বিপুল দারিদ্র্য আর ভঙ্গুর অর্থনীতি নিয়ে স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশ দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে স্বাধীনতার পরপরই। দ্বিমেরু বিশ্ব রাজনীতির কূটকচালে দারিদ্র্যসীমার ওপরে থাকা মানুষদেরও টেনে নিচে নামিয়ে আনে ওই দুর্ভিক্ষ। বাংলাদেশের তখনকার অবস্থা দেখে বিশ্বের নামকরা অর্থনীতিবিদরা বলেছিলেন, কোনোমতে ভূখ- ও জনগোষ্ঠী টিকে থাকলেও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতি হবে না। ১৯৭৬ সালে ‘বাংলাদেশ : এ টেস্ট কেস ফর ডেভেলপমেন্ট’ নামে একটি বই লেখেন নরওয়ের অর্থনীতিবিদ ড. জাস্ট ফালান্ড ও ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ জ্যাক আর পারকিনসন। বইটিতে তারা বলেন, ‘এই অবস্থা থেকে বাংলাদেশ যদি অর্থনৈতিক উন্নয়ন করতে পারে, তাহলে দুনিয়ার যে কোনো দেশই উন্নত হতে পারবে।’ নব্বইয়ের দশক থেকেই তাদের সেই ভবিষ্যদ্বাণী মিথ্যা প্রমাণ করতে থাকে বাংলাদেশ। অবশেষে বই লেখার ৩১ বছর পর ২০০৭ সালে আগের বক্তব্য সংশোধন করে অর্থনীতিবিদদ্বয় বলেন, ‘গত তিন দশক বা তারও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ সীমিত কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ অগ্রগতি অর্জন করেছে।’
এরপরের দিনগুলো বাংলাদেশের জন্য আরও সম্ভাবনাময় হয়ে দেখা দিয়েছে পৃথিবীর কাছে। কারণ, বাংলাদেশ যত তাড়াতাড়ি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনমানের উন্নয়ন ঘটিয়েছে, দুনিয়ার আর কোনো দেশ তা পারেনি। ২০১২ সালের ৩ নভেম্বর ‘আউট অব দ্য বাস্কেট’ নিবন্ধে ইকোনমিস্ট বলেছে, ‘কী করা যায়, সেটা দেখিয়ে দেওয়ার মডেলে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। কী করে উন্নয়নের মডেলে পরিণত হওয়া যায়, সেটা দেখিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ।’
বাংলাদেশের দারিদ্র্যজয়ের গল্প শুনতে গতকাল রোববার ঢাকায় এসেছেন বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম। যুক্তরাষ্ট্র থেকে রওনা দেওয়ার আগেই তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশ তাদের দরিদ্র মানুষের সংখ্যা অর্ধেকেরও নিচে নামিয়ে এনেছে। এটি স্মরণ করার মতো সফলতা। বাংলাদেশের কাছ থেকে শিক্ষা নেওয়ার আছে অনেক দেশের।’
গত মধ্য ডিসেম্বরে, বিজয় দিবসের আগমুহূর্তে, বিশ্বব্যাংকের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ও প্রধান অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসুও বলে গেছেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন উড়ন্ত সূচনার পর্যায়ে রয়েছে। বিনিয়োগ বাড়লে প্রবৃদ্ধি হবেই। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২৯ শতাংশের সমপরিমাণ বিনিয়োগ হচ্ছে। এটা সুন্দর ভবিষ্যতের একটি সংকেত। তিনি বলেন, ‘এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না, শিগগিরই এশিয়ার নতুন বাঘ হিসেবে আবির্ভূত হবে বাংলাদেশ।’
বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে হতদরিদ্রের সংখ্যা কমেছে। যেখানে ২০০৯-১০ অর্থবছর শেষে ২ কোটি ৮০ লাখ অর্থাৎ ১৮ শতাংশ হতদরিদ্র মানুষ ছিল, সেখানে সাত বছরের ব্যবধানে প্রায় ৮০ লাখ হতদরিদ্র অতি দারিদ্র্যসীমার ওপরে উঠে এসেছে। গত অর্থবছরে অতিদারিদ্রের হার দেশের মোট জনসংখ্যার ১২ দশমিক ৯ শতাংশে নেমে এসেছে। যাদের দৈনিক আয় ১ দশমিক ৯০ ডলারের (১৪৮ টাকার) কম। একাধিক পরিসংখ্যান বলছে, ২০১২ সালে ১৬ দশমিক ৪ শতাংশ, ২০১৩ সালে ১৬ দশমিক ৪ শতাংশ, ২০১৪ সালে ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ, ২০১৫ সালে ১৩ দশমিক ৮ শতাংশ মানুষ অতিদরিদ্র ছিল।
