হাসপাতালে পুলিশ পাহারায় চিকিৎসাধীন মা শাহানা আক্তার (বাঁয়ে); বিষমুক্ত করার পর এক স্বজনের কোলে শিশু আগমনী।
হাসপাতালের শয্যায় নিথর পড়ে দেড় বছরের ফুটফুটে শিশু আরিয়া মনি। পাশের শয্যায় ছটফট করছিল তার বড় বোন আগমনী (৪) ও মা শাহানা আক্তার (৩২)। আর বাবা আমজাদ হোসেন (৪০) হাসপাতাল থেকে পালিয়ে গেছেন। প্রতিবেশী ও পুলিশ সদস্যরা মা-মেয়েকে বাঁচাতে চিকিৎসকদের সঙ্গে ঘুরছেন। আগেই আভাস দিলেও দীর্ঘ সময় পর আরিয়াকে আনুষ্ঠানিকভাবে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক। গতকাল রবিবার ভোরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে একটি পরিবারের এমন বিপর্যয়ের দৃশ্য দেখেছে অনেকেই।
শাহানা আক্তারের অবস্থা এখনো সংকটাপন্ন। জ্ঞান ফেরার পর আগমনী ‘আম্মু যাব’ বলে বিলাপ করছে। অথচ শনিবার রাতেও মায়ের ‘নিরাপদ’ কোলে ঘুমাতে চেয়েছিল সে। উল্টো মা-বাবার হাত ধরেই যমদূত এসে দাঁড়ায় তাদের দুয়ারে! শনিবার গভীর রাতে রাজধানীর উত্তর বাড্ডার বাসার দরজা ভেঙে মা ও দুই শিশুকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে পুলিশ ও প্রতিবেশীরা। সংশ্লিষ্টরা ধারণা করছেন, দুই সন্তানের মুখে ফ্লোর ক্লিনার ঢেলে নিজেও তা সেবন করে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন শাহানা। স্বামী আমজাদের সঙ্গে ঝগড়ার কারণেই এই অপচেষ্টা। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, ঘটনাটি আত্মহত্যা, নাকি হত্যার চেষ্টা তা খতিয়ে দেখছেন তাঁরা। আমজাদকে পাওয়া গেলে এবং শাহানা সুস্থ হলে তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
বাড্ডা থানার ওসি আব্দুল জলিল জানান, উত্তর বাড্ডার খানবাগ মসজিদের পাশের চ-৪৯/২ নম্বর ‘পঞ্চকুঞ্জ ভিলা’ নামের পাঁচতলা বাড়ির চতুর্থ তলায় থাকে ওই দম্পতি। ওই বাসা থেকে শনিবার দিবাগত রাত দেড়টার দিকে দরজা ভেঙে মা ও দুই শিশুকে উদ্ধার করা হয়। প্রথমে তাদের বাড্ডা জেনারেল হাসপাতালে এবং পরে ঢামেক হাসপাতালে নেওয়া হয়। ভোর ৪টার দিকে আরিয়াকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক। এরই মধ্যে আমজাদ পালিয়ে যান। ওসি বলেন, ‘বিষক্রিয়ার খবর আমরা জানতে পেরেছি। অন্য কেউ বিষ খাইয়ে হত্যার চেষ্টা করেছে, নাকি শাহানা নিজে জড়িত—তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। আত্মহত্যার চেষ্টা হলেও সন্তান হত্যার অভিযোগ আনা হবে মায়ের বিরুদ্ধে।’ জানতে চাইলে আব্দুল জলিল বলেন, দাম্পত্য কলহের জের ধরে ঘটনাটি ঘটেছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে। তবে সুনির্দিষ্ট কারণ জানা যায়নি।
গতকাল দুপুরে ওই বাড়িতে গিয়ে ফ্ল্যাটটি তালাবদ্ধ দেখা যায়। ফ্ল্যাটের মালিক মফিজুর রহমান জানান, তিন বছর ধরে তাঁর বাসায় ভাড়া থাকে ওই দম্পতি। শনিবার দিবাগত রাত ১টার দিকে আমজাদ বাসায় ফিরে দরজায় নক করেন। দরজা না খোলায় তিনি মোবাইল ফোনে কলও দেন। এর পরও কোনো সাড়া না পেয়ে তিনি ফ্ল্যাটের মালিকসহ প্রতিবেশীদের ডাকেন। সেলিম নামের এক প্রতিবেশী তখন ফোন করে পুলিশকে খবর দেন। এরপর পুলিশের উপস্থিতিতে সবাই মিলে দরজা ভাঙে। মফিজুর রহমান আরো জানান, ভেতরে ঢুকে শাহানা ও আগমনীর গোঙানির শব্দ শোনা যায়। তবে আরিয়ার কোনো সাড়া মিলছিল না। তাদের দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া হয়। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পুলিশ দেখে বলছিল, তারা ফ্লোর ক্লিনার খেয়েছে। বাসায় বড় ধরনের কোনো ঝামেলার কথা আগে শুনিনি।
গতকাল হাসপাতালে শাহানা ও আগমনীর পাশে কয়েকজন আত্মীয়কে দেখা গেছে। তবে তারা ঘটনার ব্যাপারে কিছু জানে না বলে দাবি করেছে। দুপুরে ময়নাতদন্ত শেষে আরিয়ার লাশ গ্রহণ করেন তার চাচা নূর ইসলাম। তিনি বলেন, ‘কী নিয়ে কী হয়েছে বুঝতে পারছি না। আমরা খবর পেয়ে কুড়িগ্রাম থেকে এসেছি। পুলিশ বলছে এটা আত্মহত্যা।’ তিনি জানান, কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলার গোয়ালগ্রামে শাহানার বাড়ি। একই উপজেলার শৌলমারী গ্রামে আমজাদের বাড়ি। আট বছর আগে তাঁদের বিয়ে হয়। আমজাদ দেশ গ্রুপ নামের একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন।
ঢামেক মর্গ সূত্র জানায়, আরিয়ার শরীরে আঘাতের চিহ্ন নেই। বিষক্রিয়ায় তার মৃত্যু হয়েছে বলে আলামত মিলেছে। এ কারণে ভিসেরা পরীক্ষার জন্য আলামত সংরক্ষণ করা হয়েছে। ৫০২ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন আগমনীর জ্ঞান ফিরেছে গতকাল দুপুরে। এর পর থেকে সে ‘আম্মুর কাছে যাব’ বলে কেঁদে চলেছে। চিকিৎসক সরোয়ার হোসেন জানান, মেয়েটি এখন শঙ্কামুক্ত। সে আননোন পয়জনিংয়ে আক্রান্ত বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। তার রক্ত পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে।
হাসপাতালের ২১০ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন শাহানা। গতকাল বিকেলে তাঁর জ্ঞান ফিরেছে। তবে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, তাঁর অবস্থা এখনো সংকটাপন্ন।
গতকাল বিকেল পর্যন্ত আমজাদের কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। প্রতিবেশী সেলিম দাবি করেন, স্ত্রী ও সন্তানদের হাসপাতালে নেন আমজাদ। সেখানে ছোট বাচ্চাটা মারা যাওয়ায় হয়তো ভয় পেয়ে পালিয়েছেন তিনি।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.