বৈদেশিক সহায়তা না পাওয়ায় বাতিল হচ্ছে বাংলাদেশ রেলওয়ের গুরুত্বপূর্ণ ৭ প্রকল্প। বছরের পর বছর অপেক্ষা করেও প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী অর্থ পাওয়া যায়নি। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদও শেষ হয়ে গেছে। এ অবস্থায় প্রকল্প বাতিলের বিষয়ে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়কে জানিয়ে দিয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাংকসহ অন্য দাতাদের সাড়া না পাওয়ায় এসব প্রকল্প বাতিলের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
জানা গেছে, ৭ প্রকল্প বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয় ২ হাজার ৭০৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে বৈদেশিক সহায়তাই ছিল ২ হাজার ৪৪২ কোটি টাকা।
এ প্রসঙ্গে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. ফিরোজ সালাহ উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, বৈদেশিক সহায়তা পাওয়ার আশায় ৭ প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছিল। কিন্তু দীর্ঘদিনেও অর্থায়ন নিশ্চিত না হওয়ায় তালিকা থেকে এখন বাদ দেয়া হচ্ছে। কেননা বাস্তবায়ন নেই অথচ হিসেবে থাকলে খারাপ দেখায়। তবে গুরুত্বের কথা বিবেচনা করে বৈদেশিক অর্থায়ন পাওয়া গেলে আবারও এসব প্রকল্প হাতে নেয়া হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, একটি প্রকল্পে সরকারি তহবিলের সামান্য অর্থ ব্যয় হয়েছে। বাকিগুলোর কাজই শুরু করা হয়নি।
সূত্র জানায়, রফতানি অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পটি ২০০৯ সালের জুলাই থেকে ২০১১ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়নের কথা ছিল। পরবর্তীকালে মেয়াদ বাড়িয়ে ২০১৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়। এটি বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছিল ১ হাজার ১৪০ কোটি টাকা। এর মধ্যে বৈদেশিক সহায়তার অংশ ছিল ৮৫০ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। কিন্তু বৈদেশিক অর্থায়ন নিশ্চিত না হওয়ায় এখন পর্যন্ত প্রকল্পটির কাজই শুরু করা সম্ভব হয়নি।
এ প্রসঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের বিশ্বব্যাংক উইংয়ের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, বিশ্বব্যাংক সাধারণত রেলে সহায়তা করে না। এর আগে কক্সবাজার-ঘুনধুম রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পেও বিশ্বব্যাংকের কাছে সহায়তা চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু সংস্থাটি দেয়নি। কারণ হিসেবে তিনি জানান, রেলে সাধারণত এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) অর্থায়ন করে থাকে। ফলে বিশ্বব্যাংক মনে করে, সবাই একই ফিল্ডে অর্থায়ন না করে আলাদা ফিল্ডে করা উচিত।
বাতিলের তালিকায় থাকা অন্য প্রকল্পগুলো হচ্ছে- বাংলাদেশ রেলওয়ের জন্য ১২৫টি ব্রডগেজ (বিজি) যাত্রীবাহী গাড়ি সংগ্রহ প্রকল্প। এটি বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৫৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে বৈদেশিক সহায়তা প্রয়োজন প্রায় ২৪৫ কোটি টাকা। প্রকল্পটি ২০১০ সালের ১ আগস্ট থেকে ২০১৩ সালের ৩০ জুনের মধ্যে বাস্তবায়নের কথা ছিল। এখন অসমাপ্ত অবস্থায়ই প্রকল্পটি সমাপ্ত ঘোষণার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয়।