বিশ্বব্যাংক আরও জানায়, বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশে ধারাবাহিকভাবে অতিদারিদ্র্যের হার কমেছে। এই প্রবণতাকে ‘অর্জন’ হিসেবে মনে করে বিশ্বব্যাংক। এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন আমাদের সময়কে জানান, এখনো দেশে এক-চতুর্থাংশ মানুষ দরিদ্র, অর্থাৎ ৪ কোটি মানুষ। এর মধ্যে ২ কোটিই হতদরিদ্র। এই ৪ কোটি মানুষ কম নয়। বড় একটি সংখ্যা এখনো হতদরিদ্র। আর যাদের নিম্ন আয়ের মানুষ বলছি, তাদের অবস্থাও ভালো নয়।
একই সঙ্গে ৬ দশমিক ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে রাখলে অভ্যন্তরীণভাবে আরও আয় বাড়াতে হবে বলে মনে করেন তিনি। ড. জাহিদ বলেন, দারিদ্র্য বিমোচন টেকসই করতে হলে গোড়ায় হাত দিতে হবে। দরিদ্রতা চলে আসছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। বাবা দরিদ্র, তার বাবা দরিদ্র ছিল, তার ছেলে দরিদ্র। দরিদ্রতা আসলে চেইন সিস্টেমে এসেছে। তাই কোনো রকম সহায়তা ছাড়া এদের এখান থেকে বেরিয়ে আসা অসম্ভব। এ ছাড়া গ্রামীণ অবকাঠামো রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ ব্যবস্থার উন্নয়ন, গ্রামীণ কৃষিব্যবস্থার উন্নয়ন, গ্রামীণ কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য কাজ করার কারণে দারিদ্র্যের হার কমে আসবে।
তিনি বলেন, সামাজিক উন্নয়ন বেশ ভালো হয়েছে। এসব কাজ করলেই কাক্সিক্ষত জায়গায় পৌঁছা যাবে। এক্ষেত্রে ট্যাক্সেশন পলিসি সংস্কার দরকার। দুর্নীতি রোধ করা, দক্ষ জনশক্তি তৈরি করা এবং সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো সমাধান করতে হবে। তাহলেই অভ্যন্তরীণ সম্পদ দিয়ে চাহিদা মেটানো সম্ভব। নিজস্ব অর্থায়নের ওপর জোর দিতে হবে। অনুদানের ওপর থাকলে এটা সম্ভব হবে না। অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণের দিকে বেশি জোর দিতে হবে।
দারিদ্র্য বিষয়ে ফোকাল পয়েন্ট পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি) জানায়, পরিকল্পিত অর্থনৈতিক কার্যক্রম, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি (ভিজিডি, ভিজিএফ, জিআর, ওএমএস, টেস্ট রিলিফ, কাবিখা ইত্যাদি), সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, জিডিপি প্রবৃদ্ধির উচ্চ হার, গ্রামীণ এলাকায় সড়ক ও জনপথের ব্যাপক উন্নয়ন এবং সংযুক্তি, গ্রামীণ অকৃষি কর্মসংস্থান, প্রবাসী আয় অব্যাহতভাবে বাড়া ও ব্যাপক বিদ্যুতায়নসহ বিভিন্ন অবকাঠামোগত উন্নয়নের কারণেই দেশে দারিদ্র্য হ্রাসে সাফল্য এসেছে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ আমাদের সময়কে বলেন, দেশে দারিদ্র্যের হার অনেক কমেছে। একই সঙ্গে লক্ষণীয় যে, কম মাত্রায় হলেও বাংলাদেশে ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান কমে আসছে। সাধারণ আয় বৃদ্ধির হারের চেয়ে অতিদরিদ্রদের আয় বৃদ্ধির হার শতকরা ০.৪ ভাগ বেশি। এর কারণ হলো, হতদরিদ্রদের কাজের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। বিশেষ করে বছরের একটি নির্দিষ্ট সময় তাদের হাতে যখন কোনো কাজ থাকে না, তখন সরকারি উদ্যোগে কাজের ব্যবস্থা করা হয়। সরকারের উদ্যোগে ‘একটি বাড়ি একটি খামার’, গ্রামীণ কৃষিভিত্তিক কাজের সুযোগ, এনজিওগুলোর ঋণের সুযোগের কারণে গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা হয়ে উঠছে।
তিনি আরও বলেন, শহরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গ্রামীণ জীবনে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগছে। এ কারণে তারা নানামুখী কর্মসংস্থানের দিকে ঝুঁকছেন। একই সঙ্গে পোশাক খাত দেশে বড় কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে দারিদ্র্যের হার কমাতে সহায়তা করেছে।
