাতন্ত্রের চাকরিজীবীদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে জাতীয় পরিচয়পত্র সংক্রান্ত সেবা দেয়া হয়েছে। এ সময় সরকারি চাকরিজীবীদের বিপুলসংখ্যক আবেদন নিষ্পন্ন করে নতুন কিংবা সংশোধিত জাতীয় পরিচয়পত্র হস্তান্তর করা হয়। এই কার্ডের নাগরিক সুবিধাপ্রাপ্তি সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের দ্রুততম সময়ে ব্যক্তির পরিচিতি জানা (পাসপোর্ট তৈরির সুবিধার্থে), অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রশিক্ষণ ব্যবস্থাপনায় সরকারি চাকরিজীবীদের তথ্য-উপাত্ত যাচাই, ডিজিটাল স্বাক্ষর গ্রহণের সময় ব্যক্তির পরিচিতি যাচাই, সমাজসেবা অধিদপ্তরের প্রতিবন্ধী নাগরিকের তথ্য যাচাই এবং অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন প্রোগ্রামের কাজের সুবিধার্থে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কেও ইতিমধ্যে ডাটাবেইজে প্রবেশাধিকার প্রদান করা হয়েছে।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.