গত ২৯ ডিসেম্বর বিকেল ৫টার দিকে রান্নার জন্য ব্যবহৃত গ্যাস সিলিন্ডারের বিস্ফোরণের দগ্ধ হন আরিফ(২৫)। ছয় ঘন্টা পর তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়া হলে ৩দিন পর চিকিৎসারত অবস্থায় মরা যান।
একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে বারবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলছেন মা। ঘটনার পর থেকে ভাত খাওয়াই ছেড়ে দিয়েছেন তিনি। পরিবারে চলছে শোকের মাতম। এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে আগুন লাগার পর ফেসবুকে আপলোড হওয়া দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার আকুতির ভিডিও।
আরিফের মায়ের দাবী তার ছেলে হত্যা করেছে আল সিডর কোম্পানী। সময় মতো হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা করালে তার ছেলেকে আজ মরতে হতো না।
টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার মাটিয়াটা গ্রামের মৃত চান মাহমুদের ছেলে আরিফ। আড়াই বছর আগে দরিদ্র পরিবারের অভাব দূর করার জন্য পাড়ি দিয়েছিলেন সৌদি আরবে। কাজ পেয়েছিলেন আল সিডর কোম্পানীর রোড ক্লিানার পদে। মক্কা থেকে ৩৫ কি.মি দূরে সিডর কোম্পানীর শ্রমিক আবাসস্থল নামক এক জেলখানায় অন্যান্য শ্রমিকদের সাথেই থাকতেন তিনি।
সৌদি আরবের মক্কায় সিডর কোম্পানীর শ্রমিক ক্যাম্পে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ঘটে। এসময় দগ্ধ হয় ১০জন। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় ৪ বাংলাদেশীর। পরে হাসপাতালে চিকৎিসাধীন অবস্থায় আরো এক বাংলাদেশীর মৃত্যু হয়।
নিহত ৫ বাংলাদেশীর ৪জনের বাড়িই টাঙ্গাইলে। নিহতরা হলেন-টাঙ্গাইল সদর উপজেলার আলোকদিয়া গ্রামের আব্দুস সবুরের ছেলে শরিফুল ইসলাম, ঘাটাইলের পেচারআটা প্রামের নান্নু মিয়ার ছেলে আরিফ হোসেন, একই এলাকার মৃত চান মাহমুদের ছেলে আরিফ হোসেন(ছোট আরিফ) ও দেওপাড়া সিকদার পাতার ছেলে হানফি।
নিহত সকলের বাড়ীতেই চলছে শোকের মাতম। আপনজনের এমন নির্মম মৃত্যু তারা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না।
এদিকে ঘটনার ৯দিন অতিবাহিত হেয়ে গেলেও প্রশাসনের পক্ষ্য থেকে এখন পর্যন্ত নিহতদের পরিবারের সদস্যদের সাথে যোগাযোগ করা হয়নি।
আরিফেরর চাচাতো ভাই নুরুল আলম বলেন, আগুন লাগার পর মোট দশজনের মতো দগ্ধ হয়। সাড়ে পাঁচ ঘন্টা অতিবাহিত হয়ে গেলেও কোম্পানীর লোকজন তাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়নি। এসময় বিনাচিকিৎসায় ৪জনের মৃত্যু হয়। পরে শ্রমিকদের তোপের মুখে ছয় ঘন্টাপর অন্য দগ্ধ আহতদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়া হলে তিনদিন পর ছোট আরিফের মৃত্যু হয়।
তিনি আরো জানান আগুন লাগার কয়েক ঘন্টাপর একটি ভিডিও ফেসবুকে দেয়া হয়েছে সেখানে দেখা যায়, কেউ মাটিতে পড়ে রয়েছে, কারো কারো শরীরে অন্যান্য শ্রমিকরা ডীম লাগিয়ে দিচ্ছেন। তার মধ্যে সবথকে মর্মান্তিক দৃশ্য হলো আরিফের বাঁচার জন্য চিৎকার। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার আকুতি। আমরা মনে করি সময়মতো তাদের হাসপাতালে নেয়া হলে কোনো মায়ের বুকই আজ খালি হতো না।
পেচারআটা গ্রামের আরিফের পরিবারের দাবীও একই। আড়াই ও পাঁচ বছরের দু’টি সন্তান নিয়ে এখন দিশেহারা স্ত্রী। স্ত্রী আছমার দাবী তার স্বামীকে বিনা চিকিৎসায় হত্যা করা হয়েছে। এখন তার স্বামীকে দ্রুত ফেরত চান তিনি।
দেওপাড়া গ্রামের হানিফের পরিবারের সকলেই শোকে পাথরে পরিনিত হয়ে গেছে। এই শীতেই বাড়ীতে আসার কথা ছিলো হানিফের। অপরিচিত মানুষ দেখলেই ঘোর লাগা নয়নে হানিফের বৃদ্ধ মা প্রশ্ন করে ‘কে হানিফ আইলি নি?’।
দেওপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মাসুম জানান, ‘সেখানে থাকা অন্য বাংলাদেশীদের কাছ থেকে আমরা জেনেছি ঘটনার পর সৌদিস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস থেকেও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।’
তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে আরো বলেন, ‘দূতাবাসকে ঘটনার সাথে সাথে জানানো হয়েছিলো। কিন্তু তারা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। তাহলে দূতাবাস কেন? তাহলে এই মানুষগুলি যে অমানবিক পরিশ্রম করে দেশে টাকা পাঠায় তা কি শুধুই পরিবারের জন্য? দেশের জন্য কিছুই না?’
এবিষয়ে টাঙ্গাইালের জেলা প্রশাসক মাহবুব হোসেন বলেন, ‘বিষয়টি সম্পর্কে আমরা অবগত নই। যা জানার তা মিডিয়ার মাধ্যমেই জেনেছি। উচ্চ মহলের নির্দেশনা মোতাবেক যা করনীয় তার সবটুকুই করা হবে।’
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.