সাজ্জাদ হোসেন মুরাদ বাবু ও ফাহমিদা মীর মুক্তি। স্বামী-স্ত্রী। দু’জনেরই দ্বিতীয় বিয়ে। প্রথম সংসার ভাঙার পর ভালোবেসেই বিয়ে করেছিলেন তারা। কিন্তু বিয়ের পরই একে অন্যের প্রতি সন্দেহ সৃষ্টি হয়। সন্দেহ থেকে কলহ। একসঙ্গে বাস করেও দু’জনের মধ্যে বাড়তে থাকে দূরত্ব। এর মধ্যেই ২০১৪ সালে জন্ম হয় একটি ফুটফুটে শিশুর। নাম রাখা হলো নিহাল সাদিক। পরবর্তীতে সাংসারিক কলহের নির্মম শিকার হয় এই নিষ্পাপ শিশুটি। দিনটি ছিল এ বছরের ১৮ই এপ্রিল। ধারালো অস্ত্র দিয়ে নিহালকে হত্যা করে তার মা ফাহমিদা মীর মুক্তি (৩৫)। ঘটনাস্থল ঢাকার উত্তরখান থানার মাস্টারপাড়া সোসাইটির চতুর্থ তলার একটি ফ্ল্যাট। এ ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়ার পর আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন নিহতের মা মুক্তি। তার আগে মুক্তিকে আসামি করে তার স্বামী সাজ্জাদ হোসেন মুরাদ বাবু বাদী হয়ে হত্যা মামলা করেন। প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে ডিভোর্সের পর শান্তিনগর এলাকায় থাকতেন সাজ্জাদ। ওই সময়েই টাঙ্গাইলের মীর্জাপুরের বানিয়াদীর মীর ফেদাউর রহমানের মেয়ে মুক্তির সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে তার। অবশ্য তার আগেই দুজন দুজনকে চিনতেন। দুজনেই বড় হয়েছেন ধানমন্ডির শঙ্কর এলাকায়। মুক্তির আগের সংসারে ১৩ বছরের এক কন্যা সন্তান রয়েছে। ওই সন্তান তার পিতার সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ায় থাকে। একইভাবে আগে একটি বিয়ে হয়েছিল সাজ্জাদের। এসব বিষয় জেনে-বুঝেই প্রেমের সম্পর্কে জড়ান তারা। বিয়ে করে নতুন সংসার গড়েন। বিয়ের পর উত্তরার নর্থ টাওয়ারের একটি গার্মেন্টের সেলস এক্সিকিউটিভ হিসেবে চাকরি নেন সাজ্জাদ। বাসা ভাড়া করে স্ত্রী মুক্তিকে নিয়ে থাকেন মাস্টারপাড়া সোসাইটিতে। সাজ্জাদ জানান, বিয়ের পর কয়েক মাস ভালোই চলছিলো। নতুন সংসারে জন্ম হয় নিহালের। এরমধ্যেই বাড়তে থাকে মুক্তির বেপরোয়া জীবনযাপন। মুক্তির উচ্ছৃঙ্খল আচরণে নিরুপায় হয়ে যান তিনি। দ্বিতীয় বিয়ে তাই অনেক কিছুই সহ্য করেন। সাজ্জাদের ভাষায়, ‘বারবার সংসার ভাঙলে সমাজে মুখ দেখানো কঠিন হয়ে যাবে। ফোনে বন্ধুদের সঙ্গেই ব্যস্ত থাকতেন মুক্তি। ব্যস্ত থাকতেন ধূমপান ও আড্ডা নিয়ে। এ নিয়ে কথা বললেই ঝগড়া শুরু হতো। রাতে বাসায় ফিরে রান্না করতে হতো সাজ্জাদকেই। এভাবেই চলছিলো তাদের সংসার।’ তারপরের ঘটনা নির্মম। ১৮ই এপ্রিল। সকাল ১০টায় বাসা থেকে বের হন সাজ্জাদ। রাত ১০টার দিকে বাসায় ফিরেন। বাসায় ঢুকেই দেখতে পান তার স্ত্রী মুক্তি ও সন্তান নিহাল খাটে শুয়ে আছে। ফ্রেশ হয়ে নিহালকে কোলে নিতে তার গায়ে থাকা কম্বল তুলতেই আঁতকে ওঠেন সাজ্জাদ। রক্তে ভেজা বিছানা। নিহালের পেটের ডান পাশে ধারালো অস্ত্রের আঘাত। নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে গেছে তার। এ দৃশ্য দেখে সহ্য করতে পারেননি তিনি। জ্ঞান হারান নিহালের পিতা সাজ্জাদ। খবর পেয়ে উত্তরখান থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) আসাদুজ্জামানসহ পুলিশ সদস্যরা রাত সাড়ে ১১টায় ওই বাসায় গিয়ে নিহালের মা মুক্তিকে গ্রেপ্তার করে। উত্তরখান থানার তৎকালীন এসআই আসাদুজ্জামান জানান, বাসায় পৌঁছে তারা দেখতে পান মুক্তি নিজে গলায় ছুরি-ব্লেড দিয়ে আঘাত করে আত্মহত্যার চেষ্টা করছেন। তাৎক্ষণিকভাবে তাকে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। পরে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নাক, কান ও গলা বিভাগে ভর্তি করে চিকিৎসা করানো হয়। নিহাল হত্যার মামলাটি এখন আদালতে বিচারাধীন। গত মাসের শুরুতেই আদালতে মামলার চার্জশিট প্রদান করেছেন তদন্ত কর্মকর্তা উত্তরখান থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আলমগীর হোসেন। এ বিষয়ে তিনি জানান, স্বামী-স্ত্রী দুজনই দুজনকে অবিশ্বাস করতেন। সন্দেহ-অবিশ্বাস থেকে প্রায়ই তাদের ঝগড়া-বিবাদ হতো। ঘটনার দিন সকালেও তাদের ঝগড়া হয়েছিলো। এসব কারণেই হিংস্র হয়ে ওঠেন মুক্তি। এক সময় নিজ সন্তানকে হত্যা করেন তিনি। বিষয়টি স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন এই নারী। জবানবন্দিতে তিনি বলেন, ‘আমি নিজেই আমার সন্তানকে হত্যা করেছি।’ স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়ার বিষয়টি স্বীকার করে নিহতের পিতা সাজ্জাদ হোসেন মুরাদ বাবু বলেন, বিয়ের পর থেকেই দেখেছি মুক্তির মধ্যে প্রচণ্ড রাগ ও জেদ। অল্পতেই প্রচণ্ড রেগে যেত। ঘরের কাজকর্ম করতো না। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতেই বেশি পছন্দ করতো। তবে শেষ পর্যন্ত নিজ সন্তানকে এভাবে হত্যা করবে তা কল্পনাও করতে পারেননি তিনি।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.