আগামী বছর (২০১৭ সালে) বিশ্ব বাজারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটি বলছে, তেল রফতানিকারক দেশগুলোর সংস্থা ওপেক জ্বালানি তেলের উত্তোলন কমানোর সিদ্ধান্তই এর কারণ। তখন ব্যারেল প্রতি অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের মূল্য প্রায় ৩ ডলার বেড়ে দাঁড়াবে ৫৫ ডলারে। বর্তমানে তা প্রায় ৫২ ডলার। এর আগে জুলাই মাসের দেয়া পূর্বাভাসে বলা হয়েছিল প্রতি ব্যারেলের দাম ৫৩ ডলার হবে। কমোডিটি মার্কেট আউটলুক শীর্ষক এক সমীক্ষা প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংক। বৃহস্পতিবার সংস্থার ওয়েবসাইটে তা প্রকাশ করা হয়। দৈনিক উৎপাদন ৩ কোটি ২৫ লাখ ব্যারেলে নামিয়ে এনে আগামী দুই বছরে তেলের দাম ৬০ ডলারে উন্নীত করতে চায় ওপেক। এর ফলে আগামীতে তেলের পাশাপাশি অন্যান্য পণ্যের দামও বাড়বে বলে মনে করে বিশ্বব্যাংক।
তবে জ্বালানি তেলের এ মূল্য বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনীতিতে খুব বেশি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। কিন্তু দাম বাড়ার এ ধারাবাহিকতা যেহেতু আগামী বছরগুলোতেও থাকতে পারে- সেজন্য মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়নের এখনই উপযুক্ত সময় বলে মনে করছেন তারা। বলা হয়েছে, কোন পরিকল্পনা না থাকলে শিল্প উদ্যোক্তাদের মধ্যে অনিশ্চয়তা তৈরি হতে পারে। ফলে সেটি শিল্পের জন্য ভাল হবে না।
অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ শনিবার যুগান্তরকে বলেন, কিছুটা প্রভাব অবশ্যই পড়বে। যেমন দাম কম থাকায় বিপিসি তাদের ঘাটতি পুষিয়ে বরং লাভ করেছে। এক্ষেত্রে তাদের লাভ কমে যাবে। তবে আর্ন্তজাতিক বাজারে দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যদি সরকার দেশে ডিজেলের দাম বাড়িয়ে দেয় তাহলে সেক্ষেত্রে পরিবহণসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে দাম বেড়ে যাবে। তাছাড়া আমদানী করা কোনো পণ্যের দাম বাড়লে দেখা যায়, যৌক্তিক হোক আর অযৌক্তিক হোক আমাদের দেশে দাম বেড়ে যায়। এটা ঠিক নয়। ভারতসহ বিভিন্ন দেশে কোনো পণ্যের দাম আর্ন্তজাতিক বাজারে বাড়লে তারাও বাড়ায়, আবার কমলে তারাও কমায়। কিন্তু বাংলাদেশে বাড়ে, কমে না। এজন্য কোন মধ্যমেয়াদী পলিসিও নেই। এভাবে চলতে থাকলে শিল্পে ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে। শিল্প উদ্যোক্তাদের মধ্যে এক ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হবে। এজন্য মধ্যমেয়াদী পরিকল্পনা করা উচিত।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠোনের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ড. মোস্তফা কে. মুজেরী যুগান্তরকে বলেন, প্রতি ব্যারেল তেলের দাম ৫৫ ডলার হলে খুব বেশি দুশ্চিন্তার কারণ নেই। কেননা এর আগে ১০০ ডলার পর্যন্ত দাম উঠেছিল। তাই আগামী বছর এতটুকু বৃদ্ধিতে দৃশ্যমান কোনো প্রভাব পড়বে না। তবে এভাবে জ্বালানি তেলের দাম আগামী বছরগুলোতে বাড়তেই থাকবে। এজন্য সরকারের উচিত এখন থেকে দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থা নেয়া। কেননা আগামীতে জ্বালানীর চাহিদাও বাড়বে। সেজন্য চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে সমন্বয় আনতে সার্বিকভাবে জ্বালানি খাতের দীর্ঘকালীন পরিকল্পনা তৈরি ও বাস্তবায়নের এখনই উপযুক্ত সময়।
