মৃত্যু ছুঁয়ে গেছে তাকে। প্রায় ৫০ গজ দূরত্বে যখন যমদূত ট্রেন তখনই লাইনের পাশে লাফিয়ে পড়ে সে। দু-রেলপথের মধ্যে পড়ে বেঁচে যায় জীবন। কিন্তু রক্ষা পায়নি তার তিন সাথী। ট্রেনে কাটায় কুটিকুটি হয় তাদের দেহ। এরপর বাড়ি ছুটে গিয়ে খবর দেয় সে। রোববারের ট্রেন দুর্ঘটনায় ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া আপন হাসান আফ্রিদি (৯) এখন আলোচিত এক শিশু। ভাদুঘর ও শহরতলীর বিরাশার গ্রামে আলোচনা তাকে নিয়েই। বিরাশার গ্রামে আফ্রিদিকে নিয়ে আসার পর দলে দলে লোক ভিড় করে তাকে দেখার জন্য। তবে ঘটনার পর রোববার রাতে ঘুমাতে পারেনি সে। চিৎকার করে বলে- আমারে হেরা মাইরা ফালাইবো। ভয়াবহ ঘটনা বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠে তার। স্থানীয় এক ডাক্তার তাকে ঘুমের ওষুধ দেন। কিন্তু ওষুধ খাওয়ার পরও ঘুম হয়নি। চিৎকার করে উঠে। কাপতে থাকে ভয়ে। মা সন্তানকে বুকে ঝাপটে ধরে রাত পার করেন। গতকাল সন্ধ্যায় আফ্রিদির বিরাশার গ্রামের বাড়িতে গিয়ে খোঁজ করলে জানানো হয় সে মক্তবে গেছে। চাচা দানিছ মিয়া সেখান থেকে ডেকে নিয়ে আসেন তাকে। আফ্রিদি জানান, ফুফাতো ভাই মোনায়েমকে নিয়ে ট্রেন রাস্তায় ঘুরতে গিয়েছিল সে। সেখানে আরো দুজনের সঙ্গে দেখা হয়। বাড়ি ফিরে যেতে চেয়েছিল সে। কিন্তু একজন বলে ১৫ মিনিট পরে যাবে। এরমধ্যে সোনারবাংলা ট্রেন আসে। সেই ট্রেনের ছবি তোলার সময়ই ঘটে দুর্ঘটনা। আফ্রিদি জানায়- হেডফোন লাগিয়ে হেরা ছবি তুলছিল। সে জন্য কানে তারা শুনে না। মোনায়েম বসেছিল। আরেকটি ট্রেন আসতে দেখে আমি মোনায়েমকে ডাক দেই। বলি মোনায়েম এমেদা আ (এদিক)। আর হেরাতো হুনেই না। কানে হেডফোন লাগাইয়া ছবি তুলতাছে। হাতের ইশারায় সে ৫০ গজ দূরত্ব দেখিয়ে বলে ঐখানে ট্রেন থাকতেই সে একপাশে লাফিয়ে পড়ে। এরপর দেহি ট্রেন পট (ধাক্কা) মারছে মোনায়েমরে। ট্রেন গেছে পড়ে হেরারে আমি বিছারছি। চাইয়া দেহি একজনের হাত গেছেগা,পাও গেছেগা। আমরা ছিলাম ৪ জন। এরমধ্যে ৩ জন মারা গেছে। আফ্রিদি বলে এরপর আমারে একটা লোক বলে হেরার বাড়ি কই চিনাইয়া দিতে। এরপর আমি বাড়িতে যায়। আফ্রিদি বলে সারারাতই সে দৃশ্য চোখে ভাসে। মনে হয় আমারে শুদ্ধা মাইরা লাইবো হেরা। শুক্রবার ভাদুঘরে ফুফুর বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিল আফ্রিদি। রোববার সকালে মামাতো ভাই মোনায়েম সঙ্গে গিয়েছিল ভয়াল রেলপথে। আফ্রিদির মা শাকিলা বেগম জানান-খবর পেয়ে তিনি প্রথম হাসপাতালে যান। সেখানে না পেয়ে ছুটে যান ভাদুঘরে। দেখতে পান তাকে পানি ঢালা হচ্ছে। ভাদুঘর থেকে বাড়িতে নিয়ে আসা হয় ওই সময়ে। আফ্রিদি বিরাশার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে সবার ছোট সে। তার পিতা নান্নু মিয়া আনন্দবাজারের একজন ব্যবসায়ী। রোববার ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের ভাদুঘরে মুঠোফোনের ক্যামেরায় চলন্ত ট্রেনের (সোনারবাংলা এক্সপ্রেস) দৃশ্য ধারণ করতে গিয়ে বিপরীত দিক থেকে আসা আরেকটি ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যু হয় তিন কিশোরের। নিহতরা হলো- বিজয়নগর উপজেলার পত্তন ইউনিয়নের নোয়াপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র কাউছার মিয়ার ছেলে মো. শুভ (১০), পৌর শহরের ভাদুঘর ভূঁইয়াপাড়া এলাকার আনিস মিয়ার ছেলে ব্র্যাক স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র পারভেজ মিয়া (১৪) ও একই গ্রামের কারী বাড়ির বাহার মিয়ার ছেলে স্থানীয় দারুল উলুম ভাদুঘর মাদরাসার নূরানী বিভাগের ছাত্র মো. মোনায়েম হোসেন (১২)। গতকাল পারভেজ ও মোনায়েমের বাড়িতে গিয়ে তাদের বাবা-মাকে আহাজারি করতে দেখা যায়। একমাত্র সন্তান পারভেজকে হারিয়ে তার বাবা-মা পাগলপ্রায়। সন্তানের কাপড়-চোপড়, বই-ব্যাগ জড়িয়ে বিলাপ করে কাঁদছিলেন তারা। এদিকে গতকাল চিনাইর এলাকায় ট্রেনে কাটা পড়ে মারা যায় এক ব্যক্তি। তার বয়স ৪০। তবে পরিচয় পাওয়া যায়নি।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.