এছাড়া বাংলাদেশ রেলওয়ের জন্য ১৫০টি মিটার গেজ (এমজি) যাত্রীবাহী গাড়ি সংগ্রহ শীর্ষক প্রকল্পটি ২০১০ সালের ১ ডিসেম্বর থেকে ২০১২ সালের ৩০ জুনের মধ্যে বাস্তবায়নের কথা ছিল। বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয় ৫৫৬ কোটি ১১ লাখ টাকা। এর মধ্যে বৈদেশিক সহায়তা ছিল ৩৯৭ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। প্রকল্পটি প্রসঙ্গে রেলপথ মন্ত্রণালয় বলছে, দুইবার দরপত্র আহ্বান করা হয়েছিল। কিন্তু প্রত্যাশা অনুযায়ী দরদাতা পাওয়া যায়নি। এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুমোদন সাপেক্ষে ভারতীয় লাইন অব ক্রেডিট (এলওসি) থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। পরবর্তীকালে অন্য কোনো দাতা না পাওয়ায় অসমাপ্ত রেখেই প্রকল্পটি সমাপ্ত করার কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
বাংলাদেশ রেলওয়ের জন্য ২৬৪টি এমজি কোচ ও ২টি বিজি ইন্সপেকশন কার সংগ্রহ শীর্ষক প্রকল্পটিরও একই অবস্থা। ৯৮৩ কোটি ২৪ লাখ টাকা ব্যয়ে ২০১০ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০১২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে বাস্তবায়নের লক্ষ্য ধরা হয়েছিল। এর মধ্যে বৈদেশিক সহায়তার অংশ ছিল ৬৮৮ কোটি ৪১ লাখ টাকা। কিন্তু দু’বার দরপত্র আহবান করা হলেও ভারতীয় কৃতকার্য দরদাতা না পাওয়ায় প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন নিয়ে ভারতীয় এলওসি থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। পরবর্তীকালে অন্য কোনো দাতা না পাওয়ায় এখন বাস্তবায়ন অসমাপ্ত রেখেই প্রকল্পটি বাতিল করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ রেলওয়ের বিজি ডিজেল ইলেকট্রিক মাল্টিপল ইউনিট (ডিইএমইউ) সংগ্রহ শীর্ষক প্রকল্পটি ২০১০ সালের ১ ডিসেম্বর থেকে ২০১৩ সালের ৩০ জুনের মধ্যে বাস্তবায়নের লক্ষ্য ছিল। পরবর্তীকালে মেয়াদ বাড়িয়ে ২০১৫ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়। এটি বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩৩১ কোটি ৩২ লাখ টাকা। এর মধ্যে বৈদেশিক সহায়তার অংশ ছিল ২৩০ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। রেলপথ মন্ত্রণালয় বলছে, বৈদেশিক অর্থায়ন নিশ্চিত না হওয়ায় অসাপ্ত রেখেই প্রকল্পটি বাতিলের কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
এছাড়া রফতানি অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রকল্প প্রস্তুতির জন্য কারিগরি সহায়তা শীর্ষক প্রকল্পটি ২০০৮ সালের জুলাই থেকে ২০১০ সালের মার্চের মধ্যে বাস্তবায়নের কথা ছিল। পরবর্তীকালে মেয়াদ বাড়িয়ে ২০১২ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়। এটি বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছিল ১১ কোটি ২ লাখ টাকা। এর মধ্যে বৈদেশিক সহায়তা ছিল ১০ কোটি ১১ লাখ টাকা। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন করার কথা থাকলেও সেই অর্থায়ন নিশ্চিত হয়নি। ফলে এটি বাতিল করা হচ্ছে।
রেলওয়ের বাস্তবায়িতব্য প্রকল্পগুলোর সম্ভাব্যতা সমীক্ষা, সেফগার্ড পলিসিগুলোর সমীক্ষা, বিস্তারিত ইঞ্জিনিয়ারিং ডিজাইন, টেন্ডারিং সার্ভিস প্রদানের লক্ষ্যে কারিগরি সহায়তা প্রকল্পটি ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০০৯ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়নের কথা ছিল। পরবর্তীকালে মেয়াদ বাড়িয়ে ২০১৩ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়। এটি বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছিল ২০ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে বৈদেশিক সহায়তা ধরা হয় ১৮ কোটি ৩১ লাখ টাকা। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন করার কথা থাকলেও পরবর্তীকালে তা নিশ্চিত হয়নি। ফলে বর্তমানে প্রকল্পটি বাতিল করা হচ্ছে।
রেলের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুগান্তরকে বলেন, ভারত মিটারগেজ কোচ তৈরি করে না বলেই এলওসি থেকে দুটি প্রকল্প বাদ দেয়া হয়েছে। এছাড়া বিশ্বব্যাংক প্রতিশ্রুতি দিয়েও অজ্ঞাত কারণে অর্থায়ন করেনি। ফলে তিনটি প্রকল্পই বাতিল হচ্ছে।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.