ড. নাজনীন বলেন, ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে নানা ধরনের আয়বর্ধক কাজ করার সুযোগ পাচ্ছে অতিদরিদ্ররা। ফলে অর্থনৈতিক কর্মকা-ের পরিধি বেড়েছে। বিশেষ করে গ্রামে কৃষিভিত্তিক নানা কাজের সুযোগ বেড়েছে। এটি ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। কিছুটা হলেও উন্নতি হচ্ছে বণ্টনব্যবস্থার।
বাংলাদেশের দারিদ্র্য কমার প্রধান কারণ হিসেবে বিশ্বব্যাংক বলেছে, এদেশের মানুষের আয় সক্ষমতা বেড়েছে। ২০০৫ সালের ক্রয়ক্ষমতা সমতা (পিপিপি) অনুসারে এক ডলারের মূল্যমান ছিল ৫২ টাকা ৪ পয়সা। ২০১১ সালের নতুন হিসাবে তা ২৪ টাকা ৮০ পয়সা। ২০১৫ সাল থেকে পিপিপির এ নতুন হিসাব বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। নতুন হিসাব অনুযায়ী, একজন ব্যক্তি যদি প্রতি মাসে ১ হাজার ২৯৭ টাকার বেশি আয় করেন, তবে তাকে হতদরিদ্র হিসেবে গ্রহণ করা হবে না।
এদিকে বিশ্বব্যাংক মনে করে, জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) দারিদ্র্য বিমোচনের প্রথম লক্ষ্যটি অর্জিত হবে না। এসডিজি অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে অতিদারিদ্র্যের হার ৩ শতাংশের নিচে নামাতে হবে। এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ব্যাখ্যা হলো, ২০০০ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয় প্রবৃদ্ধি হিসাব করে দেখা গেছেÑ ওই সময় প্রতিবছরে ১ দশমিক ৫৪ শতাংশ হারে দারিদ্র্য কমেছে। এ সময় অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি বেশি হয়েছে। দারিদ্র্য হ্রাসের এ ধারা বজায় থাকলে ২০৩০ সালে দারিদ্র্যের হার কমে দাঁড়াবে ৫ দশমিক ৩৩ শতাংশ।
বিশ্বব্যাংক আরও বলছে, প্রতিবছর দারিদ্র্য হ্রাসের হার দশমিক ৯২ শতাংশ বজায় রেখে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে বছরে গড়ে ৮ দশমিক ৮ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে। এটি বেশ চ্যালেঞ্জিং। আর ১ দশমিক ৫৪ শতাংশ হারে দারিদ্র্য হ্রাসের ধারা বজায় থাকলে ৬ দশমিক ১ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাংলাদেশের দারিদ্র্যজয়ে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগ ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা।
একই সঙ্গে বিশ্বব্যাংক দারিদ্র্য হ্রাসের সাফল্যের সঙ্গে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের কথাও বলেছে। চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ অর্জনের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে সরকার। কিন্তু বিশ্বব্যাংক এ প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৮ শতাংশ হতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক সংস্থাটি মনে করছে, আগামী অর্থবছরে এ প্রবৃদ্ধি আরও কমে ৬ দশমিক ২ শতাংশে নেমে আসবে। সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বৃদ্ধি প্রবৃদ্ধিতে একটি ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে। তবে গত অর্থবছরের প্রাথমিক প্রাক্কলনের তুলনায় ব্যক্তি খাতের ও সরকারি ভোগব্যয়ের প্রবৃদ্ধি কম হবে বলে চলতি অর্থবছরের প্রবৃদ্ধি কম হবে।
এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, দেশে এখনো দুই কোটি লোক চরম দরিদ্র। তবে অর্থনৈতিক উন্নতির কারণে চরম দারিদ্র্য কমেছে। সম্পূর্ণভাবে না কমলেও দারিদ্র্যের চেহারা অনেক পরিবর্তন হয়েছে। বর্তমানে নগর দারিদ্র্য বেড়েছে, যা নতুন চ্যালেঞ্জ। এ ছাড়া বৈষম্য জোরালো হয়েছে। এসব কমে গেলে ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা হলে দারিদ্র্য আরও কমবে বলে মনে করেন তিনি।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.