বিশ্বব্যাংকের কমোডিটি মার্কেট আউটলুক একটি ত্রৈমাসিক প্রকাশনা। জানুয়ারি, এপ্রিল, জুলাই এবং অক্টোবর মাসে এটি প্রকাশিত হয়। কমোডিটি মার্কেট আউটলুকের প্রতিবেদনে প্রধান প্রধান দ্রব্যসামগ্রীর, বিশেষ করে জ্বালানি, ধাতব ও খনিজ, কৃষিজাত এবং সারের মূল্য সংক্রান্ত বাজার বিশ্লেষণ করা হয়ে থাকে। ধারাবাহিক তথ্যের ভিত্তিতে ৪৬টি প্রধান প্রধান পণ্যের মূল্য সম্পর্কে ২০২৫ সাল পর্যন্ত ভবিষ্যৎ বাণী করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস এবং কয়লার মূল্য জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির মধ্যে অর্ন্তভুক্ত রয়েছে। জুলাইতে এসব পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি সংক্রান্ত যে ধারণা করা হয়েছিল তা ছাড়িয়ে যাবে। এসব জ্বালানির মূল্য ২৫ শতাংশ বাড়বে বলে আশংকা করা হচ্ছে। চলতি বছরে (২০১৬) ব্যারেলপ্রতি সব ধরনের জ্বালানির মূল্য গড়ে জুলাই মাসে প্রকাশিত প্রতিবেদনে যে পূর্বাভাস দেয়া হয়েছিল তা অপিরিবর্তিত থাকবে।
এ প্রসঙ্গে কমোডিটি মার্কেট আউটলুকের লেখক সিনিয়র অর্থনীতি বিদ জন ব্যাফিস বলেছেন, আগামী বছর জ্বালানি তেলের মূল্য অপরিহার্যভাবেই বাড়বে। অবশ্য তিনি এ কথাও বলেন, ওপেক যদি সিদ্দান্তে পরিবর্তন আনে সেক্ষেত্রে এমন আশংকা সৃষ্টি নাও হতে পারে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ২০১৭ সালে কতিপয় পণ্যের চাহিদা যেমন একদিকে বাড়বে, অন্যদিকে এ সব দ্রব্যের উৎপাদন বর্ধিত চাহিদার সংঙ্গে সংগতি রেখে বর্ধিত করা না গেলে কিংবা উৎপাদন সীমিত রাখা হলে এ সব দ্রবের মূল্য বৃদ্ধি পাবে।
আগামী বছর ধাতব ও খনিজ পদার্থের মূল্য ৪ দশমিক ১ শতাংশ বাড়বে। এ সব পণ্যসামগ্রী সরবরাহে অপ্রতুলতা থাকায় মূল্যবৃদ্ধি শূণ্য দশমিক ৫ শতাংশ উর্দ্ধমুখী হবে। বছরের শুরুতে জিংক উত্তোলনকারী কয়েকটি বড় বড় খনি বন্ধ হওয়ায় এবং উৎপাদন কমে যাওয়ায় জিংকের মূল্য ২০ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। সুদের চড়া হার এবং চোরাচালান মার্কেটে সোনা কেনার সুযোগে ভাটা পড়ায় সোনার মূল্য আউন্স প্রতি ১ হাজার ২১৯ ডলারে নেমে যাবে।
গত জুলাই মাসে যা অনুমান করা হয়েছিল তার চেয়ে কিছুটা কম হলেও কৃষিজাত দ্রব্যের মূল্য ২০১৭ সালে ১ দশমিক ৪ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। বিশ্বব্যাপী কফি উৎপাদন বেড়ে যাওয়ায় পানীয়জাত পণ্যের মূল্য শূণ্য দশমিক ৬ শতাংশ কমবে বলে ধারণা করা হয়েছে প্রতিবেদনে। খাদ্য দ্রব্যের মূল্য বিশেষ করে দানাদার শস্যের মূল্য ২ দশমিক ৯ শতাংশ বাড়বে এবং তেল ও অন্যান্য আহার্য্য পণ্য সামগ্রীর মূল্য অনুমিত মাত্রার চেয়েও ২ শতাংশ কম বৃদ্ধি পাবে।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.